সুন্দরবন। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। গঙ্গা আর পদ্মা নদীর নির্মিয়মান ব- দ্বীপীয় সমভূমি জুড়ে রয়েছে এই আশ্চর্য বনাঞ্চল – দ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগারের রাজকীয় বিচরণ ভূমি। সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের মোট ক্ষেত্রমান ৯৬৩০ বর্গ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৪২৬৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল– যা ইউনেস্কো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট । সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে থাকা এলাকা জুড়ে রয়েছে বসতি এলাকা । মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪৫ লক্ষের মতো । বাঘ, হরিণ , বন্য শূকর, মেছো বিড়াল সহ এই বনাঞ্চলে ,সুন্দরবন এলাকায় বসবাস করে প্রায় ১৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, কমবেশি ৩০০ প্রজাতির পাখি, ১৭ প্রজাতির সরীসৃপ যাদের মধ্যে কুমীর অন্যতম। তবে আমাদের আজকের এই নিবন্ধ সুন্দরবনের বিচিত্র বন্য প্রাণীদের নিয়ে নয়। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছে এই বাদাবনের মানুষ, তাঁদের জীবন ও জীবিকার কিছু সমস্যা এবং সংকট নিয়ে।সুন্দরবন আমাদের এই রাজ্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জীবপরিমণ্ডল তথা বাস্তুতন্ত্রের অংশ। অসংখ্য নদী ও তাদের খাঁড়ি দ্বারা বিচ্ছিন্ন এই অঞ্চলের পরিবেশগত সমস্যাও মোটেই কম নয় বরং তাদের চরিত্র সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র । বঙ্গোপসাগরের কোল ছুঁয়ে থাকা সুন্দরবন এলাকার নদীগুলো হলো জোয়ার ভাঁটার পরশ ধন্য। জোয়ারের সময় সমুদ্রের নোনা জল খাঁড়ি পথ বেয়ে উজানে অনেকটা পথ পাড়ি দেয় আবার ভাঁটার টানে জল নেবে যাবার সময় রেখে যায় কর্দমাক্ত পলির আস্তরণ । এই অঞ্চলের মানুষ প্রধানত কৃষিজীবী। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই অঞ্চলের কৃষি যোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৩. ১০ লক্ষ হেক্টর। পরিবেশগত সীমাবদ্ধতার দরুণ অধিকাংশ জমিই একফসলি। সেচের ব্যবস্থা মোটেই পর্যাপ্ত নয় ; ফলে বর্ষার জলকে কাজে লাগিয়ে খরিফ মরশুমেই প্রধানত দেশি প্রজাতির ধানের চাষ করা হয় এখানে। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে , আর এখানেই নিহিত রয়েছে নতুন সমস্যার বীজ , যা আমাদের এই নিবন্ধের আলোচ্য। সবমিলিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পরিবেশগত সমস্যা এবং পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার কারণে সুন্দরবন এখনও রাজ্যের একটি সমস্যাসঙ্কুল এলাকা।
সুন্দরবনে পানীয় জলের জোগানে ঘাটতি রয়েছে। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে আগামী দিনে এই অঞ্চলের মানুষ ও অন্যান্য প্রানীরা পানীয় জলের অভাবে গভীর সংকটের সম্মুখীন হবে। এক সমীক্ষার ফলাফল সূত্রে জানা গেছে যে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৈধ এবং অবৈধ উপায়ে অতিরিক্ত পরিমাণে ভৌমজল উত্তোলনের ফলে সুন্দরবন এলাকার ভৌম জলস্তর বিপদজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জয়গোপালপুর গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র এবং ডেনমার্কের একাধিক বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান গত এক দশক ধরে যৌথ উদ্যোগে সমীক্ষা চালিয়ে এমনই পরিণতির আভাস পেয়েছে।
