ফেলুদা থাকলে বলত, -গোলমাল, বিস্তর গোলমাল। মিলছে না রে, তোপসে !
একটি অচেনা মানুষ/প্রাণী আমাদের বাড়িতে বা পাড়ায় এলে সে বন্ধু না শত্রু সেটা আমরা বিচার করি আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।এ বং সেই অনুযায়ী আমাদের প্রতিক্রিয়া নির্ধারিত হয়। তাই তো ?
যেমন কোনো বাঘ দেখলে আমাদের যা প্রতিক্রিয়া হয়, একটু গরু বা ছাগল দেখলে তা হয় না !
মানুষের অন্তর্নিহিত প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ (immune training) ব্যাপারটাও তাই !
ব্যাপারটা কি এতই সহজ?
না ! ইমিউন সিস্টেমের একাধিক শাখা-প্রশাখার জটিল জাল এর সঙ্গে জড়িত, আর তাই পুরো ব্যাপারটা এখনও খুব ভালভাবে আদৌ বুঝে ওঠা যায় নি ।
সুতরাং একটি গবেষণা পত্রের একটি অংশ নিয়ে টি আর পি সহায়ক খুব আকর্ষণীয় শিরোনাম হতে পারে তবে SARS-COV- 2-র ক্ষেত্রে সেটা শেষ পর্যন্ত অন্ধের হস্তী-দর্শনই হয়ে দাঁড়ায় !
‘হাইজিন হাইপোথিসিস’ কথাটির মানে হলো, যে দেশ যত নোংরা, দূষিত সেই দেশ কোভিড অতিমারী থেকে তত নিরাপদ !
উপরের গ্রাফটি দেখলেই বুঝতে পারবো অতটা সিধে সাদা, সরল রৈখিক নয় !
এই গ্রাফ অনুযায়ী ভারতে মৃত্যুহার সর্বনিম্ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৃত্যুহার ভারতের চেয়ে একধাপ ওপরে!
কিন্তু যদি দূষিত স্বাস্থ্যবিধি, জলের গুণগত মান স্বল্প মৃত্যুর হারের সাথে সরাসরি সমানুপাতিক হয় তবে আমরা ব্রাজিল এবং মেক্সিকোর পরিসংখ্যানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব?
তাদের মৃত্যুর হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বেশি কেন ?
স্বচ্ছ ভারতের স্লোগান কতদূর বাস্তবায়িত হয়েছে সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, সার্বিক স্যানিটেশন, জলের গুণমান এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে ভারত অবশ্যই খুব ভালো জায়গায় নেই !
গ্রাফে দেখা যাচ্ছে ভারতে কোভিড জনিত মৃত্যুহারও সর্বনিম্নে ।
খুব আনন্দের কথা !
যত অনুন্নত, নোংরা দেশ, কোভিড মৃত্যুহার তত কম!
যত উন্নত, পরিচ্ছন্ন দেশ, মৃত্যুহার তত বেশি!
কিন্তু, তাই যদি হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশগুলির তুলনায় মেক্সিকো এবং ব্রাজিলের জলের গুণমান এবং স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চয়ই ভালো না, কিন্তু কোভিড মৃত্যুহার সেখানে বেশি কেন ?
আবার কোভিড মৃত্যুহার যে দেশে সবচেয়ে বেশি, সেই ইতালি নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যবিধি অথবা সবচেয়ে প্রতিশ্রুত জলের দাবীদার নয় !
তাহলে এটা বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা আদৌ একমাত্রিক নয় !
উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা, বিশেষ করে শহুরে হাইরাইজের অধিবাসীরা কি সত্যি বেশি কোভিডে আক্ৰান্ত হচ্ছেন?
বস্তির গরিব-গুর্বো মানুষদের মধ্যে বা প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে রাজধানী বা জেলা শহরগুলির তুলনায় সংক্রমণের হার কি সত্যিই কম ?
যদি তাই হয় তাহলে কেন ?
‘হাইজিন হাইপোথিসিসের’ ঐকিক নিয়মে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁরা আফ্রিকায় সাহারার দক্ষিণের দরিদ্রতম দেশগুলির উদাহরণ টানেন ! সেখানে অথবা পাকিস্তান, নেপাল এমনকি বাংলাদেশেও কোভিড পরিস্থিতি কখনোই তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত পশ্চিম ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত অসহায় নয়!
আবার যাঁরা সে থিয়োরি মানেন না তাঁরা আমাদের দেখিয়ে দেন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড অনেক পরিচ্ছন্ন, এবং সব দিক থেকেই অনেক উন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের কোভিড পরিসংখ্যান তাক লাগিয়ে দেবার মত!
চীন, ভিয়েতনামও কিন্তু পোষ মানিয়ে ফেলেছে এই বিশ্বত্রাস ভাইরাসটিকে!
