আমার স্কুলে একটি ভীষণ দুর্দান্ত আর ভীষণ মিষ্টি বাচ্চার গল্প বলি আজ| ডাক্তারি পরিভাষায় সে হলো ডাউন সিনড্রোম ও intellectually challenged বাচ্চা| ভাবগতিক দেখে অবশ্য ধরার উপায় নেই তার অক্ষমতাটুকু| দিদিমনিদের সামান্য মাথার ব্যথায় উতলা হয়ে পড়ে সে| তাড়াতাড়ি ছোট্ট ছোট্ট হাতে নিজের এবং তিন দিদিমনির জন্য তিনটি, মোট চারটি কাপ প্লেট ধুয়ে ফেলে| ভালো করে হাতে পায় না| তবু পড়ার টুল টেনে নিয়ে, তার ওপর দাঁড়িয়ে পেড়ে ফেলে দুধ চিনির কৌটো| চামচে বাজিয়ে বাজিয়ে চিনি গোলে চায়ে| যদি ঠাট্টা করে ছাঁকনি দিয়ে চিনি গুলতে যাই ,রসগোল্লা চোখ আরো গোল তেড়ে আসবে| চোখ দিয়েই বলবে — চায়ে চিনি গুলতে হয় চামচ দিয়ে|
সবার চা খাওয়া শেষ হলে, দরজার আড়ালে লুকিয়ে অধ্যক্ষের কাপে অল্প একটু চা খাবে| ওতেই তার যত মজা| খাওয়া শেষে নিজের চায়ের কাপটি আবার জলে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করবে| কেন জানি মনে হয় ,সে ধুয়ে দেয়ার পর কাপটির শ্বেতভাব আরো শুভ্র হয়| হয়ত আমার মনের ভুল|
তার ওই পাহাড়ি নদের মত বয়ে যাওয়াটা কী যে টান টানে আমায়| সবসময় ছটফট করছে| দৌড়োচ্ছে| দৌড়ে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে| বগলের তলা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিচ্ছে| আদর খেয়ে শান্ত হচ্ছে| শান্ত হয়েই ফের দৌড়োচ্ছে| আর কী যে মানুষকে নিজের করে নিতে পারে ,কী বলব আপনাদের|সেদিন পড়াচ্ছি ,ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আমাদের লাভলী পাশের বাড়ির কোনো এক বউয়ের বিছানার উপর বসে| তাদের জানলা দিয়ে টা টা করছে স্কুলের দিদিমনিদের| ও হ্যাঁ ,বলে রাখি আমাদের এই শিশুনদীটির নাম দিয়েছি লাভলী|
স্পোর্টসের দিন আকাশে অনেকখানি রোদ উঠল| পাখি উড়ল| তাইনা দেখে আকাশমুখে আঙ্গুল তুলে লাভলীর সে কী লাফ! স্পোর্টস প্র্যাকটিস চলছিল — কাউকে স্পোর্টস করতে দেবে না লাভলী| সবাইকে তার সাথে পাখি দেখতে হবে ও বড় বড় লাফ মারতে হবে| রেগে গিয়ে অধ্যক্ষ তাকে বসিয়ে দিলেন স্কুলপাড়ার একটি বাড়ির থামে|
লাভলী অচেনা থামটির সাথেও বন্ধুত্ব করে নিলো| দেখি থামে বসে পা দোলাচ্ছে আর বিড়বিড় করে কী বলছে| কাছে গিয়ে শুনি থামটাকে বলছে —” দেখিস আমায় যেন ফেলে দিস না| আমি তো দুষ্ট| তাই তোর ওপর আমায় বসিয়ে রেখেছে| ”
লাভলীর আপন করার মোহে পড়েছে থামে গজানো উটকো লতাপাতা| সবুজ পাতা জড়িয়ে ধরেছে আমার লাভলীকে| আমার লাভলী — যেন তবকে মোড়া রঙিন মেঠাই গো !
—-অনুদান নয়| ক্লাসে ঢুকিয়ে বিনে পড়ায় এইট অব্দি পাশও নয়| ঠিকঠাক প্রশিক্ষণ চাই আমার লাভলীর —-যেখানে ব্যর্থতার যন্ত্রণা থাকবে –কষ্ট করে এবং নিজের ক্ষমতামত পড়ে পাশ দেয়ার আনন্দ থাকবে| হরষে বেদনায় একটি differently abled বাচ্চাও হয়ে উঠবে পূর্ণ মানব ! দিতে পারবেন ?
দিতে পারবেন ঘরবন্দি দশায় প্রত্যেক পাড়ার পার্কটি অন্তত কিছু সময় এই ধরণের শিশুর জন্য নির্দিষ্ট করতে ? —- যাতে সে বোঝে স্কুলটা তার কিছুদিন বন্ধ থাকলেও প্রকৃতি আর আকাশ তার সাথেই আছে ! বুটিকমেলায় কিংবা ” চিজ বড়ি হ্যায় এর মস্ত মস্ত মেলায় তো পা চেপে স্যানিটাইজার বার করছি নায়াগ্রার মত| এদের নাহয় ছোট ছোট দুহাতে মাখার মত একটুখানি দেবেন ! ( পার্কে ঢোকা বেরোনোর সময় )
যে শিশু একটা অচেনা বাড়ির থামকে মানুষ ভেবে কথা বলে সেই তো পারে আকাশের অস্তমিত সূর্যের সাথে প্রাণের কাহিনি গড়তে| কারণ ? কারণ —এরা differently abled| কল্পনার ঘোড়াটাকে দ্রুতগামী করতে সেই তো পারবে! আপনাদের অনলাইন তাকে তৃপ্ত করতে পারবে কিনা ভাববেন একটু! যে ব্যবস্থায় একটি স্বাভাবিক শিশুও আজকাল বিরক্ত হয় –বেচাল হয়ে খোঁজে কোনো লোভের চ্যানেল তা কীভাবে সামঞ্জস্য আনবে differently abled বাচ্চার মননে? নাকি ধরেই নিয়েছেন আপনাদের ওই হিঁদু মুসলমানের প্রেমু ( বানান ভুল করিনি ) কিংবা ঝগড়ুতে যারা কোনোদিন অংশ নিতে পারবে না –বুঝবেই না কোন বিভেদ এলে তবে সম্প্রীতি সেরফ বাক্য হয়ে যায় –তাদের মননই নেই?
পারবেন না পুরপিতারা? পিতা তো —এ সন্তানও তো আপনাদের|
লাভলীর ছবি তুলেছিলাম কোভিডের আগে|কাহিনিও খানিকটা সেসময় লেখা|আজ রাতে মনে হল গল্প আরো বাড়ুক| যা তারা পেতে পারত —সেই না পাওয়ার গল্পটা আরেকটু গাঁথি এইসব শিশুর পাঁজরা দিয়ে দিয়ে| যদি একটু বেঁধে কোনো না কোনো “পিতা”র চর্মে !
রাত হল| চ — আমরা ঘুমই| কোথাও জায়গা না জোটে থাকবি আমার কম্বলে।
আয়! আয়! আয়! আয় লাভলী ।
তোর জন্য সেজেছি কাবুলি
ঝোলায় আছে হাঁতি।
সত্যিই কবে যে আবার লাভলীরা ডিম সূর্য আঁকবে ।সবুজ পাতা, লালটিপ পরে পাখী হবে ।আর শিশুদের মন খারাপ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কোভিড গেলে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে সবুজ রঙের ঘাসে শিশুরা তারা ফুলঝুরি হবে ।গল্প দাদির ঘুম নাই ।গল্পের চরকা কেটে যেতেই হবে