বেশ কিছুদিন হ’ল হাসপাতালে আবার পুরোদমে কাজ করতে শুরু করেছি। নাইট ডিউটি, অনকল, অ্যাডমিশন ডে.. ইত্যাদি প্রভৃতি মিলিয়ে যেমন যা হয় আর কী..
প্রতি বছরই এই সময়টায় শ্বাসকষ্টের সমস্যাগুলো বাড়ে। বুকের ইনফেকশন, হাঁপানি, দীর্ঘদিনের শ্বাসকষ্টের রোগ, ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি ইত্যাদি সবকিছুই মারাত্মক ভাবে বেড়ে যায়। তবে তার মধ্যেও কিছু কিছু বছরে কোনও বিশেষ রোগ বিপজ্জনক আকার নেয়। যেমন, এ বছর ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব তুলনামূলক ভাবে কম। স্বাভাবিক ভাবেই ডেঙ্গি নিয়ে অন্যান্য বছরের মতো হইচই নেই। কিন্তু, উল্টোদিকে ভয়ের ব্যাপারও আছে। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় মনে হয়- এ বছর শ্বাসকষ্টের রোগ ভয়াবহ হতে যাচ্ছে। শেষ সপ্তাহ দুয়েক সময়ে প্রচুর শিশু, বিশেষত এক বছরের কম বয়সী বাচ্চারা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। এবং, বেশ আশঙ্কাজনক অবস্থায়। সময় গড়ালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলেই আমার ধারণা। শিশু, শিশুর পরিবার কিংবা অসুস্থ শিশুর চিকিৎসায় নিযুক্ত স্বাস্থ্যকর্মী- সবার জন্যই সেটা ভয়ের ব্যাপার।
এখন হাসপাতালে বাচ্চা ভর্তি হচ্ছে মানেই ধরে নিতে হবে বেশিরভাগই সাংঘাতিক শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসছে। নাইট ডিউটিতে দুচোখের পাতা এক করার উপায় নেই। এ ওয়ার্ড থেকে ও ওয়ার্ড অনবরত ছুটে যেতে হয়। সব জায়গায় বাচ্চাগুলো হাঁফাচ্ছে! বুকের হাঁপর দ্রুত উঠছে নামছে, নাক বন্ধ, জ্বর আসছে, মায়ের দুধ টেনে খেতে পারছে না, মায়েদের অসহায় কান্নাকাটি, বাড়ির লোকের উদ্বিগ্ন চাউনি.. সব মিলিয়ে এখনই সিঁদুরে মেঘ দেখছি আমি। কোভিড পরিস্থিতির জন্য দ্রুত সব ধরনের চিকিৎসাও শুরু করা মুশকিল। অগত্যা মরচে পড়া তলোয়ার হাতে শ্বাসকষ্ট-দানবের মুখোমুখি হওয়া।
ঘুম না হওয়া রক্তচোখ আর কিচ্ছু দেখতে চায় না। ক্লান্ত শরীর টেনে নিয়ে ছুটে যাই। শরীরের শেষটুকু নিংড়ে নেওয়া- চ্যানেল, ব্লাড স্যাম্পল, মেডিসিন স্লিপ, রিকুইজিশন, অ্যাডভাইস, অবজার্ভেশন, এক্স-রে, ইনহেলার, ইঞ্জেকশনের কঠিন, কঠোর দুনিয়ায়।
তার মধ্যেই কিছু ‘ইয়ে’রাও ভর্তি হয়েছেন। আট নম্বর ওয়ার্ডের ভদ্রমহিলার প্রায় উত্তেজিত চিৎকার.. – বলছি ডক্টর, সোহমের ব্লাড রিপোর্টস কারেক্ট আছে তো?
– হ্যাঁ, মোটামুটি। সকালেই তো আপনাকে সব বললাম।
– আচ্ছা, ওর প্লেটলেট দু লাখের ওপরে থাকে সবসময়। এবার এক লাখ সত্তর হাজার হয়ে গেল কেন?
– ঠিকই আছে। নর্মাল।
– আচ্ছা সি আর পি ঠিক আছে?
– রিপিট রিপোর্টে সবই মোটামুটি ঠিক আছে।
– আর ই এস আর?
– ন’নম্বর ওয়ার্ডে বাচ্চা খারাপ আছে। এভাবে এত কথা বলার মতো সময় নেই। আপনি সকালের মিটে এসে সব জেনে নেবেন। আমাকে এখন যেতে হবে। বাচ্চার এই মুহূর্তে নতুন করে কোনও সমস্যা নেই তো?