সমীক্ষক দলের রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত এক দশকে বাসন্তী ব্লকের ভৌম জলস্তর বছর প্রতি ১- ২ মিটার হারে নেমে গেছে। খড়গপুর আই আই টির বিজ্ঞানীদের মতে এই প্রবণতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তাঁদের মতে সুন্দরবন অঞ্চলে প্রায় ফি-বছর পর্যায়ক্রমিকভাবে ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের কারণে এই এলাকার জলস্তর ক্রমশই ব্যবহার অনুপযোগী লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে এই ব- দ্বীপের বিস্তির্ণ অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বারংবার ঘটেছে। এইসব ধারাবাহিক দুর্যোগের ফলে সুন্দরবন এলাকার মানুষের জীবন যাপনের ছন্দ যেমন কেটেছে, তেমনই বেড়েছে নোনা সমুদ্র জলের আগ্রাসন। সেই জল মাটির ফাঁকফোকর চুইয়ে ভূমির গভীরে পৌঁছে যাচ্ছে। এরফলে ভৌম জলস্তরে লবণের পরিমাণ ক্রমশই বাড়ছে। কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় জলের চাহিদা মেটাতে যথেচ্ছভাবে মাটির তলা থেকে জল তুলে বিক্রি করা হচ্ছে উচ্চমূল্যে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় কৃষকরা এই জল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন, স্থানীয় মানুষ পান করার জন্য জল পাচ্ছেন না। এই আত্মনাশী কাজের ফলে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার্য টিউবওয়েলগুলো সব অকার্যকর হয়ে পড়ে গরমের সময় পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। গত ২২ মার্চ, আন্তর্জাতিক জল দিবসের দিনে বাসন্তী ব্লকের প্রায় শ পাঁচেক মানুষ, যাঁদের সিংহভাগই হলেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর মহিলা সদস্যা, পথে নেমেছিলেন এমন অন্যায়ভাবে জল তুলে নেবার প্রতিবাদে। রাজ্যের সেচমন্ত্রী ডাঃ মানস ভুঁইয়া এই সমস্যার বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছেন এবং আশ্বাস দিয়েছেন এই বিষয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের। এখন অপেক্ষায় থাকতে হবে।
মাটির নিচের জল নিয়ে বাসন্তী ব্লকের সমস্যা একান্তই ওই ব্লকের সমস্যা নয়, দিনে দিনে গোটা সুন্দরবন এলাকার মানুষের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।২০১৪ সাল থেকে এই সমস্যা নিয়ে এলাকার ৬ টি ব্লকের ১২ টি পঞ্চায়েতে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, এই এলাকার ৭০% টিউবওয়েল গ্রীষ্মের সময় শুকিয়ে যায়, সেখান থেকে সামান্য পরিমাণেও জল মেলেনা। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জলস্তরের এমন অবনমন ঘটেছে প্রায় ৯ মিটারের কাছাকাছি।
জয়গোপালপুর গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের সম্পাদক বিশ্বজিৎ মহাকুর , যিনি এই অঞ্চলের ভৌমজলের ওঠানামা নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে অনুসন্ধানের কাজ করে চলেছেন, তাঁর মতে এই অঞ্চলে ভরা জোয়ার এবং মরা জোয়ারের সময় জলস্তরের উন্নতি ঘটেছে লক্ষণীয়ভাবে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর জমে থাকা বরফ স্তরের গলন এবং তার জেরে সমুদ্রের জল তলের উত্থান এর পেছনে দায়ী বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সুন্দরবন হয়তো নিশ্চিতভাবে এই অবাঞ্চিত পরিবর্তনের শিকার হতে চলেছে। বোরো কৃষি মরশুমেই জলস্তরের পতনের হার সর্বাধিক। এই সময় ধান চাষের জন্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাটির নিচে সঞ্চিত ভৌম জল সেচের জন্য কাজে লাগানো হয় , ফলে জলস্তরের পতনের হার হয় সর্বাধিক। মোট উত্তোলিত জলের ৭০% কৃষির প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহার করা হয়। অবশিষ্ট ৩০% জলের চাহিদা মেটাতে নল বাহিত জল, ছাদের উপর ধরে রাখা বৃষ্টির জল আর টিউবওয়েলই ভরসা। ধান একটি আর্দ্র ফসল। ধান চাষের জন্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাটির তলা থেকে জল তুলে আনার অভ্যাস না বদলালে আগামী দিনে গোটা সুন্দরবন জুড়েই আরও বাড়বে মিঠা জলের হাহাকার।
