২০.০৯.২০২৪
কী এমন আছে পাঁচ দফা দাবিতে! এটা জানা খুব দরকার। অভয়ার ধর্ষণ ও হত্যা কোনো পৃথক ঘটনা নয়। বহুদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতি ও ভয়ের পরিবেশের পরিণাম হলো অভয়ার ঘটনা। তাই এই আন্দোলনের একটা দিক যেমন বিচার আদায় এবং তথ্য লোপাটকারীদের চিহ্নিতকরণ; তেমনি আরেকটা দিক ডাক্তারদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা, ভয়ের পরিবেশ কাটিয়ে কলেজগুলোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং ভবিষ্যতে যাতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় তার ব্যবস্থা করা।
৭৩. ডাক্তারি আন্দোলনের প্রথম দাবি অভয়ার ন্যায়বিচার। সেদিন রাতের নারকীয় ঘটনা কারা ঘটিয়েছিল তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন তাদের আসল উদ্দেশ্য উদঘাটন করা। একজন সিভিক ভলান্টিয়ারকে দোষী সাজিয়ে এত বড় একটা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া যায়না। এই খুনি-ধর্ষকের দল এখনো কলেজ প্রাঙ্গনে হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে, হয়তো বা আন্দোলনের সামনের সারিতে হাঁটছে, একসঙ্গে খাচ্ছে- এই পটভূমিকায় হাসপাতালে কেউই নিরাপদ নয়।
এখন কলকাতা পুলিশ যে তৎপরতার সাথে তথ্যপ্রমাণ হাপিশ করেছে, সেখান থেকে তদন্ত চালানো খুব একটা মুখের কথা নয়! সঠিক তদন্ত সময়সাপেক্ষ, এটা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। সিবিআই-র জমা দেওয়া রিপোর্টে প্রধান বিচারপতি একইসাথে সন্তুষ্ট ও সংবিগ্ন। ইতিমধ্যে সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার ওসি গ্রেপ্তার- এর থেকে আশা করা যায়, তদন্ত হয়তো বা সঠিক পথেই চলছে- এর উত্তর সময়ই দিতে পারবে।
৭৪. দ্বিতীয় দাবি এই হত্যার যারা তথ্যপ্রমাণ লোপাট করলো, তাদের চিহ্নিতকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। সন্দীপ ঘোষকে স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে বহিষ্কার- এই সাসপেনশন আগেই এসেছিল, কিন্তু সরকারি সদিচ্ছায় নয়, বরং গ্রেপ্তারির অনিবার্য ফলবশত। কালক্রমে জানা যায় সেই সেমিনার রুমের পাশে নির্মাণকার্যের কাগজে ডিএমই ও ডিএইচএস- উভয়ের স্বাক্ষর আছে- স্বভাবতই তাঁদেরও অপসারণের দাবি জানানো হয়। স্বাস্থ্য দপ্তরের এই দুই মহারথী ছাড়াও রয়েছেন স্বাস্থ্য সচিব নারায়ণ নিগম- তাঁর অপসারণেরও দাবি জানানো হয়। কারণ তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বেই স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্নীতির পাহাড় গড়ে উঠেছিল।
৭৫. তৃতীয় দাবি ছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। ঘটনার অব্যবহিত পরে ক্রাইম সীন সিকিওর করতে ব্যর্থ পুলিশ। শুধু তাই নয়, তথ্যপ্রমাণ লোপাটেও তারা সিদ্ধহস্ত। ডিসি নর্থ ঘটনার দিন অভয়ার মা-বাবাকে টাকা খাইয়ে চুপ করানোর চেষ্টাও করেন। ডিসি সেন্ট্রাল ইন্দিরা দেবী প্রতিদিন মিডিয়ার সামনে মিথ্যা তথ্য দেন, যেটা পরবর্তীতে বিভিন্ন মিডিয়ার ক্লিপে প্রমাণিত হয়। আবার ১৪তারিখ রাতে আরজিকরের তাণ্ডবে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা- এসব কিছু সামনে রেখেই সিপি বিনীত গোয়েলের পদত্যাগ, ডিসি নর্থ ও ডিসি সেন্ট্রালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার দাবি ওঠে।
৭৬. চতুর্থ দাবি কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার দাবি। এর মধ্যে অনেকগুলো দিক রয়েছে। উপযুক্ত অন কল রুম, ওয়াশরুম ইত্যাদি যেমন দরকার, তেমনি দরকার প্রয়োজনীয় পুলিশ বাহিনী। সর্বত্র পুলিশের জায়গায় অপ্রশিক্ষিত সিভিক ভলান্টিয়ার দিয়ে কাজ চালানোর প্রচেষ্টা মানা যায়না। পুলিশের আদপে কোনো এসওপি-ই নেই কলেজে সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারে। হঠাৎ কোথাও কোনো ইমার্জেন্সি হলে নেই কোনো প্যানিক বটন বা হেল্পলাইন নম্বর। উপযুক্ত সংখ্যক সিসিটিভি নেই, যা আছে সেগুলো মেন্টেনেনসের কোনো হিসাব নেই।
