ছোঁয়াচে নয় এমন অসুখগুলোর মধ্যে অন্যতম উচ্চরক্তচাপ, যাতে সারা পৃথিবীতে অনেক মানুষ আক্রান্ত। এই রোগে ধমনীর দেওয়ালে দীর্ঘদিন ধরে রক্তের চাপ এতোটা বেশি থাকে যে তা থেকে শরীরের নানা ক্ষতি হতে পারে।
আমাদের হার্ট কতোটা রক্ত পাম্প করছে আর সেই রক্ত ধমনী দিয়ে যাওয়ার সময় কতোটা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে তা দিয়ে নির্ধারিত হয় ধমনীর রক্তচাপ। হার্ট একেক বারে যতো বেশি রক্ত পাম্প করবে আর ধমনী যতো সঙ্কীর্ণ হবে রক্তচাপ ততো বেশি হবে।
সমস্যাটা হল—কারুর উচ্চরক্তচাপ আছে এটা বোঝার। বছরের পর বছর রক্তচাপ বেশি, অথচ রোগীর কোনও কষ্ট নেই—এমনটাই বেশি হয়। তার মানে কিন্তু এমনটা নয় যে বেশি রক্তচাপের জন্য রক্তনালী বা হার্টের কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। রোগীর অজান্তেই ক্ষতি হয়ে যেতে থাকে, অনেক সময় রোগ ধরা পড়ে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো কোনও বড় বিপদ ঘটলে।
তবে ভালো ব্যাপার হল—উচ্চরক্তচাপ নির্ণয় করা সহজ, রক্তচাপ মাপলেই হলো। আর উচ্চরক্তচাপ ধরা পড়লে ডাক্তারের সহায়তায় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনা খুব কঠিন নয়।
তাই ডাক্তারকে দেখাতে গেলে রক্তচাপ দেখিয়ে নেওয়া ভালো।
- ১৮ বছর বয়স থেকে দু’বছর ছাড়া রক্তচাপ মেপে দেখা উচিত।
- ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সে প্রতি বছরে রক্তচাপ মাপা উচিত।
- বয়স ১৮ থেকে ৩৯, কিন্তু উচ্চরক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি যাঁদের তাঁদের অবশ্য প্রতি বছরেই রক্তচাপ মাপা উচিত।
উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি কাদের বেশি?
- বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি বাড়ে। পুরুষদের মাঝ বয়সের শুরুতে, মোটামুটি ৪৫ বছর বয়স থেকে ঝুঁকি বেশি। মহিলাদের ঝুঁকি বেশি ৬৫ বছর বয়সের পর থেকে।
- যাঁদের পূর্ব পুরুষদের উচ্চরক্তচাপ আছে/ ছিল, তাঁদের উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বেশি।
- স্থূল বা ওজন বেশি।
- শারীরিক পরিশ্রম যাঁরা কম করেন।
- ধূমপায়ী বা মুখে খাওয়া তামাকের নেশা যাঁদের আছে।
- নুন যাঁরা বেশি খান।
- যাঁদের খাবারে পটাশিয়াম কম থাকে।
- যাঁদের খাবারে ভিটামিন ডি কম থাকে।
- যাঁরা বেশি মদ খান।
- যাঁদের মানসিক চাপ বেশি।
- কিডনির রোগ, ডায়াবেটিস মেলিটাস ও স্লিপ অ্যাপ্নিয়া যাঁদের আছে— তাঁদেরও উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বেশি।
আসুন দেখি অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপে কি কি হতে পারে?
- অ্যানিউরিজমঃ উচ্চরক্তচাপের কারণে কোন ধমনীর দেওয়ালে ফুলে ওঠে। সাধারণত অ্যানিউরিজম আস্তে বাড়তে থাকে কোনো উপসর্গ বা লক্ষণ ছাড়াই। বোঝা যায় যখন তা ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণে জীবন-সংশয় বা যখন তা বেড়ে পাশের কোনো প্রত্যঙ্গের চাপ দিচ্ছে বা কোন রক্তনালীর রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন।
- কিডনির ক্রনিক (অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী) রোগঃ কিডনির রক্তনালীগুলো সঙ্কীর্ণ হয়ে যাওয়ায় কিডনি কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে।
- চোখের ক্ষতিঃ চোখের রক্তনালী ফেটে বা তা থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে দৃষ্টিশক্তি কমে, অন্ধত্বও হতে পারে।
- হার্ট অ্যাটাকঃ হার্টের মাংসপেশির একাংশে রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই অংশ অক্সিজেন পায় না, তার কোষ-কলার মৃত্যু ঘটে। বুকে ব্যথা বা চাপ ভাব, শরীরের ওপরের অংশে অস্বস্তি, শ্বাসকষ্ট—এই উপসর্গগুলো থাকলে হার্ট অ্যাটাক সন্দেহ করতে হবে।
- হার্ট ফেলিওর বা হার্টের বিকলতাঃ এই অবস্থায় হার্ট শরীরের প্রয়োজন মেটানোর মত যথেষ্ট রক্ত পাম্প করতে পারে না। শ্বাসকষ্ট হয়, দুর্বল লাগে, গোড়ালি-পা-পেট ফুলে যায়, গলার শিরা ফুলে থাকে।
- প্রান্তীয় ধমনীর রোগঃ এই রোগে পায়ের ধমনীগুলোতে চড়া পড়ে, ফলে রক্ত প্রবাহ কমে যায়। হাঁটলে বা সিঁড়ি চড়লে পায়ের পাতা, পা, পাছায় ব্যথা, খিঁচ, অবশ ভাব, ভারী ভাব হয়।
- স্ট্রোকঃ এতে মস্তিষ্কের ধমনী অবরুদ্ধ হয় বা ফেটে যায়। হঠাৎ করে হওয়া কমজোরি, মুখ-হাত-পায়ে পক্ষাঘাত বা অসাড় ভাব, কথা বলতে অসুবিধা, দেখতে অসুবিধা—এই সব হল স্ট্রোকের উপসর্গ।
- এছাড়া স্মৃতিশক্তি খোয়ানো, কথা বলার সময় শব্দ খুঁজে না পাওয়া, কথাবার্তার সময় খেই হারানো—এই সবও উচ্চরক্তচাপের জটিলতা হতে পারে।
মনে রাখবেন—এই জটিলতাগুলো কিন্তু স্থায়ী, বেশির ভাগেরই তেমন চিকিৎসা নেই। তাই উচ্চরক্তচাপ আছে কিনা নিশ্চিত হওয়া, উচ্চরক্তচাপ পাওয়া গেলে তার চিকিৎসা করা—এটাই বাঞ্ছনীয়। আর মনে রাখবেন উচ্চরক্তচাপ এমন একটা রোগ যা সারানো যায় না, রক্তচাপ কেবল নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তাই ভালো আছি বা রক্তচাপ কম আছে ভেবে ওষুধ বন্ধ করা বোকামির কাজ।