আমি খুপরিজীবী চিকিৎসক। আমার ভাই ও বোনেরা যখন ন্যায় বিচারের দাবিতে রাস্তায়, আমি খুপরি থেকে খুপরিতে ঘুরে রোগী দেখছি। সুযোগ পেলেই দু একটা মিছিলে পা মেলাচ্ছি, স্লোগানে গলা মেলাচ্ছি।
উত্তাপ বুঝতে পারছি। তিলোত্তমা বোন যে আগুন জ্বেলে দিয়ে গেছে সেই উত্তাপ টের পাচ্ছি। নিশ্চিত জানি সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে ক্ষমতাবান অত্যাচারীরা।
এই সময় তাই খুপরির দিনলিপি লিখে রাখি। যে বিদ্রোহের সময় আমরা বেঁচেছিলাম, গান গেয়েছিলাম- সেই দ্রোহের দিনলিপি লিখে রাখি।
খুপরিতে রোগী দেখছি। একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েকে নিয়ে বাবা ঢুকলেন। মেয়েটি সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে।
জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
বাবা বললেন, আর বলবেন না ডাক্তারবাবু। জটিল সমস্যা। চার পাঁচদিন ধরে কিছু খেতে পারছে না। খেলেই বমি করে দিচ্ছে।
পেটে ব্যথা আছে? জ্বর আছে? পেচ্ছাপ সাদা হচ্ছে?
সব ঠিক আছে। সমস্যা শুধু খেতে গেলে। আর ঘুম হচ্ছে না। একেবারেই হচ্ছে না।
আমি মেয়েটিকে বললাম, হঠাত করে এমন শুরু হলো?
মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, হঠাত করেই। জেল থেকে বাড়ি আসার পর এমন হচ্ছে।
অবাক হয়ে বললাম, জেল থেকে মানে?
চার তারিখ বারাসাতে রাত দখলের আন্দোলন ছিল। সেখানে রঙ তুলি নিয়ে ছবি আঁকতে গেছিলাম। হঠাত পুলিশ এসে আমাদের গ্রেফতার করে। নানা রকম ধারায় কেস দেয়। দু রাত জেলে কাটিয়ে জামিন পেয়েছি। তারপর থেকে খেতে বসলেই জেলের ভেতরের বিশ্রী গন্ধটা নাকে আসছে।
ওষুধ পত্র লিখে দিলাম। ভিজিট দিতে গেলে বললাম, মা, তুই একজন চিকিৎসকের বিচারের দাবীতে জেল খেটে এলি, তোর কাছ থেকে কিছু নিলে আমাদের বোনের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব।
সেদিন বিকালে আমাদের মধ্যমগ্রাম স্কুলের প্রাক্তনীদের ডাকে মহামিছিল। আরতি হলের সামনে মিছিল শুরুর আগে শিল্পীরা আঁকছেন। দেখি সেই ছোট্ট মেয়েটাও আঁকতে বসে গেছে। লাল হলুদে মেশানো আগুন। তাঁর মধ্যে একটি মেয়ে গলার শির ফুলিয়ে চিৎকার করছে। দক্ষ হাতে কাগজে বিদ্রোহ ফুটে উঠছে। এ মেয়ের কোনো ওষুধ লাগবে না। ওর রোগ নিজে নিজেই সেরে যাবে।
কদিন পরে আরেকটি রাত দখলের দিনে তাড়াহুড়ো করে চেম্বার করছি। শেষ করেই জমায়েতে সরাসরি চলে যাব। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী আজই বলেছেন, উৎসবে ফিরে আসুন। তাঁর কথা শিরোধার্য করেই তড়িঘড়ি মধ্যমগ্রাম চৌমাথায় উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবাদের উৎসব। ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘণ্টা সব কিছু হাজির। আজ সারা রাত প্রতিবাদের গান হবে, নাচ হবে। ঢাকের তালে স্লোগান উঠবে আমাদের বোনের খুনের সাথে যারা জড়িত তাদের বিচার চেয়ে।
একজন বয়স্ক মহিলা দেখাতে এসেছেন হাঁটু ব্যথা নিয়ে। বাঁ পা মাটিতে ফেললেই তাঁর মুখ যন্ত্রণায় কুঁচকে উঠছে। তিনি বললেন, বাবা, একটা ইনজেকশন দিয়ে ব্যথাটা কমিয়ে দাও শিগগিরি। নড়াচড়াই করতে পারছি না।
ভালো করে দেখে বললাম, অকারণে ইনজেকশন দিয়ে লাভ নেই। বেশি ব্যথার ওষুধ খেয়েও লাভ নেই। দু চারটে ব্যায়াম করুন। এই ওষুধ গুলো খান। ব্যথা আস্তে আস্তে কমবে। আর সিঁড়ি ভাঙবেন না। ভারী জিনিস বইবেন না। হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসবেন না।
চেম্বার শেষ করে তড়িঘড়ি চৌমাথায় গিয়ে দেখি ঢাক বাজছে ‘আই ওয়ান্ট জাস্টিস’এর তালে তালে। কয়েকজন মহিলা ধুনুচি নিয়ে নাচছেন। তাঁদের মধ্যে সেই বয়স্ক মহিলা, যিনি হাঁটু ব্যথার জন্য একটু আগে আমাকে দেখিয়ে এসেছেন। তিনি আমায় দেখে লজ্জা টজ্জা পেয়ে নাচ থামিয়ে দিলেন। আমি পালিয়ে ভিড়ে মিশে গেলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম, মানুষের মনে যখন দ্রোহ জেগে ওঠে, তখন সে নিজের প্রতিবন্ধকতা সহজেই পার হয়ে যায়।
গতকাল এক পুলিশ অফিসার এসেছেন দেখাতে। প্রেশার সুগার বাড়তির দিকে।
জিজ্ঞেস করলাম, এতো বাড়ল কী করে?
বললেন, ডাক্তারবাবু, গত একমাস ধরে যা চাপে আছি। যা গালি খাচ্ছি। সুগার প্রেশার নিয়ন্ত্রণে থাকবে কী করে?
ওষুধ পত্র লিখে দেওয়ার পর যাওয়ার সময় বললেন, একটা জিনিস অদ্ভুত লাগছে- অপরাধের সাথে একাধিক চিকিৎসক যুক্ত। অথচ সাধারণ মানুষ চিকিৎসকদের হিরোর আসনে বসিয়েছে। তাঁদের সমর্থনে রোজই একাধিক মিছিল হচ্ছে। মাঝখান থেকে গালি খেয়ে মরছি আমরা, পুলিশেরা।
বলতে ইচ্ছে করছিল, আমাদের জুনিয়ার ভাই বোন গুলোর মতো এতজন সৎ, মেরুদণ্ডওয়ালা জুনিয়র পুলিশ ডিপার্টমেন্টে থাকলে আপনারাও গালি খেতেন না। পুলিশের মধ্যে থেকেই যদি নগরপালকে সরানোর আওয়াজ উঠত, পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ঘুঘুর বাসা ভাঙার দাবি উঠতো- তাহলে সাধারণ মানুষও আপনাদের সাথে থাকত।
পুলিশ অফিসার বেরিয়ে যাওয়ার পর আরও একবার জুনিয়ার ভাই বোন গুলোর জন্য গর্ব হলো। নিজের পেশার জন্যও গর্ব হলো। এই পেশাটাকে দিন দিন যেন আরও বেশি ভালোবেসে ফেলছি।
পোস্টারের লেখা: মেহেদী হাসান রহমান Mehedi Hassan Rahaman