‘মাতৃভাষায় ডাক্তারি’ পড়ার আড়ালে অহিন্দী ভাষীদের উপর সুচতুর কৌশলে হিন্দী ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা হচ্ছে- সে বিষয়ে এখন এখানে কিছু লিখছি না।
শুধু কয়েকটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। মাতৃভাষায় শিক্ষা নিয়ে অনেকের মনেই আবেগ আছে। আমারও আছে। কিন্তু তাই বলে বাস্তবকে তো অস্বীকার করতে পারি না!
আমি ইংরেজিতে ডাক্তারি পড়েছি। কিন্তু তাতেও অসংখ্য ল্যাটিন এবং কিছু গ্রীক শব্দ রয়ে গেছে। সেগুলো বাদ দিয়ে কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান ইংরেজীতে পড়ানো হয় না, অথবা সম্ভব নয়। সম্ভব যদি হত, এতদিনে ওগুলো বাদ চলে যেত।
মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা আর মাতৃভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা- এই দুটো বিষয় কিন্তু এক নয়। এই বিষয়ে অনেকে আচার্য্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু কে ঊদ্ধৃত করছেন। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করতে বিজ্ঞানের বই, গবেষণাপত্র মাতৃভাষায় লিখতে হবে- বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সহ। বৈজ্ঞানিক, বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলা (পড়ুন মাতৃভাষা) বিজ্ঞান পরিভাষাগুলো আয়ত্ত্ব করতে হবে। সেটাও সময় সাপেক্ষ, তবে চিকিৎসাবিদ্যার মত এত কঠিন ও জটিল নয়।
সম্পূর্ণরূপে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যা চর্চা করে ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, জাপান ও চীন। এদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই একটি বিষয় এক। এইসব দেশগুলোর মূল ভাষা একটাই। ফরাসী, ডয়েচে, এস্পানিয়েল, জাপানী। চীনের আশি শতাংশের উপরে মানুষ মান্দারিন বলে। ভারতবর্ষের ভাষাগত চরিত্রের থেকে এইসব দেশের ভাষাগত চরিত্র সম্পূর্ণ পৃথক। সেই কারণেই স্বাধীনতার পর থেকেই উত্তর ভারতীয় পেশীর জোরে সারা ভারতের উপর হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা জারি রয়েছে। কিন্তু তামিল ও বাংলার মত আন্তর্জাতিক ভাষা এবং তেলেগু, ওড়িয়া ও মালয়ালমের মত প্রাচীন ভাষাকে মেরে ফেলার এই অপচেষ্টা সফল হবে না।
আর একটা বিষয়। আমি ফলিত বা বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের ছাত্র নই, তাই ওই সব বিষয়ে বলতে পারব না। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে বলতে পারি- জ্ঞানের আন্তর্জাতিক আদানপ্রদান অর্থ্যাৎ বই, গবেষণাপত্র প্রকাশ ও পাঠ করা, আলোচনা চক্রে অংশগ্রহণ, দেশের বাইরে গিয়ে চাকরি, হাতে কলমে শিক্ষা- চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতি ও আধুনিকীকরণের জন্য এসবের প্রয়োজন। আর সেক্ষেত্রে মাতৃভাষায় (পড়ুন হিন্দিতে) চিকিৎসাবিদ্যা চর্চা করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে একঘরে হয়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা।
ফরাসী, এস্পানিওল এবং কিছুটা ডয়েচেও আন্তর্জাতিক ভাষা। অনেকগুলো দেশ এই ভাষায় কথা বলে। যেমন দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার একটা বিরাট অংশ, গোটা মধ্য আমেরিকা এস্প্যানিওল বলে। আফ্রিকার একটা বিরাট অংশ এবং ইন্দোচীন ফরাসী ভাষাভাষী। সুইজারল্যান্ড ও অষ্ট্রিয়া ডয়েচে ভাষায় কথা বলে। এই ভাষা তিনটি নির্দিষ্ট একটা দেশে বা অঞ্চলে আবদ্ধ নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইংরেজীর প্রতিদ্বন্দ্বী। এতদসত্ত্বেও, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, জার্মান ডাক্তাররা ইংরেজী জার্নালগুলোতে তাদের গবেষণা প্রকাশ করতে পারে না এবং ইংরেজীভাষী পাঠককূলের কাছে পৌঁছতে পারে না বলে হতাশায় ভোগে। যদিও ডয়চে ভাষায় বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার আয়োজন স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেটা সাত-আটশো বছরের নিরলস পরিশ্রম এবং গবেষণার ফসল।
ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি হল- ১৪০ কোটি মানুষ, ২৮ টা রাজ্য, রাজ্য স্তরে ২২ টা সরকারি ভাষা, কেন্দ্রীয় স্তরে দুটো সরকারি ভাষা (হিন্দী এবং ইংরেজি) আর সারা দেশ জুড়ে একসাথে কেন্দ্রীয়ভাবে ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষা। এতগুলো মাতৃভাষায় শিক্ষা আর কেন্দ্রীয়ভাবে অভিন্ন চিকিৎসাব্যবস্থা- একসাথে মেলানো যাবে কি করে?
চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে আরো অনেক বিষয় সামনে আসবে। তার মধ্যে অন্যতম হল, মাতৃভাষায় লেখা চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষাগুলো রোগী ও সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে। যে সমস্যা বিশুদ্ধ ও ফলিত বিজ্ঞানের মাতৃভাষাকরণের ক্ষেত্রে থাকে না। কতজন সাধারণ বাঙালি ‘ধমনী’,’স্নায়ুতন্তু’, ‘নিলয়’, ‘অলিন্দ’,’অগ্ন্যাশয়’ বা ‘অনাল গ্রন্থি’ প্রভৃতি বহুল প্রচারিত শব্দগুলোর সাথে পরিচিত সন্দেহ আছে। বাংলায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই লেখা হলে এর থেকে আরো অনেক অপরিচিত ও কঠিন বাংলা পরিভাষা সামনে আসবে। এই বিষয়টা সামলানো যে এক ভীষণ কঠিন পরীক্ষা- সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।