কুঞ্জ দাসি কানে শোনে কম। দৃষ্টিশক্তিও তেমন প্রখর নয়। না হলে তো বাকি সব ঠিক ঠাক আছে। শরীরে তেমন অসুখ বিসুখ বিশেষ নেই। খিদে ঘুম দিব্যি স্বাভাবিক। ছেলে যখন বলল,
— কি করবি বল, আমার তো কিছু করার নেই। তুই নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছিলি। এখন ভোগ।
কুঞ্জ দাসি বুঝতে পারে না তার ছেলে কি বলছে। চাকরি করা ছেলে খারাপ তো কিছু বলবে না। সে নিজে অশিক্ষিত,ক অক্ষর গোমাংস । কিন্তু ছেলে তো দিব্যি একটা দুটো পাশ দিয়ে একটা চাকরি পেয়েছে।
এক দূর আত্মীয়ের মেয়ে এই বৌমা একটু মুখরা তবে খেতে পরতে দেয়। মুখ করে, তবে ঘাড় ধাক্কা তো দেয় না।
বিপত্তি বাধল তখন থেকে যখন বোশেখের ঝড়ে ঘরের একটা চালা উড়ে গিয়ে পড়ল পাশের ক্ষেতে । মাটির বারান্দায় যেখানে কুঞ্জ তার কুঁজো পিঠ আরো বাঁকিয়ে প্রায় ধনূকের মত অর্ধ গোলাকৃতি করে খালি মাদুরে একটা ছেঁড়া কাঁথা গায়ে শুয়ে রাত কাটাত সেটা হয়ে গেল বেবাক ফাঁকা।
কুঞ্জ হাসে আর ঘড় ঘড়ে গলায় বলে, – যা করবি কর। বৌমা তো কত ভাল। গরম ভাত দেয়। নঙ্কা দেয়,কখনও ডাল দেয়।
— হুঁ। তোর চয়েস মা, তুই কি আর খারাপ ঠাওরাবি?
ক’দিন থেকেই কানে আসছিল গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কথা কাটা কাটি। বুড়ি আঢাকা বারান্দায় শুয়ে ফিক ফিক করে হাসে। ভাবে এইটাই তো সংসার। না হয় ছেলের
বাপটা একটু মাতাল গোঁয়ার ছিল। কিন্তু আগলে তো রাখতো। মিনসে টা চলে গেল অকালে।
সকালে গরম ফেনা-ভাত খেয়ে শ্বশুরের দেয়া হিরো সাইকেল নিয়ে ছেলে গঙ্গাধর কাজে বেরনোর আগে বুড়িকে ডেকে বলে দিল, — রেডি হয়ে থাকিস আজ তোকে আশ্রমে দিয়ে আসব।
– কবে আনবি?
– দেখছিস তো ঘরের অবস্থা, থাকবি কোথায় এখেনে? তার থেকে ওখানে থেকে ঝাঁটঝুট দিবি। ওদের গোয়াল আছে, পরিষ্কার করবি। খেতে শুতে দেবে। আর কি চাই? আমি কথা বলে এসিছি?
– তা বলে আর আনবি নে?