জলের জোগানে টানাটানির সমস্যা গোটা দুনিয়া জুড়েই এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । অদূর ভবিষ্যতে এই হাহাকার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউই জানেনা। জলের মতো প্রাণদায়ী প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার যত শূন্য হবে, ততই বাড়বে জল নিয়ে একশ্রেণির মানুষের দাদাগিরি। সুন্দরবনে এমন জল মাফিয়াদের দাপট বাড়ছে। নিজের জমিতে শ্যালো পাম্প মেশিনের সাহায্যে জল তুলে এনে তা চড়া দামে বোরো ধানের চাষীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে যার অর্থমূল্য বার্ষিক ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা। এক বাসন্তী ব্লকেই গবগবিয়ে মাটির তলা থেকে প্রতিদিন ২৮ মিলিয়ন লিটার জল তুলে আনছে ৭৮৩ টি সাবমার্সিবল পাম্প। এই জলের প্রায় সবটাই বোরো ধানের চাষের কাজে ব্যবহার করা হয়। এই প্রবণতা কেবল সুন্দরবন অঞ্চলে সীমাবদ্ধ তা মোটেই নয়, গোটা দেশ জুড়েই চলছে এমন আত্মঘাতী ব্যবস্থা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, সরকারি আধিকারিক, বিদ্যুৎ দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আর স্থানীয় দাদা – এই দুষ্ট চতুষ্টয়ের অশুভ আঁতাতের ফলে লুট হয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ ভৌমজল যা প্রকৃতি সঞ্চয় করেছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। মাটির গভীর থেকে গভীরতর অংশে পৌঁছে গিয়ে শ্যালো পাম্প তুলে আনছে জল, নামছে জলস্তর, অকেজো হয়ে পড়ছে বিপুল সংখ্যক টিউবওয়েল, গৃহস্থালি প্রয়োজন মেটাতেই যাদের স্থাপনা।মানুষের ভবিষ্যৎ মানুষ নিজেই তৈরি করে। বদলে যাওয়া জলবায়ুর বিরূপতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যার চাপ, খাদ্যের জোগানে অনিশ্চয়তা, রুটিপ রুজির টানাটানি, বেড়ে চলা দারিদ্র্য – সবকিছুরই গভীর প্রভাব পড়ছে আমাদের পরিবেশ ভাবনার ওপর। আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের দ্রুত অবক্ষয় এই সময়ের চেনা সমস্যাগুলোকেও কেমন যেন অচেনা করে তুলছে। নিজেদের টিকে থাকার লড়াই যত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ততই যেন পরিবেশ মানের অবনমন হচ্ছে দ্রুত লয়ে। কীভাবে এই শূন্যতাকে পূরণ করা সম্ভব হবে তার উত্তর খুঁজতে হবে সকলকেই। হয়তো এই প্রতিবেদন সেই আকুতিকে উসকে দেবে খানিকটা। মনে রাখতে হবে,আজ না হয় কাল আমাদের সকলকেই কিন্তু ঐ ডুবন্ত নৌকার সওয়ারি হতে হবে।সাধু সাবধান ।
তথ্য সূত্র:
ডাউন টু আর্থ পত্রিকা।
ছবির জন্য প্রচলিত উৎসগুলোর কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
মার্চ ৩০, ২০২৫
এত মানুষ হলে আর করবেটা কি? দুষ্টু চতুষট্ট এর ফলে জলের টাকাটা ব্যক্তিগত পকেটে যাচ্ছে ।কিন্তু এত লোকের খাদ্য যোগাতে জল তো তুলতে দিতে হবে।নজরদারি থাকলে হয়তো টাকাটা সরকারের ওখানে যাবে। সে একটা ভিন্ন সমস্যা। তাতে জল সমস্যা তো মিটবে না। পাঞ্জাব হরিয়ানাতে জল স্তরের অবস্থা আরো খারাপ। কিন্তু তারা কিছুতেই ক্রপ রোটেশন করবে না ।বরং ধান গমের এম এস পি যাতে বেশি হয় তার জন্য আন্দোলন করবে।আমরা সমর্থন করব ।এসব চলতেই থাকবে। গ্যালন গ্যালন কোল্ড ড্রিঙ্কস বিক্রি হবে। আপনি লিখবেন, আমি পড়বো । সরকার বলবে দেখছি। কাজটা চলতেই থাকবে।
একদম ঠিক কথা বলেছেন – এতো মানুষ হলে আর করবেটা কী ? জনসংখ্যার প্রবল চাপ সামাল দিতে গিয়ে আমরা সবাই আজ বেসামাল। সমুদ্র জলের উচ্চতা যে ভাবে বেড়ে চলেছে তাতে আগামী দিনে গোটা সুন্দরবন এলাকা জলের তলায় তলিয়ে যেতে পারে। মানুষের তো তর সয়না। তাই তরাসে তরাসে বাঁচতে ভালোবাসে।
Everything is getting depleted because of recklessness in the present world… and thats so sad…
We need to be very careful while depleting earth resources. Awaken the people around you.
It’s a terrible situation! Seen the same thing happening in Punjab as well. Draining of water resources needs to be strictly prohibited to avoid turning this area into a lifeless desert !
It’s a pity that the regions with shortages are being over exploited.It is certainly a matter of great grievance. We must look forward for sustainable life style, otherwise we will have to welcome our end.
Thanks for your supportive comment.