ঘটনাটা চেনা পরিচিত।
এসব সব্বার প্রথমে আলোচিত হবে জটলায়। তর্কাতর্কি হবে চায়ের আড্ডাতে, হোস্টেল রুমের সস্তা মদের গেলাসে, কলেজ ক্যান্টিনের ডিমের চপে, কিংবা নাইট শো ফেরতা পথচলতি আলোচনায়। কথা উঠবে, – যা হচ্ছে, হয়েই চলেছে ক্রমাগত এই এতদিন ধরে, তা মেনে নেয়া আর যাচ্ছে না রে ভাই; এরমটা চলতে পারে না। কিছু তো একটা করতে হয়। কিছু…এ-ক-টা।
এই “কিছু একটা” করার যে আলোচনা হতে শুরু করেছে তা, সে-সব তখনও স্রেফ টুকরো টাকরা আলোচনার স্তরেই। ‘দাবি’ হয়ে উঠতে পারেনি তখনও সেগুলি।
কেবল…বিলের ধারে একান্তে আঙুলে আঙুল জড়াজড়ি খেলা চলছে যখন রুদ্ধশ্বাস তখন, প্রিয় বলে উঠছে আচমকা মায়া-নিস্তব্ধতা থামিয়ে– এই, তোরা কী সব শুরু করেছিস বল তো! একটু সামলে থাক বাবু। কাদের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকাচ্ছিস জানিস তো! এসব ছাড়! তোর মায়ের কথা ভাব! আর…আর আমি? আমার কথাও তো এবার ভাবতে শুরু করতে হবে মশাই, তাই না?
আঙুলে আঙুলের বন্ধন আরেকটু তীব্র জাপটে অপর কণ্ঠ তখন বলে উঠছে এক আকাশ হেসে– হে হে হে… তুইও না! মাইরি আর কি! এসব কিছু না রে! বরং একটা গান গা দেখি, সেই
যে – আমি শুনেছি সেদিন তুমি…।
মুহূর্তে বসন্ত-কুয়াশা নামছে আশ্চর্য ঝিল কিনারে।
****
থামে না ঘটনা যদিও এখানেই। জমাট বাঁধতে থাকে, জোট বাঁধতে থাকে ‘ কিছু একটা করতে হবে’ পোকাগুলো। পোস্টার পড়ে টুকরো টাকরা। ডায়াসিং হয় এক দুটো। চোয়াল কঠিন হতে শুরু করে গোটা দশ পাঁচের।
সে পোস্টারের ওপরে তখনো যদিও কেউ লিখে যায়, R + M। সে ডায়াসিং চলা কালীন ব্যাগ কোলে গুছিয়ে উঠে যায় বিরক্ত মুখে সিরিয়াস পড়ুয়ারা। আর কঠিন চোয়ালগুলোতে চুমা খেয়ে নরম করে দেয় প্রিয়-মানব/মানবীরা।
****
ক্রমে পোস্টারের সংখ্যা বাড়ে। ডায়াসিংয়েরও। আর শুরু হয় মধ্যরাতের গোপন মিটিং। যে ছেলেপুলেগুলো এতদিন মাঝরাতে পর্নোগ্রাফি, তাস , মদ বা নিদেনপক্ষে সিলেবাস নিয়ে মত্ত থাকত জগৎ ভুলে, সেই তারাই একে একে জড়ো হতে থাকে সেসব মিটিংয়ে। কেউ যদিও তাদের বাধ্য করেনি জাগতিক–জঞ্জাল–যাপন পরিত্যাগ করে কঠিনের সম্মুখীন হওয়ার পরিকল্পনাতে জড়িয়ে পড়তে।
কিন্তু সেসব অজুবা হয়। হতে থাকে। সংখ্যা বাড়ে, বেড়েই চলে গভীর রাতের মিটিং-সদস্যদের। বন্ধ হয়ে যায় বিনবিনে মশার ব্যালকনিতে লম্বা পায়চারি সমেত লম্বা প্রেমালাপ ফোনে ফোনে। স্রেফ একটা-মাত্র মেসেজ প্রেরিত হয় রাত ঠিক বারোটায়–
আমি ঠিক আছি। তুই ঘুমা। মিটিং আছে একটা। কাল সকালে কথা হবে। মুআহ। লাভ ইউ।
****
তারপর একদিন ক্যাম্পাসে টুক করে জ্বলে ওঠে প্রথম ফুলকি। প্রদর্শিত হয় বিক্ষোভ। জনা পঞ্চাশ ছাত্র ছাত্রী।এদের মধ্যে তিরিশ জনই এসেছে তার বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড এই বিক্ষোভ প্রদর্শনের শক্তিশালী-সমর্থক বলে।
মিনিট চারেকের বিক্ষোভ প্রদর্শন। তার মধ্যে গোটা সাতেক অশ্লীল খিস্তি, আর শশব্যস্তে আসপাশ থেকে সাবধান করে দেওয়া– এই কী হচ্ছে! ডিগনিটি ল্যুজ করবি না গান্ডু!