আর উত্তর দেয় না গঙ্গাধর। ঘরের চৌকাঠ থেকে বউ হেঁকে বলে, — আমার পান এন,আর এক জোড়া চটি।
ক্রিং ক্রিং ঘন্টি বাজিয়ে সে বেরিয়ে গেল।
বুড়ি কুঞ্জ দাসি উবু হয়ে বসে বৌমার পানে চেয়ে রইল। যদি একটু চা করে দেয়। মুখ ফুটে বলতে তো পারে না।
চা- মুড়ি এল তবে অনেকটা পরে। তখন বুড়ি গভীর চিন্তায়। স্টেশনের ওপাশে হরি মাধবের আশ্রমে অনেক বার গেছে সে। কত বড় জায়গা। জন্মাষ্টমী রাসযাত্রা কত উৎসব হয়। সেখানে অনাথ অনাথিনী কত লোক থাকে। ফ্রি থাকা খাওয়া। মন্দ নয় ব্যবস্থা। তবে শুনেছে অনেক দিন হয়ে গেলে ওখান থেকে কিছু লোককে তারা কাশী বৃন্দাবনে ভিক্ষে করতে পাঠায়। কুঞ্জবুড়ির ওটাই ভয়। আশে পাশে থাকলে তবু আশা থাকে যদি গঙ্গা কখনও ঘরের চাল ঠিক করে মাকে ফেরত নিয়ে আসে। চোখের আড়াল হলে সে কি ফেরত আনবে।
পরনের ময়লা থান কাপড়ের খুঁটে বাঁধা গিঁটটা খুলতে খুলতে নরম সুরে বলে, — ও বৌমা, এই চারটি টাকা নাও। একটু যদি কুচো মাছ পাও। কতদিন খাইনি। আর যদি না খেতি পাই। বোষ্টুমদের আশ্রম বলি কথা।
সে উত্তর দেয় না সে কথার। তবে ঝাঁজ ও দেখায় না। পয়সা কটা যেমন ছিল তেমনি রয়ে যায়। শুধু অনুচ্চারে বলে, — যেমন কর্ম তেমনি ফল ।
কথা বাড়ায় না বুড়ি। এ কথা তো বেঠিক নয়। জীবনে ভালো কর্ম তো কিছু করা হয়নি। শুধু পেটের চিন্তা। জীবনে বেঁচে থাকতে লোকের ক্ষেত খামারি থেকে চুরি চামারিও করতে হয়েছে। লোকের বাড়ির কাজ করতে লাথি ঝাঁটাও খেতে হয়েছে । হয়ত কখন সে উল্টে মুখও করেছে।
দুপুরে এই এক সুখের সময় কুঞ্জবুড়ির। তার বৌমা কলাই করা উঁচু থালায় ভাত বেড়ে দেয়। মনে হয় যেন মা লক্ষ্মী। সিঁথিতে বড় করে সিঁদুর দেয়। বুড়ি তার পানে চেয়ে থাকে। পরের মেয়ে। তবু মনে কত আপনার।
— ও মা,তুইও বস। ওপাশ করে বোস। বাঃ বাঃ মাছ ভাজাও করেছিস। কেন মায়া বাড়াচ্ছিস তুই? আজ বিকেলেই তো বিড়াল পার করে দেবে। তোর বরকে বল না আর কটা দিন পরে পাঠাতে।
– ও সব তোমাদের মা-বেটার কথা আমাকে বল না।
– আজ ডালও করিছিস? ইস কি ভাল যে হয়েছে।
খাওয়ার পরে আবার একটু খোলা ছাউনিহীন বারান্দায় শুয়ে গড়িয়ে নেয় কুঞ্জবুড়ি। তারপর ঘুম থেকে উঠে বাড়ির চারপাশটা একটু ঘুরে নেয়। কি মায়ায় কি জানে তার চোখে জল আসে। একটা কলাগাছে মোচা ধরেছে। বেড়াটা নতুন করে বেঁধেছে ছেলে। জবাগাছে কত কুঁড়ি। পেছনে একটা কলমের আমের চারা ছেলের হাতে পোঁতা। কতটুকুনই বা জায়গা! একটা গেটও বানিয়েছে গঙ্গা ছিটে বেড়া দিয়ে।
কুঞ্জ সামনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। চোখের জ্যোতি কম। ঠাওর করে ঠিক বুঝতে পারে না একটা সাইকেল কি আসছে? ঐ দূরে যেখানে রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে। আজ কি গঙ্গাধর সত্ত্বর ফিরল?
ঠিক তাই। তার গুণধর ছেলে। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলান একটা প্যাকেট।
– ও খোকা এত তাড়াতাড়ি যাবি? একটু চা জল খা।
— সে তুই যাই বলিস। আজকে তোর শেষ দিন।
সে ঝোলা থেকে বার করল একটা শাড়ি, একজোড়া সস্তার চটি আর কলা পাতায় মোড়া এক বান্ডিল পান পাতা। এগুলো তার বউয়ের জন্য।
– নাও গো।
– চা বানাই ?
— বানাও। বেশি দেরি করো না। রেডি হয়ে নাও।
বুড়ির মুখটা একটু উজ্জ্বলই হল। তার পছন্দ করা মেয়ে বলে কথা। কুলাঙ্গার আজ তাকে বিদায় করবে বটে। তা হোক নিজেরা ভালো থাকুক।
শেষ মেশ বেরোল আরও একটা কাগজের মোড়ক করা সামগ্রী।
– নতুন জায়গায় যাবি। দেখ এটা কেমন?
