আমার বয়স হয়েছে। স্মৃতিচারণই এখন আমার প্রিয় অবকাশ যাপন। মনে পড়ে ছোটোবেলায় ঝাল লাগতো বলে ভেতরের তরকারিটা না খেয়ে সিঙাড়ার শক্ত শক্ত তিনটে কোণা খেয়ে রেখে দিতাম। আবার কতো কথা ভুলেও যাই।
হাসপাতাল থেকে ফিরে মা যখন রান্নাঘরে বসে ডাল রান্না করতো। তখন বাবা তৎকালীন সরকারের বিরাগভাজন হয়ে বহুদূর কোনদেশে বদলি হয়ে আছে। মা তখন বলতো– তপ্পি এই দ্যাখ এবার ডালটা সাঁৎলাবো। কিন্তু সাঁৎলানোটা ঠিক কিভাবে হতো এখন আর মনে পড়ে না।
যাকগে এসব ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা। আমার ডাক্তারি জীবনের কিছু ভুল নিয়ে এই অধ্যায় শুরু করছি।
তখন আমার বহু বহু রোগী। সন্ধেবেলা তিনটে দোকানে বসি। একটা বাঁশদ্রোণীতে একটা গড়িয়া স্টেশনে আর একটা রামগড়ে। এছাড়া সপ্তাহে দুদিন দুপুরে যাই কাঁচড়াপাড়ায়। রামগড়ের দোকানটা ছিলো আমার সন্ধেবেলার শেষ ক্ষেপ। দোকানটা রাত এগারোটার সময় বন্ধ হতো। তারপর হৌসকল ইত্যাদি।
সেদিন প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। দোকানের কর্মচারী ছেলেগুলো সাইকেল করে বহুদূর থেকে আসতো। তারা সব চার বাই ছফুটিয়া চেম্বারের দরজায় উদ্বিগ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। একটি দম্পতি তাঁদের ষোলো বছরের একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। তখন যাওয়ার জন্য ব্যাগ আর মন দুটোই গুছিয়ে ফেলেছি। মেয়েটাকে একটু দেখে দিয়ে যান ওর বুকে মাঝে মাঝে ব্যথা আর কাশি হয়। নাছোড় দম্পতি আমাকে দেখাবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
হাসিমুখে ব্যাজার মনে স্টেথো বার করে বুকে বসালাম। সম্ভবতঃ কানে ইয়ারপিস লাগানোই হয়নি। গম্ভীর মুখে খসখস করে একটা এক্সরে করতে লিখে বেরিয়ে এলাম। সকালে তখন প্রথমে বোধহয় গড়িয়া মোড়ে বসতাম। যাহোক কচুপোড়া কোথাও নিশ্চয়ই একটা বসতাম, এ্যাতো রুজনামচা মনে রাখতে পারি নাকো। ছবিতে দেখি মেয়েটির ডানদিকের ফুসফুস ভর্তি জল। দিব্য টলটলে জলের ওপরের সমান একটা সরলরেখা সম জলতল । আমি আজ সুপ্তোত্থিত, টাটকা কুমড়ো ফুলের মতো সতেজ। সব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে জল পরীক্ষা এবং জল বার করতে পাঠালাম। তারপর সহজ গল্প। ন’মাস পরে মেয়ে সুস্থ। মেয়েটার মা আমাকে ঔদরিক জেনে পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খেতে নেমন্তন্ন করলেন। কিন্তু আমি জানি, অধৈর্য হয়ে আমি স্টেথো ঠিক করে বসাতে ভুলে গেছিলাম। লজ্জায় আর গোবদা গোবদা পাবদা মাছ খেতে যেতে পারিনি।
দ্বিতীয় ভুল :- একটি হত দরিদ্র মেয়ে ভয়ে ভয়ে সকালের চেম্বারে ঢুকলো। অনেক জিজ্ঞাসায় জানা গেল ওর বর ওকে একটা থাপ্পড় মারে এবং তারপর থেকেই ওর পায়ের জোর কমে যাচ্ছে। আমি বিশেষ কোনও রোগ খুঁজে পাই নি। কদিন পরে আবার এলো শ্বাসকষ্ট নিয়ে। তখন পা প্রায় অবশ। এবার ভালো করে জিজ্ঞেস করে জানলাম আগে কয়েকদিন জ্বর ছিলো। গুলিয়ান বারি। একটা রোগের সমষ্টি। জ্বরের পরে হয়। ক্রমশঃ সমস্ত পেশী প্যারালাইসিস হয়ে যায়। পিজি হাসপাতালে একমাস ভেন্টিলেশনে ছিলো। তারপর বেচারি মারা যায়।
এভাবেই কতো কিছু শিখতে শিখতে চলি। তবু তো ভুল ভুলই। এই আমাদের জীবন। শুধু ব্যর্থতাগুলো মাথায় গেঁথে রাখতে হয় যাতে এর আর পুনরাবৃত্তি না হয়।