যাকে বলা হলো, সে হেসে ফেলল– আর তুই যে নিজেই আমাকে গান্ডু বললি?
হেসে ফেললো সবাই খ্যাক খ্যাক করে।
গলা জড়াজড়ি হইহই হররা আর হাসির মধ্যে কতগুলো উজ্জ্বল মুখ সেইদিন, সেই দ্বিপ্রহরে সব শেষে ক্যান্টিনে চা সিগারেট প্যাঁদাচ্ছে যখন, তখন কে দেখলে ওদের বলবে ওদের মধ্যে চারজন ঠিক সাতদিন পরেই মরে যাবে, আর বাদবাকি ছেচল্লিশ ভয় পাবে।
ভয়। খুব খুব ভয়।
যদিও সেসব ভবিষ্যৎ গর্ভে। এখনো।
****
প্রথম মিছিল বেরোবে এবার। সংখ্যা ততদিনে বেড়েছে আরো। যদিও…একদম সামনে আর স্ট্র্যাটেজিক্যাল–মধ্যভাগে আর সব্বার পেছনে যে একশ জন জায়গা বন্টন করে নিয়েছে স্লোগান দেওয়ার জন্য, তারা বাদে এ মিছিলে পা দিয়েছে যে চারশ একতিরিশ জন তারা হাসছে, গাইছে, পতাকার পেছন দিয়ে পিঠ চুলকাচ্ছে আর আচমকা প্রিয়র হাত ধরে মিছিল ফেলে রেখে হারিয়ে যাচ্ছে পার্কে। ময়দানে। ফোন কানে বলছে– পরের মাসে বাড়ি ফিরে মা, দোকানে যাব। নয়েজ ক্যান্সলেশন হেডফোন কিনে দেবে বাবাকে বলে। হুঁ।
আর খবরের কাগজের চারের পাতার তিনের কলামে প্রকাশিত হচ্ছে
– ‘সরকার বিরোধী বিক্ষুব্ধ পড়ুয়ারা’।
চারজনের মরে যেতে তখনও চারদিন বাকি।
*****
এবার প্রথম ঘৃতহুতি। প্রথম বিস্ফোরণ। প্রথম জাগরণ। প্রথম উন্মাদ উন্মত্ততা।
কারণ এইবার আশ্চর্য তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্য করবেন ‘সরকার-পক্ষ’ – এরা সব অজাত কুজাত। এরা আবার ছাত্র নাকি! ছাত্র যখন তুই, পড়াশুনা কর না! আসলে এসব বিরোধী পার্টির চক্রান্ত।
ব্যাস। আঁতে এবার বল্লম প্রবিষ্ট হবে। চারতলার ছয় নম্বরে রোজ রাতে মিটিং থেকে বাঁচতে যে ছেলেটা বই বগলে চলে যেত ছাদের ট্যাঙ্কির পেছনে টর্চ হাতে, যে ছেলেটাকে কেউ গালি দিতে শোনেনি কখনো, সেই ছেলেটাই এবার হাজির হবে দুই তলার তের নম্বর ঘরে। মিটিংয়ে। সব্বার আগে। আর চিৎকার করে বলবে– এসব কী কী কী বলছে ওরা? শালা? কী বলছে? কিছু কর রে ভাই তোরা, আমি পাশে আছি।
সে রাতে প্রিয়কে মেসেজ করে ঘুমিয়ে যেতে ভুলে যাবে সবাই। সে রাত… শপথের রাত।
ও হ্যাঁ, ওই চারজনের মরে যেতে তখনো দুই দিন বাকি।
ওদের বাড়িতে তখন বাবা বলছে– ছেলে তোমার বখে গেছে। মা বলছে– মেয়েটা রাতের পর রাত কী যে করছে! আর ছোটকাকিমা বলছে– এবার এলে ওকে স্মার্টওয়াচ কিনে দেব একটা, আপনাদের ভাইয়ের এল আই সি ম্যাচুয়র করেছে।
***
পরের পরের দিন মিছিল হলো প্রকান্ড। প্ল্যাকার্ড সব্বার হাতে। তা দিয়ে যদিও আর পিঠ চুলকাচ্ছে না কেউ। বরং ডান হাত একনাগাড়ে উঁচিয়ে থাকতে ব্যথা লাগছে বলে, বাম হস্তে তুলে নিচ্ছে নিশান। চোয়াল সব্বার শক্ত।
শোনা যাচ্ছে, অমুক চৌমাথার মোড়ে পুলিশ ব্যারিকেড করেছে। দাদারা তাই এসে বলে যাচ্ছে বারেবারে– ভয় পাস না, এই ঝিলিক…এই তমাল…সৌরভ, সুনীল ওয়াসিম…ভয় পাস না! আরেঃ, আমরা তো ছাত্র রে! আমরা…ছাত্র। আমাদের কিছু করবে না ওরা। দেখিস। মিলিয়ে নিস তোরা। শুধু ভয় পাস না প্লিজ।
মিছিল এগুলো আরো। পুলিশ। ব্যারিকেড। আর কী আশ্চর্য, জল-কামান! হ্যাঁ? জ-ল-কা-মা-ন? রাবার বুলেট বন্দুক? টিয়ার গ্যাস নল?
একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগল মিছিলের সম্মুখের আট জনের। হাঁটুতে হাঁটুতে শীতল ঠোকাঠুকি। কথা বলতে গেলে অতি উত্তেজনায় জিভ তুতলে যাচ্ছে– কি..কি..কি-ছুউউ তো হব্বে না বল? আমরা তো ইস- স্টুডেন্ট… আম্মরা ছাত্ত।
হলো।
জল কামান গর্জালো। আর তাতেই সম্বিৎ ফিরলো ওই পুরোভাগ আটজনের। হা-আ-আ-আ মস্ত ডাক ডেকে ছুটে গেল তারা জলের ফোয়ারার দিকে। বুক চিতিয়ে। মিছিল ছত্রখান। কিছু পালিয়েছে। আর যারা আছে এখনো, তারা বুক চিতিয়ে বা ইতিউতি গোটা সত্তর। সব্বাই জানে, এ তো স্রেফ জলই। একজন তো বলেও দিল, ভেজা টি শার্টে তোকে সেক্সী দেখাচ্ছে মাইরি। বিয়ে করে ফেলব চটপট।
জল কামান পাল্টে এবার টিয়ার গ্যাস।
খকখক কাশি। মিছিল আরো ছত্রভঙ্গ। এখন, স্রেফ পঞ্চাশ জন।
– ফুঁ দিয়ে চোখের জল সারাচ্ছিস, বাবাঃ! দেখব। বিয়ের পর।
এবার রবার বুলেট। ধ্যাৎ এতে কেউ মরে না।
আয় আয় আয় মার গুলি এই বুকে।
সাহস থাকলে টেবিলে বোস। সম্মুখে।
আরেঃ, তুই তো কবিতা বানাচ্ছিস! এই এই…,এই ভাই…এ-ই ভাই…ভাই…ভাই…ভাই কী হলো? কী হলো রে…এই ভাই…তুই শুয়ে পড়ছিস কেন….এইইইই স্বৈরাচারী শালা…ভাইকে মেরে
দিলি তুই….
মিছিল আবার জমাট বাঁধছে একটু। একশ, দেড়, আড়াই, পাঁচ, সাত শ…হাজার।
ইতোমধ্যে চারজন শুয়ে পড়েছে রক্তাক্ত।
এক নম্বরের বাবা বলেছিল– এবার সংসারের দায়িত্ব নাও বাবু।
দুই নম্বরের মা – ইদে কী রঙের জামা নিবা?
তিন নম্বরের প্রেমিক– কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে?