মনে মনে কি আর ইচ্ছে হচ্ছিল না । ছেলে তার কথা মনে করে একটা সাদা শাড়ি এনেছে। বুকটা জুড়িয়ে গেল বুড়ির। তবু মুখে বলল, – আবার এত খরচা করলি?
গুছিয়ে বেরোতে আরো কিছুটা সময় গেল। কুঞ্জ দাসি নতুন শাড়ি পরেছে। মুখটা ম্লান। দুচোখ ছাপিয়ে জল পড়ে গণ্ডদেশ ভিজে গেছে। হাতে একটা বোঁচকা। গঙ্গার বৌ রঙীন জর্জেটের একটা শাড়ি আর নতুন জুতো জোড়া পরেছে। গঙ্গাধরের বাহন রেডি। সে বউকে বসিয়েছে সাইকেলের সামনের রডে। আর দুঃখী মাকে পেছনের ক্যারিয়ারে । পাঁচ ছয় মাইল রাস্তা যেতে হবে । বেড়ার দরজায় একটা দড়ি বেঁধে এসেছে টাইট করে গঙ্গা। ছাগল গরু না ঢুকতে পারে।
– ও খোকা একটু দাঁড়া।
– আবার কি হল তোর?
– তুলসিতলায় একটা পেন্নাম ঠুকে আসি। আর কি ফিরতি পারব? তোর বাপটাও তো ওখানে শুয়েছিল শ্মশানে যাওয়ার আগে।
– যা। দেরি করবি নে। আঁধার হয়ে আসছে।
– আচ্ছা।
শেষবারের মতো তুলসিতলায় একটি সাষ্টাঙ্গপ্রণাম করে চোখের জলে ভিজে বুড়ি মুখ মুছতে মুছতে বাইরে এলো। বিকেলের আলো এখনও মরেনি। কুঁড়ে ঘরটা কেমন রাজপ্রাসাদের মত দাঁড়িয়ে আছে। বিদায় নিল কুঞ্জবুড়ি।
— ধরে থাক, না’লে পড়ে যাবি।
চাষজমি,অনাবাদি পড়ো জমি, চণ্ডী মন্ডপ, রাসতলা, সরু নালার ওপরে পি ডব্লু ডি-র কালভার্ট পেরিয়ে পাকা রাস্তা। যান চলাচল করছে। দূরের বাস, টেম্পো, রিকশা হুস হুস করে আসা যাওয়া করছে।
আর মাত্র তিন চার মাইল গেলে রেল স্টেশনের কাছে আশ্রম। কলকাতার কত ট্রেন ছুঁয়ে যায় অজ গাঁয়ের এই অগোছালো রেলস্টেশনে।
বাগান ঘেরা একটু চেনা জায়গার সামনে এসে গঙ্গা সাইকেল দাঁড় করাল। বুড়ি বুঝতে পারল এটা তার নির্বাসন। তার বুকটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে।
– -এখনও গেট খোলেনি?
— ঠিক খুলবে, দেখছিস না খোল-কর্তাল বাজছে।
বৌমা নিচে নেমে এক পায়ে নেংচে নেংচে সাইকেলের চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে বললে, – পায়ে কি ঝিঁ ঝিঁ ধরেছে, গো। এবার একখান সিট লাগিয়ে নেবা সামনে, বুঝলে ।
– ও বৌমা, তোর মাজায় লাগেনি তো?
বুড়ি ব্যাজার মুখে তার ছানি পড়া চোখে বন্ধ গেটের ওপারে আধো আঁধারে প্রায় চোখে না দেখা যায় এমন কয়েকটা ছায়া ছায়া চালা ঘরের ভিতরের মৃদু আর ঝাপসা আলো দেখতে পেল। তাকিয়েই রইল তার নতুন ঠাঁই এর দিকে। আশ্রিতের মাথা গোঁজার ঠাঁই।
পেছনে গঙ্গা আর তার বউ কি পরামর্শ করে কে জানে ? দুজনে ফিস ফিস করে কি যেন বলছে।
– ও বাপ, আমারে ফিরিয়ে লিয়ে চল।তোদের ছেড়ে আমি কি করে থাকপো রে এখেনে। না হয় গোয়ালটা সারিয়ে দিস আমি ওখেনে থাকপো। আমারে ফেলি দিসনে। তুই আমার পেটের ছাবাল।
– ওসব কথা বলিসনে বুড়ি। আমার অবস্থা খানা বোঝ ?
