ইঁদুর সম্প্রতি বিভুর জীবনে বিভীষিকা হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। একটা দুটো নয়, শ’য়ে শ’য়ে। কে জানে সংখ্যাটা কোটি কোটিও হতে পারে।
ইঁদুর, তার এই ভদ্রাশ্রমে হানা দিচ্ছে। রোজ। বিস্কুট চিঁড়ে ভাজার প্যাকেট, কোনও দিন আলু, আবার অন্যদিন আপেল কলা মূলো সব এঁটো করে দিচ্ছে এই ব্লিৎজ ক্রিগ ধ্বংস বাহিনী।
এমনিতে বিভু মানুষ হিসেবে তত হিংস্র নয়। বস্তুত তাকে পরিবেশ প্রেমীও ভাবা যেতে পারে। সে বিশ্বাস করে,
“এই পৃথিবীর যাহা সম্বল,
বাসে ভরা ফুল রসে ভরা ফল,
সকলের এতে সম অধিকার, এই তাঁর ফরমান”।
আর সেই হিসেবে ইঁদুর সাপ ব্যাং সবাইয়েরই অধিকার আছে এই তৃতীয় গ্রহে বসবাসের, বিভু এটা দীর্ঘদিন বিশ্বাস করেছে। কিন্তু সম্প্রতি সেই বিশ্বাসটা রীতিমতো টলে গেছে তার।
বিভুর বাড়ি রেলওয়ে সাইডিংএর পাশে। সেখানে ভিন জায়গা থেকে আসা লম্বা মালগাড়ি এসে দাঁড়ায়। মাল খালাস করে চলে যায়।
বস্তুত এই সাইডিং নিয়ে তার মনে দীর্ঘদিন এক উচ্চাশা ছিল। অবশ্যি সেটা কিশোরবেলায়।
তখন ওয়াগন ব্রেকিং খুব চালু পেশা ছিল। ঝুঁকিবহুল যদিও। দেশবন্ধু ইশকুলে ক্লাস সেভেনে অঙ্কে সাড়ে সাত পাবার পর হেডস্যার ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। – শোন বাবা, তুই আর এ চত্বরে ঘোরাঘুরি করিস না। বরং সিনেমা হলের ব্ল্যাকার বা ওয়াগনব্রেকিংয়ে নেমে যা।
– না, মানে স্যার, আমার নম্বর আর এট্টু বাড়ত। তারকবাবু স্যার আমাকে দেখতে পারেন না বলে…
– ঠিকই, তোকে একা একা দেখা সম্ভব নয়। তাই তোর অঙ্ক খাতাটা আমার কাছে দেখতে পাঠিয়েছিল তারক। খাতাটা দপ্তরিবাবুকে যত্ন করে রেখে দিতে বলেছি। যদ্দিন চাকরিতে আছি, প্রতি বছর ক্লাস সেভেনের ছাত্রদের দেখাব। উদাহরণ হিসেবে।
– না, মানে…
– আবার না মানে? কোনও সরল অঙ্কের উত্তর যে ঊনসত্তর পূর্ণ তিনশ তেয়াত্তরের পাঁচশ ছাব্বিশ হতে পারে জীবনে ভাবিনি। তাও তো তারক সাড়ে সাত দিয়েছে। আমি হলে নেগেটিভ নম্বর দিতাম। ভাবছি কেশব বাবুকে নতুন একটা চ্যাপ্টার ঢোকাতে চিঠি দেব। চ্যাপ্টারের নাম হবে সরলের বদলে জটিল।
হেডুটা বহুত বাওয়াল করছে তো, মনে মনে ভেবেছিল বিভু। কিন্তু ওয়াগন ব্রেকারের আইডিয়াটা হেব্বি দিয়েছে। প্লেস অফ পোস্টিং, মানে কাজের জায়গাও বাড়ির পাশেই সাইডিংএ। যাতায়াতের ঝামেলা নেই।
কপাল এমন, ব্ল্যাকার আর ওয়াগনব্রেকিং দুটো পেশাই অবলুপ্ত হয়ে গেল। ওয়াগন ব্রেকাররা সব এমএলএ এমপি মন্ত্রী হয়ে গেল আর ব্ল্যাকাররা সিন্ডিকেটের দাদা। চাল-চাকরি-ত্রিপল-বালি-কয়লা-পাথর-গোরুর বিলিব্যবস্থা করার ইয়ে।
মনের গতিবিধি বোঝা ভার। হচ্ছিল সাইডিংএর কথা। কত পুরোনো সুখদুঃখের স্বপ্ন মনে পড়ে গেল। তার এই এক দোষ। রোগও বলা যায়।
এই মনের চঞ্চলতা। কিছুই একমনে ভাবতে পারে না। তলিয়ে দেখে না। এমনকি প্রেসক্রিপশন অবধি। বাবার অসুখের সময় হারু আর ন্যাপাকে বলেকয়ে দু’বেলার জন্য হায়ার করে এনেছিল। কী ব্যাপার? না, তিন নম্বর ওষুধটায় লেখা ঝাঁকিয়ে খাওয়ান। বাঃ রে, বাবাকে ঝাঁকাতে হবে না?