আর চার নম্বরের শিক্ষক– পড়াশুনা করো বাবা। পরের বছর অংকে আশি আশা করি। আলহামদুলিল্লাহ।
*****
হ্যাঁ এবারই চমৎকার।
গণমাধ্যম উত্তাল হলো। ফেসবুক। টেসবুক।
আবেগীরা– গর্জে উঠলেন।
বিবাগীরা, সেই শ্যুট আউট ভিডিও তিন চার বার দেখলেন আর প্রতিবার লিখলেন, ইস দেখা যাচ্ছে না।
অতি শিক্ষিতরা বললেন– সবটা…বুঝলেন কিনা, সবটা আগে বুঝে দেখি, তারপর পোস্ট নামাব।
আর বাকিরা, কিছুই বললেন না।
****
চারজন মরে গেল যেই, ওমনি শুরু হলো ভয়। ওমনি… হঠকারী সিদ্ধান্ত সমূহ। এরা তো আদতে ছাত্র ছাত্রীই। এদের তো সত্যিই এমনতর জগৎ পাওয়ার কথা ছিল না। কথা ছিল এমন দুনিয়ার, যে জগতে স্রেফ ‘অধ্যয়নং তপঃ’ হয়েই থাকা যায় বিন্দাস।
কিন্তু সেসব তো আর হয়নি। আর হয়নি বলেই এরা স্রেফ আনাড়ি-আন্দোলন করতে চেয়েছিল। বোঝেনি এত ঝকমারি আর দিকদারির কথা। তার চাইতেও বড় কথা, এরা ভাবতেও পারেনি মরে যেতে হবে।
অতএব তারা কেউ কেউ ভয় পেলো। আর তখনই বাজারে এলো ফড়ে, দালাল, হায়নারা। আসবেই। স্বাভাবিক।
এ জগতের যাবতীয় বিক্ষোভ তৎকালীন সরকারি নীতির বিরুদ্ধেই। আর বিরুদ্ধাচারিতা(কিংবা, গোপন রাতে বখরা ভাগাভাগি) করে বেঁচে থাকে যারা– তারা বিরোধী পার্টি। সুতরাং, সরকার– বিরোধী, মসনদ-মুখী এমন মঞ্চকে কেমনে উপেক্ষা করে তারা।
এতএব তারা আসে। বলে– ভয় পেয়ো না ভাই বোনেরা। এই তো আমরা আছি। আইস।
আর হ্যাঁ, একদিন না একদিন সেই টোপে পা পড়ে। আদতে এই আন্দোলনের ছেলেমেয়েগুলোতো ছাত্রই ছিল। অপরিণত।
তাই, আন্দোলন হাইজ্যাক হয়ে যায়।
****
বছর ত্রিশেক কেটে যায়।
রিসার্চ হয় এই অভ্যুত্থানের বিষয়ে। হয় থিসিস পেপার। বিলেতে-বক্তৃতা। পি.এইচ.ডি। পোস্ট-ডক।
আর বই প্রকাশ হয় বেস্ট সেলিং–
A student movement in La La Land, is it Funded by secret organization?
সেইদিন, আঁতেল যিনি, যে মানুষটি তখন ঐ আন্দোলনের দিনগুলিতে সন্দিহান ছিলেন,তিনি বাঁকা হাসি হেসে বলেন– দেকেচ! মুকুন্দ? বয়েচিলাম না? গটনা অন্নেক গবিরে?
আর সেই দিনই
দুই বন্ধুর আড্ডায় গান থামিয়ে আচমকা বলে ওঠে বাচ্চু– গ্লাস হাতে নে শামিম, ঠেকা, চিয়ার্স কর। ঠিক এই সময়েই মারা গিছল অনিমেষ। হাসপাতালে। পুলিশের সেই গুলি? মনে পড়ে? অনিমেষ, সায়নী, আইয়ুব, সিদ্ধার্থ?
অনিমেষের মা তখন ছেলের সোয়েটার বুকে চেপে দূর দেশে।
সায়নীর বয়ফ্রেন্ড দেশের উন্নতিকল্পে ইনক্যাম ট্যাক্স ফর্মে সই করতে গিয়ে থমকে যাচ্ছে।
আইয়ুবের কেউই বেঁচে নেই মনে রাখবে যে।
সিদ্ধার্থর বাড়িতে সেদিন নির্জলা উপবাস।
সরকার বদলে গেছে যদিও এর মধ্যে বার চারেক। আর খবর মিলছে , সেইদিন প্রথম গুলি চালিয়েছিলেন যিনি, তাঁর রিটায়ারমেন্টে পদক দিচ্ছেন এই নতুন সরকারও।
আর, ইউনিভার্সিটিতে ওই সেদিনই হঠাৎ করে ছাত্র জমায়েত হলো, যা দেখে বিদগ্ধ জন সেদিনও বলে উঠলেন, না না আন্দোলন হয়েছে ঠিকাছে! কিন্তু সবটা আগে বুঝি। মরে গেলে মরে যাক। কিন্তু লিখব যখন তখন লিখব গুছিয়ে।
এবং মরে গেল।
এবং ভুলে গেল।
এবং এগিয়ে গেল
জগৎ।
(পোস্টার শিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তী, বাংলাদেশ)