— তা বলে আমি কি বেড়াল, এভাবে ফেলে দিবি?
— শুনলাম তুই নাকি বউকে ঘুষ দিতেছিলি ? তোর আঁচলে বাঁধা টাকা থেকে। কই আমাকে বলিসনি তো কখনো, কোথায় পেলি, চুরি করিছিস ?
— না বাপ, ও আমার ঘুঁটে বেচা টেকা কটা রে!
– ঠিক বলছিস, চল তবে ঠাকুরের থানে দাঁড়িয়ে বলবি। চল।
– তোর কাছে মিছে কেন বলব বল, তুই কি পর ?
আবার বুড়িকে ক্যারিয়ারে আর বউকে সামনে বসিয়ে কিছুটা এগিয়ে গঙ্গা রেল লাইনের ধার ঘেঁসে একটা ছোট সদ্য তৈরি হওয়া পল্লীর ভিতরের নুড়ি ঢালা রাস্তায় উঠল। একটা অসমাপ্ত ইঁটের তৈরি খাটো পাঁচিল দেয়া গেরস্তের বাড়ির মত জায়গায় এসে সাইকেল থামাল। গেটটার আগল তুলল আর ভিতরে ডেকে নিল দুজনকে।
– -এই দেখ বুড়ি, এই মন্দিরের ঠাকুরের সামনে হাত জোড় করে বল।
কি বলতে হবে কুঞ্জ দাসি বুঝতে পারে না। এ কেমন মন্দির? কোন বিগ্রহ নেই। সে ভালো চোখে দেখে না।
– -ঠিক আছে দাঁইড়ে থাক।
গঙ্গা গ্রিলের দরজা খুলে একটা সুইচ জ্বালিয়ে দিতে চারপাশটা কেমন ফকফকে আলোয় ভরে গেল। এই ছোট মন্দিরের ভেতরে ও বাইরে একটা আলো জ্বলে উঠলো। আরো মনে হলো
চারপাশটায় অনেক আলোর ঝুরি। বুড়ি বেমালুম বুড়বাক হয়ে গেল।
তারপর যেটা হল। তা আর বলার মত নয়। তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রায় বুড়ির পায় পড়ে যায়। বৌমা বলে, – -ও মা কিছু মনে কর না। ও বারণ করেছিল বলে বলিনি। এ তোমার নতুন বাড়ি। তোমার ছেলের বাড়ি। কোম্পানির কাছে ধার নিয়ে এই ঘর দুটো বানিয়েছে। বলে তোমার একটা ঘর আর আমাদের একটা।
— তবে যে বললি আশ্রম?
— হ্যাঁ মা দেখ। এখেনে একটা নাম লেখা। আমার মালিক বললে, গঙ্গাধর ও বাড়ির নাম দাও ‘কুঞ্জ আশ্রম’। এবার তোমার আঁচলের চারটি টাকা আমাকে দাও। বাতোসা নিয়ে আসি। পাড়ায় বলে এসিছি। আজ এ বাড়িতে হরির লুট হবে, সবাই এসোগো।
সন্ধ্যে বেলায় ছাপোষা কিছু লোকজন বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে এল। সবাই এই কলোনির বাসিন্দা। একজন পুরোহিত জোগাড় হল। অসময়ে গৃহপ্রবেশের পুজো হলো। সবাই মিলে এক কড়াই ভোগের খিচুড়ি রান্না করে বিতরিত হল।
তখন অনেকটা রাত হয়েছে। এখনও ঘরে পাখা লাগান হয়নি। তাই খোলা ছাদে একটা মাদুর পেতে তিনজন নতুন বাসিন্দা বসে গল্প করছে। আর দূরে রাতের শেষ ট্রেনটা হুইসেল বাজিয়ে স্টেশন পেছনে ফেলে আরো গ্রামাঞ্চলের দিকে এগিয়ে চলল।
একটা বড় হাই তুলে গুনধর ছেলে গঙ্গাধর বললে, — যাক আর ট্রেন ধরতে ছুটতে হবে না। আরাম করে চাকরি করতে পারব। ও মা ঠিক বলেছি কি না?
কুঞ্জ দাসি অনেকক্ষণ কোন কথা বলেনি। আধো অন্ধকারে আঁচলে চোখ মুছে বলল, – – লোকটা যে ওখেনে একা রয়ি গেল, বাপ ।
(শেষ)