সেরকমই আন্ডারগ্র্যাজুয়েট বাচ্চাদের উপর অত্যাচারের যে গল্প বিভিন্ন জায়গা থেকে উঠে আসছে- সেগুলোকে যথাযথ গুরুত্ব কলেজ কর্তৃপক্ষ দেয়নি। অ্যান্টি-র্যাগিং কমিটি, ইন্টারনাল কম্পলেন্ট কমিটি- ইত্যাদি গালভরা নামের অনেক কমিটি বিভিন্ন কলেজে রয়েছে। কিন্তু তাদের আদৌ কোনো সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। এদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও এই আন্দোলনের লক্ষ্য।
শুধু ডাক্তার নয়, রোগীদের সুরক্ষাও এই আন্দোলনের বিষয়বস্তু। বিভিন্ন জায়গা থেকে রেফার হয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে বেড়ানো কেন! একটা এক্স-রে, সিটি স্ক্যানের জন্য গুটিকয়েক মেডিক্যাল কলেজে দৌড়তে হচ্ছে, ভুঁইফোরের মতো গজিয়ে ওঠা মেডিক্যাল কলেজগুলোতে সেই ব্যবস্থা নেই কেন- এই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। রোগীদের জন্য কোনো সেন্ট্রাল রেফারাল সিস্টেম নেই, যেটা কোভিডের সময় থাকায় রোগী হয়রানি হয়নি, বেড পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দানা বাঁধেনি।
৭৭. শেষ দাবি ভয়ের পরিবেশ থেকে মুক্তির- এবং ভবিষ্যতে আরেক অভয়া হওয়া থেকে আটকানোর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এটাই। ভয়ের পরিবেশ কী- এটা একজন সিস্টেমের বাইরের লোকের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। গত কয়েক বছর ধরে তৃণমূল সরকার সব শিক্ষাঙ্গন থেকেই ভোটাভুটি তুলে দিয়েছেন- আমার মতো কিছু মানুষ তাতে খুশিও হয়েছিল খুব। এবার লোকে ভোট ভুলে পড়াশোনা করবে- এই ছিল ধারণা। কিন্তু সরকারের মতলব ছিল অন্য- নির্বাচিত ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের বদলে এখন নেতৃত্ব নিল সরকারের পেটোয়া কিছু দালাল ডাক্তার।
আপনি একজন নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ, ডাক্তারি পড়তে এসেছেন। দিয়ে জানতে পারলেন সেই দালালদের দলে নাম না লেখালে আপনার পরীক্ষায় বসা হবেনা, বসলেও পাশ করা হবেনা। পরীক্ষার আগেই আপনি জানতে পারবেন আপনি কাউকে মলেস্ট করেছেন, তাই আপনার পরীক্ষায় বসা হচ্ছে না। বসলেও আপনি দেখলেন অদ্ভুতভাবে আপনি ফেল করে গেছেন। বা আপনার গবেষণাপত্র খারিজ হয়ে গেল। বা আপনি জানলেন আপনার ইন্টার্নশিপের কম্পলিশন আটকে গেলো, বা আপনি রেজিস্ট্রেশনটাই পেলেন না!
এইসব নানাবিধ উপায়ে নিজেদের ক্ষমতা বজায় রেখেছে তৃণমূলী সন্ত্রাসবাদী ডাক্তারেরা। এদের বুড়োগুলো মেডিক্যাল কাউন্সিলের ভোটে ছাপ্পা ভোটে জেতে, আর অভীক-বিরূপাক্ষ-রণজিতের মতো কিছু নবোত্থিত কুঞ্চিত কেশরাশি কলেজে থ্রেট কালচার চালায়। শুধু এরা নয়, এদের পা-চাটা লেজুররা মিলে তাণ্ডব চালিয়ে যায় কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায়। একটু কান পাতলে খুন বাদ দিয়ে বাকি সব কিছুরই উদাহরণ পাওয়া যাবে- অথচ অথরিটির কাছে ‘সাব চাঙ্গা সি’…
৭৮. স্বাস্থ্যব্যবস্থা এক ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটের করায়ত্ত এখন। কয়েকটা দুষ্টচক্র- নর্থ বেঙ্গল লবি, এই লবি, সেই লবি এরা ভরে গেছে সর্বত্র। এরাই হেলথ ইউনিভার্সিটি চালাচ্ছে, এরাই মেডিক্যাল কাউন্সিল চালাচ্ছে, এরাই স্বাস্থ্য ভবনের ঘুঘুর বাসা গড়ে তুলেছে, আবার এরাই হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে বগল বাজাচ্ছে। এখন অযোগ্যদের পাশ করানো, এমনকি র্যাঙ্ক করানো এবং যোগ্য ব্যক্তিদের দলে টানতে না পারলে ফেল করিয়ে দেওয়া বা আরো বিভিন্ন উপায়ে অত্যাচার করা একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কলেজের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা মুখ বুজে চোখে ঠুলি পরে বসে আছেন, এখন অনেকে সাহস করে বা চাপে পড়ে বলতে আসছেন ক্যামেরার সামনে এসব দুর্নীতির কথা- কিন্তু তাঁরাও একজন শিক্ষক হিসাবে কতটা দায়িত্ব পালন করেছেন, সেটাও জিজ্ঞাস্য!!
এই সিন্ডিকেটরাজ উপরে না ফেলতে পারলে আগামী দিন হবে ভয়ঙ্কর- অযোগ্য ডাক্তারে ভরে যাবে দুনিয়াটাই, আর যোগ্য ডাক্তারেরা খুন হয়ে গুম হয়ে যাবে সেমিনার রুমে।।