বলিউড থেকে বিরিয়ানি, রাজনীতি থেকে রং-তুলি সব লেখাতেই যিনি সমান সাবলীল সেই চিকিৎসক-প্রাবন্ধিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল হকিকত নিয়ে কলম ধরলে যা হবার তাই হয়েছে। শক্ত মলাটে বন্দি সমকালীন সমস্যার দলিল। উপরি প্রাপ্তি কিছু সমাধানের খসড়া। ধরা পড়েছে অগণিত পীড়াদায়ক প্রশ্ন। সহজ, কঠিন, সামাজিক, রাজনৈতিক। চিকিৎসকের কলম থেকে বেরোলেও প্রশ্নগুলো কিন্তু আপনারও।
বন্ধু বিষাণ বসুর প্রথম বই। একটি সংকলন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত লেখালিখির একটি সমৃদ্ধ সম্ভার। শুরু থেকেই স্বতন্ত্র। বার্টল্ট বেশ্ট-এর যুগান্তকারী কবিতার বাংলারূপ দিয়ে শুরু। কবিতার মূল আকড় যদিও গৌতম বুদ্ধের “বার্নিং হাউস” প্যারাবল-এ। বলা বাহুল্য এখানে বাংলা অনুবাদক লেখক স্বয়ং। গোটা বইয়ের মধ্যেই রয়েছে গভীর ভাবনার প্রকাশ। কৃষ্ণেন্দু মুখার্জির অনবদ্য প্রচ্ছদই কিঞ্চিত ধারণা দেয় বিষয়বস্তু নিয়ে। শিরোনামে অনুচ্চারিত থাকলেও বাজার, পুঁজি, মুনাফা আর আপনার মধ্যে সরকার বাহাদুরের সরব উপস্থিতিও প্রতি অনুচ্ছেদেই প্রবল ভাবে ধরা দেয়।
আষাঢ়ে গল্পে পাঠকের মন ভেজে না। লেখা তথ্যনির্ভর হতেই হয়। কিন্তু কখনই মনে হয়নি তা তথ্যভারে ন্যুব্জ। জনস্বাস্থ্য নিয়ে এত অবহেলা কেনো? প্রতিরোধী (preventive) ও প্রাথমিক (primary) চিকিৎসা ছেড়ে রোগনির্ভর চিকিৎসায় অত্যধিক জোরের কারণ কি? ‘বৃহত্তর স্বার্থ’ নামক শব্দবন্ধের আড়ালে যে লগ্নিকারীর স্বার্থরক্ষার দুর্ভেদ্য কৌশল তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বারবার। ইকোলজি, ইকোনমি আর ইক্যুইটেবল হেল্থকেয়ার যে পরস্পর বিরোধী নয় তা কেনো রাষ্ট্রনায়কদের বোধগম্য হয় না। সংস্থান নয়, অভাব সদিচ্ছার। আবার ধর্মের মতোই বিজ্ঞানও যে রাষ্ট্রচালনার হাতিয়ার তার প্রমাণ মেলে এই লেখায়। স্বাস্থ্যকেই যখন নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মান্যতা দেওয়া হয়নি সে অবস্থাতেও লেখক দূষণমুক্ত পরিবেশের প্রতিশ্রুতি চেয়েছেন। উচ্চাশা মনে হলেও ভেবে দেখতে পারেন।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রসঙ্গে আপসহীন কথাবার্তায় উঠে এসেছে সরকারি উদাসীনতার কথাও। চুনোপুঁটি ধরতে গিয়ে আমরা যে রাঘব বোয়াল মিস করে যাচ্ছি! আলাদা কোনো চ্যাপ্টার নিবেদিত না হলেও বার বার শুনতে পাই স্বাস্থ্যের পণ্যায়নের বিরোধিতা। রেল, বিমান,ডাক ইত্যাদির মতো স্বাস্হ্যকেও একটি পরিষেবা হিসাবে ঢোক গেলানোর সুচারু আয়োজন কখনও সর্বজনীন স্বাস্হ্য এনে দিতে পারে না। খুব বেশি হলে জনগণের করের টাকায় সবার জন্য স্বাস্হ্যবিমা হতে পারে যেখানে সরকারের ভূমিকা থাকে বিমা কোম্পানীর ফড়ের মতো। সরাসরি যুক্ত নন এমন মানুষজনের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম অধিকাংশ স্বাস্হ্যকর্মীও এখনও ভাবতে পারেন না যে জনসাধারণের স্বাস্হ্যের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে এবং তা সরাসরি ভাবেই। অথবা ভাবলেও বলে উঠতে পারেন না। বিষাণ পেরেছেন।
রোগী চিকিৎসক কথোপকথন বা তাঁদের মধ্যস্থিত সম্পর্কের পেশাদারী ব্যবচ্ছেদ পাওয়া গেল। রোগী না হয় ক্রেতা হলেন কিন্তু আসল বিক্রেতাটি কে বা কারা? নিধিরাম ডাক্তার না কি পর্দার আড়ালে থাকা কর্পোরেটের সর্দার?