অঙ্কতেও তার স্পষ্ট মনে আছে সেই অমনোযোগের কাণ্ডটা ঘটেছিল। বাবাইদা’র একটা চিঠি পৌছোতে গিয়ে৷ ইন্টুমিন্টুর চিঠি। বাবাইদা’ই বলেছিল। হেব্বি গরম ভাষায় লেখা। দেবার কথা অশোক কলোনির পলিকে। ঠিক মত না শুনে বিভু গুঁজে দিয়েছিল তারক মাস্টারের মেয়ে মলির হাতে। কেলেঙ্কারির একশেষ। তারপর থেকেই তারক মাস্টার খাপ্পা।
অবশ্য অঙ্কের ওপর দিয়ে গেছে বলে অল্পে রক্ষা। পলির দাদা যে বেঁটে কালু পরে জেনেছিল বিভু। ওর হাতে পড়লে বেদম কেলিয়ে পাটপাট করে দিত সিয়োর। ভেবে এই বয়সেও শিউরে উঠল সে।
ওঃ, আবারও মন সাইডিং থেকে বেরিয়ে অন্য কথা ভাবছে । সকাল থেকে উপোসে থাকা উদাস বিভুর বিশ্বাস ওই সাইডিংয়ে আসা একটা গম বোঝাই মালগাড়িতে এক কোটি পরিযায়ী ইঁদুর চালান এসেছে। আর তারাই এসে হাজির তার বাড়িতে। দল বেঁধে।
শুধু খাবার দাবার নষ্ট করছে তা নয়। কাপড়চোপড় বইকাগজ দলিলদস্তাবেজ যা পাচ্ছে হাতের কাছে মানে… দাঁতের কাছে, তছনছ করে দিচ্ছে।
বিভু এখন কোভিডের দৌলতে বাড়িতে বসে সারাদিন অনলাইনে কাজ করে। ইঁদুরেরা সারা রাত্তির খুটখাট, দুড়ুম ঝনঝন চালিয়ে যাচ্ছে। ঘুম হচ্ছে না। উৎপাতে মন উচাটন থাকায় অনলাইন কাজে সিরিয়াস ভুল কিছু ঘটে যাচ্ছে।
গত সপ্তাহেই একটা ভয় দেখানো ইমেইল খেয়েছে প্রোজেক্ট হেডের কাছ থেকে। যদি অনলাইনে কয়েকটা ইঁদুরকে জিমেইলে ঢুকিয়ে ওই প্রোজেক্ট লিডারের চিঠিটাকে কুচি কুচি করে ফেলা যেত। সেটি হবার নয়। বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ রচনায় এই পয়েন্টটা সেই ইশকুলবেলায় দেওয়া যায়নি বলে বিভুর অল্প আফসোস হচ্ছিল।
তো এই ইঁদুরদের শায়েস্তা করতে অবশেষে ইঁদুর মারা বিষ কিনল সে। না, ওই হাটে বাজারে ঘুরে বেড়ানো ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে সস্তা মার্কা বস্তু নয়। রীতিমতো কর্পোরেট কোম্পানির মাল। প্রচুর দাম। দিলেই সিওর সাকসেস, মায়া প্রকাশনীর বিজ্ঞাপনের মত। সঙ্গে আবার প্রেসক্রিপশনের মত ব্যবহার বিধি আর গ্যারান্টি কার্ড।
হাঃ, ইঁদুরের বিষের আবার ব্যবহার বিধি! ধনে পাতার ক্যাশমেমো! বিভু ওসবে পাত্তা না দিয়ে ইঁদুর মারা বিষ ঘরের এ কোণায় সে কোণায় দিয়ে রাখল।
পরের দিন মনে ব্যাপক শান্তি। যাক, সব বিষই উধাও। খেয়েছে।
কিন্তু কোথায় কী। রাত হতেই সেই খুটখাট আর ধ্বংস যজ্ঞ। এ বারে যেন দ্বিগুণ উদ্যমে। আশাভঙ্গের যাতনায় কি মনে হল এ’ রকম?
আবার বিষ দিল।
পরের দিনের চিত্র আরও ভয়াবহ। বিভুর ওষুধের কৌটো অবধি আক্রান্ত। অন্য গ্যাস অম্বলের ট্যাবলেট অ্যান্টাসিড তো বটেই ভিটামিন ডি ক্যাপসুলগুলি অবধি নিঃশেষ করে খেয়ে গেছে। পাড়ার ডাক্তার কাজ হবে না জেনেও কেন যে একগাদা দামি ভিটামিন লেখে কে জানে!
ক্রুদ্ধ বিভু গ্যারান্টি কার্ড নিয়ে বিষের দোকানে গেল। মহিলা ম্যানেজারের ব্যবহারটি ভারি ভালো। পুরো সমস্যাটা শুনে সামনের ল্যাপটপে কী সব খুটুরখাটুর করলেন কিছুক্ষণ। মিষ্টি হেসে তারপরে বললেন, – ডিরেকশনে যে ভাবে দিতে বলা হয়েছিল সেই ভাবে দিয়েছিলেন?
– আরে, র্যাট কিলারের আবার দেবার ডিরেকশন লাগে নাকি? ওই কাগজ আমি ছুঁয়েও দেখিনি।
– ওইটিই তো ভুল করেছেন। গ্যারান্টি কার্ডের আর ভ্যালিডিটিই রইল না!
– মানে?
– ইসস্! বললেন হতাশ ম্যানেজার।
– আপনি যদি ওই ছোট ছোট অক্ষরের কাগজটা পড়ে দেখতেন! স্পষ্ট লেখা আছে, বিষের সঙ্গে ভিটামিন ডি দিলে তবেই এ বিষ কাজ করবে।
– কী বললেন? ভিটামিন ডি? সেও তো ওই হতচ্ছারারা… বিভু মাথামুণ্ডু না বুঝে বেকুবের মত বেরিয়ে এলো।
সেদিন রাত্রে কিন্তু বড় নিশ্চিন্তে ঘুম হল বিভুর। ইঁদুরেরা উধাও।
কে বলে, ভিটামিনে কাজ হয় না।
★
ডিসক্লেলেইমারঃ-
ভিটামিন ডি বলেছি, ভিটামিন ইডি বলিনি।