এটা ভবিষ্যতের রোগ
অনিন্দ্যপ্রতিম। ছোটো করে’ ডাকলে অনিন্দ্য। আপাততঃ বহুজাতিক মস্তো বড়ো কোম্পানিতে কাজ করে শহরের এক অভিজাত পাড়ায় ছোটো একটা এক কামরার ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে। খাওয়া অফিস ক্যান্টিন থেকে বা ইন্টারনেটে অর্ডার দিয়ে টুকটাক। যা হোক কিছু। বাড়ি মালদার এক অখ্যাত গ্রামে। কী অদ্ভুত বৈচিত্র্য! ওখানে কাদামাখা রাস্তায় বর্ষায় ব্যাঙ ডাকে-মাঝরাতে দূরে প্যাঁচা ক্ররররর করে-পিপুল গাছে গাদাগাদি করা বকেদের একটা শিশুর বিকৃত কান্নার মতো গুঙিয়ে ওঠে।
আর এখানে? মাঝরাতেও তীব্র হর্ন বাজিয়ে গাড়ি বা হৃৎস্পন্দন বন্ধ করা দুচাকার আকাশ ফাটানো শব্দ। ওখানে ভোর যখন হয় তখন আকাশের একটা কোণায় আলো ফোটে আর একটু একটু করে’ গাছের পাতারা গাঢ় কালো থেকে সবুজ হয়-এখানে রাস্তার হ্যালোজেন নিভে গেলে তবেই বোঝা যায় অন্য আলো ফুটেছে।
একটু আগেই প্রজেক্টের কাজ শেষ করে’ অনিন্দ্য মা’কে ফোন করলো। বাবা এ সময়ে হাঁটতে বেরোয়।দুচারটে কথা বলে’-খুব নিয়মমাফিক কিছু কথা- নিত্যকার কথা-শেষ করে’ শু’তে গেলো। জ্ঝাঃ, নতুন কোম্পানিতে জয়েন করার কথাটা বলা হয়নি। আজ শনিবার (নাকি রবিবারের সকাল?) আগামী সোমবার জয়েনিং। প্যাকেজটা অনেক বেশী। প্রায় মাসে এক লাখ। তবে বিদেশী কোম্পানি। কড়াক্কড়ি অনেক বেশী। থাক-মা বাবা আবার চিন্তা করবে। পুরোনো দিনের মানুষ। চাকরি ছাড়া, নতুন চাকরি করা-এগুলোতে ঠিক মানিয়ে নিতে পারবে না।
** ** **
অনিন্দ্য আরও দুটো চাকরি ছেড়েছে। নতুন দুটো চাকরি নিয়েছে। অনেক বেশী মাইনে বেড়েছে।কিন্তু এই কোম্পানির কাজের চাপের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। নিয়মিত রাত্রিজাগরণ, ইন্টারনেটে মিটিংয়ের পর মিটিং…. মাথা আর এই চাপ নিতে পারছে না। বয়স হয়েছে তেত্রিশ।পঞ্জিকা ঠিক ঠাক মেনে। কিন্তু অনিন্দ্য বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কাজে পাল্লা দিয়ে প্রজেক্ট শেষ করতে পারছে না। মনে হচ্ছে ওদের বুদ্ধি, কাজের ক্ষমতা অনিন্দ্যর থেকে বেশী। ক্রমশঃ নিকট সহকর্মীদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে। এই জগতটায় সহকর্মীরাই বন্ধু, সহকর্মীরাই প্রতিদ্বন্দ্বী। বাবা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ফোনে মিসড কল দেখায়। পরে কাজের চাপে ভুলে যায়। ফোন করলেই তো সেই “বাবা এবার একটা বিয়ে কর….আর কতোদিন একা থাকবি…..এবার আমাদেরও তো নাতিপুতির শখ হয়?”
অনিন্দ্যর বান্ধবী ওকে ছেড়ে আরও দূর শহরে পাহাড় টপকে টপকে চূড়ায় ওঠার লড়াই করছে। বিয়ে? হুঃ। ওই ঝামেলায় কে জড়াবে? সন্তান? সময় কোথায়? তাতে আরও বেশী সময় লাগে। সত্যি বলতে আর কাজেও উৎসাহ পাচ্ছে না। ও জানে বাকিরা ওর থেকে বেশী কর্মক্ষম। ক্রমশঃ ক্রমশঃ….পে স্কেলের ওপর দিকে ওঠা বন্ধ হয়েছে।
আগে বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে খেতে যেতো। ওরা ওপরে ওঠার পরে-ওদের পে স্কেল আলাদা হয়ে যাওয়ার পর….আর ভালো লাগে না।এখন কেবলমাত্র ফোন করে’ খাবার আনানো। বর্ষা, শীত, গ্রীষ্মের ভেদ নেই। বাতানুকুল যন্ত্রে এখন ঋতু লেখা থাকে।জানালার কাচে কুয়াশা লেগে থাকে কি? অনিন্দ্য জানে না। মালদহের গ্রামের ঘাসে যে শিশিরবিন্দু হীরের টুকরো হয়ে জ্বলতে থাকে আর এক প্রৌঢ় লাঠি হাতে প্রাতঃ ভ্রমণে যায় সে সেই শিশির মাড়ায়। যে প্রৌঢ়া শিশির ভেজা শিউলি কুড়োয় সেও জানে। তারা একটা ফোনের অপেক্ষা করে।
অনিন্দ্য কর্পোরেটদের চাপ নিতে আর পারে নি। এখন ফ্রি ল্যান্সিং করছে। সব যোগাযোগ ছিন্ন। ঘর থেকে বিশেষ বেরোয় না। হয়তো দুমাসে একবার বাড়িতে ফোন করে। এখন আর পিৎজা, হ্যামবার্গার খেতে আর ভালো লাগে না। তাই ঘরে পাঁউরুটি জমানো আছে। কফি আছে।আছে বিদেশী বিস্কুট। ডার্ক চকলেট। আছে নিজে কাজ করে’ বেশী টাকা পাওয়া। অথবা ধীরে ধীরে সব কাজ ছেড়ে ঘরে বসে থাকা।না অ্যাগারোফোবিয়া নয়। এটা নিজের ভেতরে নিজের আবরণ তৈরি করে’ অন্ধকার থেকে অন্ধকারে যাওয়া। এক সময় খাবার হয়তো ফুরিয়ে যাবে। হয়তো ব্যাঙ্কে কিছু টাকা থাকবে অথবা থাকবে না। অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা অনিন্দ্য বলে কেউ আছে ভুলে যাবে।
** **
হয়তো একদিন রাস্তা দিয়ে মুরগির মাংস বোঝাই গাড়ি চলে’ যাবে। নিচের দোকানের মুদি তার বৌকে বলবে
“আজ বোধহয় মাংসের গাড়িতে পচা মাংস ছিলো গো….কী গন্ধ ছাড়ছে!”
তারপর হয়তো পুলিশ আসবে। দরজা ভেঙে মিশরের মমির মতো শুকিয়ে যাওয়া অনিন্দ্যকে নিয়ে যাবে।