গুগল-বলে বলীয়ান রোগী নিজেকে ওয়াকিবহাল উপভোক্তা মনে করতে পারেন কিন্তু সত্যিই কি তিনি যথেষ্ট ইনফর্মড? স্বাস্হ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে ভায়োলেন্সের ‘রুট কজ অ্যানালিসিস’ হিসেবেও দেখতে পারেন এই বইকে। ক্ষোভ থাকলে অভিযোগ জানানোর হাজারো জানলা রয়েছে তবু মানুষ কেন মারমুখী। আর সেই উচ্ছৃংখল মানুষের বিরুদ্ধে প্রশাসনই বা কেনো নির্বিকার?
অমর্ত্য সেন মহাশয়ের কথা উঠে এসেছে সঙ্গতভাবেই। জমজমাট বিতর্কের চেয়ে বেশি দরকার স্বাস্হ্য নিয়ে “ইনফর্মড পাবলিক ডিসকাশন।” দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা স্বাস্থ্য সংকট কি চিকিৎসার আকাল নাকি শুধু চিকিৎসকের অভাব। স্বাস্হ্যকর্মীর সংখ্যাবৃদ্ধি আবশ্যিক কিন্তু সমস্যা যে আরো গভীরে। স্বাস্হ্যখাতে ব্যয়বৃদ্ধির দাবিতে বা জনস্বাস্থ্য প্রসঙ্গে মিডিয়া মুখর নয় কেনো? গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায় জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি বা জাতীয় মেডিকেল কমিশনের উল্লেখ ব্যতিরেকে। বিষাণ সেখানেও দেখিয়েছেন স্বভাবসিদ্ধ পারদর্শিতা।
চিকিৎসকের মুখ ঠিক কতখানি মানবিক হওয়া উচিত বা সম্ভব সে বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। সংবেদনশীল লেখক বহুচর্চিত এই বিষয়েও যথাসম্ভব নিরপেক্ষতার ছাপ রাখতে পেরেছেন। তবে ‘ওস্তাদের মার’ পড়েছে একেবারে শেষ রাতে। অদৃশ্য অথচ প্রবল পরাক্রমী ‘সিস্টেম’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে উপসংহারে। এ নিয়ে অযথা বাক্যব্যয় আপনার রসভঙ্গ ঘটাতে পারে। অতএব পড়ে ফেলুন বইটা। প্রাঞ্জল ভাষায় ছোট ছোট পর্বে বিভক্ত শ’দেড়েক পাতার বই পড়তেও বেশি সময় লাগে না। তবে পড়ার পর একটা ভাবনার রেশ থেকে যেতে পারে। অতএব সাধু সাবধান।
রোগীদরদী একজন চিকিৎসক-ইনসাইডারের পক্ষেই হয়তো এই গভীরতায় পৌঁছনো সম্ভব। তবে সংকলনধর্মী পুস্তকে যেমন কিছু পুনরাবৃত্তি অবশ্যম্ভাবী এখানেও কিছু উদ্ধৃতি বা প্রেক্ষিতের পুনরুচ্চারণ হয়েছে। যদিও কখনো তা ক্লান্তিকর মনে হয় নি। কিছু মুদ্রণপ্রমাদ মেনে নিতেই হয়। তবে রকফেলার সাহেবের নাম ও জন্মসনে ভ্রম এড়াতে পারলে ভালো হতো। সবশেষে একটি বিনয়ী প্রশ্ন। “কিনে আনা স্বাস্হ্য” এর বদলে “বেচে দেওয়া স্বাস্হ্য” বললে কি খুব ভুল বলা হবে? কারণ ভূমিকাতেই তো বলা হয়ে গেছে বেশিরভাগটাই ‘ডেলিবারেট’।