একদিন সন্ধ্যায় একটা ফোন এলো – এক ডাক্তারি বইয়ের মাস্টারমশাই লেখকের নাতি। মিলিটারিতে কাজ করে জ্বর হয়েছে বলে পানাগড় থেকে আমার কাছে আসছে। ওর পায়ে জোর কমে যাচ্ছে। আমি এবার আর ভুল করি নি। স্টেশন থেকেই আর্মি হাসপাতালে পাঠাই। গুলিয়ান বারি। সে বেঁচে আছে।
তৃতীয় ভুলটা বলতে পারেন ইচ্ছাকৃত। আমি কোনোদিনই গরীবদের কাছ থেকে পয়সা নিইনি। হঠাৎ একদিন কি জানি কি এলো চিত্তে। ঠিক করলাম সপ্তাহে একদিন আমি গরীব মানুষদের বিনা পয়সায় দেখবো এবং যথাসম্ভব ওষুধ বিষুধ দেবো, সম্ভব হলে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা আপন খরচে করে দেবো। সে পোচুর ভীড় হতো। পরে দেখলাম পাড়ার ডাকসাইটে সব বড়লোকেরা এবং বড়লোকের বিটিরা গাড়ি চেপে বিনি মাগনার ভোজ স্যরি চিকিৎসা পেতে হাজির হচ্ছে। হোমিওপ্যাথি দোকানের ইন্দ্রজিৎ বললো আপনি কাদের বিনা পয়সায় দেখছেন? আমিও বুঝলাম আমি কাদের বিনা পয়সায় দেখছি। অতএব বন্ধ হলো বেষ্পতিবারের ক্লিনিক।
এরপর পোতিদিনই গরীব রোগীদের বিনা পয়সায় দেখা আর পয়সাওয়ালাদের পয়সা নিয়ে দেখা আরম্ভ করলাম। আজ যখন প্রদোষকালে ঝঞ্ঝাবাতাসে ব্যাঙ্ক সুদহীন তখন একদিন হিসেবে বসলাম দিনে অন্ততঃ চারজন ফ্রি। সুতরাং দিনে দুহাজার টাকা অনুদান। মাসে ষাঠ হাজার। বছরে সাত লক্ষ কুড়ি হাজার। এই তিরিশ বছরে অন্ততঃ দুকোটি ষোলো লক্ষ। না আমি হতাশ হাহুতাশ করছি না কিন্তু এরপরেও যখন এই ফ্রি পেশেন্টদের সামনেই পাড়ার দাদাবাবুরা আমার সস্তা জামার চিমসে কলার ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে ধমকি দেয় আর আমি জিভ বার করে হাঁফাতে থাকি তখন মনে হয় কবে যে কোথায় কী যে হোলো ভুল, জীবন জুয়ায় হেরে গেলাম। এবং আমি কখন আবার এসে রোগী দেখবো সেই আশায় সবাই বসে আছে পথ চেয়ে ফাগুনের …..
মরুগ্গে সব সময় কাব্য ভালো লাগে না কিন্তু তবুও তবুও তবুও তবুও দিল মাঙে মোর। না আমি টাকা পয়সার কথা ভেবে কাতর নৈ। এবং কমলদিদি প্রদীপ নাইয়া, সন্ধ্যা, আবদুলভাই, শেফালীবিবিদের এই ফ্রি ক্লিনিক থেকেই পেয়েছি। দুঃখ করিনা। কিন্তু… একটু কোথায় যেন খোঁচা লাগে।
এরপর আসে হৌসকল। আগে সময় অসময় না মেনে টাকার হিসেব না করেই রাত দুপুরে ভর দুপুরে দুচাকাবাহন হয়ে দৌড়তাম পুটিয়ারি, হরিনাভী, নতুনহাট, থেকে বারুইপুর। দিন নেই রাত নেই ফোনে উপদেশ। মাঝ রাতে ফোন :-ঘুম আসছে না। বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে:- বেশী খেয়েছি। মাঝে মাঝে একটা দুটো সত্যিকারের হার্ট অ্যাটাক সেরিব্রাল রোগী পেতাম। মনে হোতা যাক কারো হয়তো উপকার হলো।
এরপর অসুস্থ হয়ে ফোনে বিস্তারিত না বলতে পারার অপরাধে যার বাড়ি সব প্রয়োজনে গেছি, সব ফোন ধরেছি, সেই মানুষ যখন ফেসবুকে মন্তব্য ভাসাতে লাগলেন তখন বুঝলাম এ বড়ো কঠিন ঠাঁই। রাইডিং দ্য টাইগার। যতক্ষণ চেপে আছি ততক্ষণ বাঘ আমার কথা শুনবে। যেই মাত্র বাঘের পিঠ থেকে নামবো ঐ বাঘই আমায় খাবে।
আজ শয্যাপটাং হয়ে যে বাস্তব দেখলাম তাতে বোধহয় বেদনা পাওয়ার ক্ষমতাও চলে গেল।
১৯/১১/২০২০
এমন অনেক ছোট ছোট ভুল দিয়ে আমাদের ডাক্তারি জীবনের ডায়েরির পাতা ভরা ।
এখন দেখি ভুলই বেশী–সরকারি হাসপাতালে ফিজিশিয়ান স্যাম্পেলের স্তুপ নিয়ে বসতাম অভাবী রোগিদের জন্য–বিলি করতাম –সিনিয়ররা বারণ করেছিলেন । শুনিনি –মহৎ হবার নেশায় ।।তারপর ঠেকে শিখলাম ।
এমন অনেক গল্প আছে ।।
একদম ঠিক।