– দেখুন না, কিছুতেই বেদানা খাচ্ছে না..
ততক্ষণে মনের মধ্যে যেগুলো ভুটভুট করছে সেগুলো খুব শ্রুতিমধুর নয়। তবু মাথা যথাসম্ভব ঠান্ডা রাখতে হয়।
– একদিন বেদানা না খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। বাচ্চার এখন কোনও কষ্ট আছে?
– আচ্ছা, আপেল সেদ্ধ খাবে না গোটা?
এরপর আর দাঁড়ানো চলে না। বেরিয়ে আসার সময় পেছন থেকে শুনতে পাই-
– দেখলেন? এখনকার ডাক্তারদের ব্যবহারটা দেখুন.. এত্ত দেমাক.. এমনি কী আর..
বহুদিন এসবে কান দেওয়ার আগ্রহ হারিয়েছি। ন’নম্বরের বাচ্চাকে ওষুধপত্র, ইঞ্জেকশন দিয়ে কিছুটা সামাল দিতে না দিতে দশ নম্বর থেকে ডাক এলো। বাচ্চার শ্বাসের গতি ভয়ানক খারাপ। রক্তে অক্সিজেন কমছে। হার্টের অবস্থাও সুবিধের নয়। হঠাৎ হার্ট বন্ধ! ডাক্তার-নার্স মিলিয়ে চার-পাঁচজনের হিমশিম অবস্থা! কোনোমতে গলায় নল পরিয়ে, হার্টের গতি বাড়ানোর ওষুধপত্র নিয়ে আপাতত সামাল দেওয়া হ’ল।
দরদর করে ঘামছি। গলা শুকিয়ে কাঠ। বাইরে ভোরের আলো ফুটছে। আবার অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ.. আবার ‘ডাক্তারবাবু, সাতে নতুন পেশেন্ট এসেছে..’
এভাবেই প্রতিদিন।
**
দীপাবলি আসছে। এই পরিস্থিতিতে যদি বাজির ধোঁওয়া এসে যোগ হয় তাহলে কী হবে ভাবলেই শিউরে উঠছি। আপনার বাড়ির কিংবা পাশের বাড়ির ফুটফুটে শিশুটির কথা চিন্তা করুন। বাচ্চাটা শ্বাসকষ্টে হাঁফাচ্ছে আর হাসপাতালে বেড পাওয়া যাচ্ছে না..
এমনিতেও এই মারী পরিস্থিতিতে, এই কান্না আর অসহায়তার দেশে, এই কাজ হারানো আর অনাহারের দুনিয়ায় বাজি আর আলোর উৎসব অশ্লীল। হ্যাঁ, অশ্লীল। অন্তত এ বছর। সরকার থেকে চিকিৎসক সংগঠন সবাই বাজি না পোড়ানোর আবেদন রেখেছেন। সে ধরনের আবেদন অবশ্য মাস্ক পরা বা অকারণে ভিড় না করা ইত্যাদি অনেককিছুর জন্যই আছে। ফলাফল.. থাক, সে কথা।
আমি আবার একটু আশার কথাও ভাবছি। যদিও পুরোটাই আমার কাঁচা মাথার ব্যক্তিগত ধারণা। জীবাণুবিদ্যার সাধারণ ধারণা বলে, শরীরের মধ্যেই হোক বা পরিবেশে.. দু’রকম জীবাণু সাধারণত একই সাথে মৌরসীপাট্টা গড়তে পারে না। এক ধরনের জীবাণুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেলে অন্যটাকে সরে যেতে হয়। ওই অনেকটা এক বনে দুই বাঘ না থাকার মতো ব্যাপার। সেই হিসেবে, শ্বাসকষ্টের পরিচিত জীবাণুর প্রাদুর্ভাব করোনার প্রকোপ কমিয়ে দেবে কি? আমি এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই। কোভিড নিয়ে এ যাবৎ অনেকেই অনেককিছু ভেবেছিলেন। বলাই বাহুল্য, তাদের বেশিরভাগকেই খান পাঁচেক গোল দিয়ে কোভিড এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অতয়েব, পরিবর্তিত পরিস্থিতি কী হবে সেটা সময়ই বলবে।
কিন্তু বাজির ধোঁওয়া এবং সেই সংক্রান্ত বায়ুদূষণ রোধ.. এটা আমরা চাইলেই পারি। মারীর দেশের শিশুদের হাসিমুখের জন্য এটুকু কি খুব বেশি চাওয়া?