কোভিডে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সব চেয়ে বেশি আক্ৰান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা ওদেশেই সর্বাধিক !
পরিচ্ছন্নতা, উন্নত স্বাস্থ্যবিধি, পরিশ্রুত জল এই সব বিষয়েই তারা অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে!
অতএব, হাইজিন হাইপোথিসিসের জয়!
বেশ! তবে পড়শি কানাডা নিয়ে কি বলবেন? পরিচ্ছন্নতা, উন্নত স্বাস্থ্যবিধি, পরিশ্রুত জল এই সবের নিরিখে তারা মার্কিন দেশের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নয়! বরং, কোনো কোনো ক্ষেত্রে, এগিয়েই! আয়তনেও তারা আমেরিকার চেয়ে বড়ো!
কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি সেখানে অনেক ভালো !
কেন?
অতএব সেই ফেলু মিত্তির উবাচ
-গোলমাল, বিস্তর গোলমাল। মিলছে না রে, তোপসে!
আর একটা কথা।
কোভিডে আক্রান্তের হার আর মৃত্যুহারের কিন্তু কোনো সাযুজ্য নেই! মানে এটা বাড়লে ওটাও বাড়বে বা ওটা কমলে এটা কমবে, তা কিন্তু আদৌ নয় !
ইউরোপের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা এর উদাহরণ।
পশ্চিম ইউরোপ এই মুহুর্তে দ্বিতীয় তরঙ্গের শীর্ষে উঠছে, মুখোমুখি হচ্ছে তীব্র স্পাইকের । অথচ মৃত্যুহার সে সব দেশে প্রথম তরঙ্গের তুলনায় কম!
পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে এখনও সেভাবে আছড়ে পড়েনি দ্বিতীয় তরঙ্গ, অথচ মৃত্যুর হার আকাশ ছুঁতে চলেছে !এই বেয়াড়া ব্যাপারটা কপালে ভাঁজ ফেলছে চিকিৎসকদের, গবেষকদের ।
ভারত মনে করা হচ্ছে প্রথম তরঙ্গ পেরিয়ে এসেছে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি । দৈনিক প্রায় এক লক্ষ নতুন সংক্রমণ থেকে অনেকটাই নেমে আপাতত দিনে হাজার পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশের আশেপাশেই থাকছে সংখ্যাটা !
পুজো, ছট, ঈদ, দিওয়ালি পেরিয়ে শীতের শুরুতে দ্বিতীয় তরঙ্গ ঠিক কবে আসবে, বা কতটাই বা ভয়ঙ্কর হবে তার বিস্তার আমরা এখনো জানি না!
আমরা জানি না, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে মৃত্যুহার হ্ৰাস পেলেও পূর্ব ইউরোপে কেন তা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে ?
বোঝাই যাচ্ছে , কোভিড যাকে বলে ওপেন এবং শাট কেস, তা আদৌ নয় !
কোভিডের রোগ লক্ষণ বিভিন্ন মানুষে বিভিন্ন ভাবে দেখা দেয়! জ্বর, কাশি, গলাব্যথা শ্বাসকষ্ট মানেই যে কারো কোভিডই হয়েছে এটা ভাবার যেমন কোনো কারণ নেই, ঠিক তেমনি, এই রোগ লক্ষণগুলি নেই বলেই যে কোভিড নয়, এমনও নয় !
গায়ে আমবাতের মত চুলকানি, গা বমি ভাব, জিভে স্বাদ না পাওয়া, গন্ধ না পাওয়া, গায়ে পিঠে ব্যথা, ঝিমুনি ভাব, ডায়ারিয়া, মাথা ব্যথা এমনকি মানসিক বিভ্রান্তিও কোভিদের উপসর্গ হতে পারে ।
বিভিন্ন দেশ, বা একটি দেশের বিভিন্ন রাজ্য অথবা একটি রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল এমনকি একটি অঞ্চলের বিভিন্ন আক্রান্ত মানুষ রোগ সংত্রান্ত বিভিন্ন ধরণের পরিস্থিতির সামনে পড়ছে !
কোভিড নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসে নি।
লার্নিং কথাটার মানে যদি শেখা হয়, আনলার্নিং কথাটার সেরকম যুৎসই কোন বাংলা প্রতিশব্দ নেই।
আর আসন্ন মাস এবং বছরগুলিতে বিভিন্ন দফায় কোভিড নিয়ে অনেক শেখা জিনিস নির্দ্বিধায়, লজ্জাহীন ভাবে ভোলা, এবং অনেক অজানা জিনিস জানা, শেখা আমাদের বাকি আছে !
https://www.newindianexpress.com/thesundaystandard/2020/oct/25/poor-hygiene-water-quality-can-lower-covid-19-fatality-rate-says-study-2214679.html