মুখোশবন্ধ :-
চিকিৎসা ব্যবসায়ে দীর্ঘ জীবন প্রায় অতিক্রান্ত অথচ চিরকালই সদ্য মায়েদের চেম্বার থেকে হুশ হুশ করে বিদায় করেছি। আমি এসব কিছু জানি না বলে। সত্যিই কি কিছুই করতে পারতাম না? হয়তো সদ্যজাতের চিকিৎসা জানি না কিন্তু সহজ কিছু জানিয়ে তো তাঁদের ভয় ভাঙাতে পারতাম! কনজ্যুমার ফোরাম আর বিশেষজ্ঞদের ভিড়ে হয়তো ভয় পেতাম। আজ বিদায়বেলায় শয্যাপটাং অবস্থায় কিছুটা পাপস্খালন করা যাক। তাই এই মুখোশবন্ধের অবতারণা।
খাওয়া দাওয়া :-
মায়েরা সব সময়ই একটা গভীর চিন্তায় থাকেন – আহা আমার সদ্যজাত বাচ্চাটার পেট ভরছে তো? সঙ্গে একটু কি বেবি ফুড খাওয়াবো? প্রথমেই জেনে রাখা ভালো শিশুর জন্য মায়ের দুধই সেরা খাবার। এবং প্রথম ছ মাস মায়ের দুধ ছাড়া আর কিচ্ছু (এমনকি জলও) খাওয়ানো চলবে না।
কেন সেটা জানতে চাইছেন?
মায়ের প্রথম দুধে যে কলোস্ট্রাম থাকে সেটা শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়াও মায়ের দুধ সহজ পাচ্য খাদ্যগুণ, প্রোটিন ভরপুর সঙ্গে থাকে প্রচুর ইম্যুনোগ্লোবিউলিন যেটা আবার শিশুকে প্রতিরোধ ক্ষমতা জোগায়। এর ফলে প্রথম ছ মাস শিশুর ভাইরাল বা ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশনের সম্ভাবনা কমে যায় এছাড়া কানের ইনফেকশন এবং ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স হয় না এবং সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ কম ঘটে। দেখা গেছে যে সব বাচ্চা প্রথম ছ মাস কেবল মাতৃদুগ্ধের ওপর ছিলো তাদের হাঁপানি এবং এ্যালার্জি কম হয়। আর এরকম মায়েদের ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যানসার ও ওভারিয়ান ক্যানসারের সম্ভাবনা কমে যায়।
কতোটা খাওয়াবো ?
তাহলে জানতে হবে যে একটা সদ্যজাত শিশুর পাকস্থলী কতো বড়ো? শুনতে আশ্চর্য লাগবে যে সদ্যজাতের পাকস্থলী কেবলমাত্র একটা বড়ো মার্বেলের মাপের। তার মানে ক্ষুদেটা সাত থেকে বারো এমএল (ml) দুধ একবারে খেতে পারবে । তার বেশী নয় ।
কিন্তু বুঝবো কি করে যে বাচ্চার পেট ভরেছে?
দুধ খাওয়ার সময় বাচ্চা হাত দুটো মুঠো পাকিয়ে রাখবে যেই মাত্র পেট ভরবে মুঠো ঢিলে হয়ে বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়বে ।
কতক্ষণ পরে আবার খাওয়াতে হবে?
চমৎকার প্রশ্ন। আবার যখন খেতে চাইবে তখন (এটা কিন্তু বড় হলেও প্রযোজ্য অর্থাৎ নিজে নিজে খাওয়ার বয়স হলে। বড়ো বাচ্চাদের ক্ষিদে পেলে খেতে দিন এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পরে থালা উঠিয়ে নেবেন। আর দুটো খাওয়ার মধ্যে কিছু খাওয়াবেন না) সাধারণতঃ সদ্যজাত শিশু এক থেকে তিন ঘন্টা পরে আবার খেতে চাইবে। কেন না মায়ের দুধ অতি সহজেই হজম হয়ে যায়। তিন চার দিন বয়স হলে পাকস্থলীটা একটা আখরোটের মতো মাপের হবে। তখন তিরিশ থেকে চল্লিশ মিলি দুধ খেতে পারবে। সেই সময় পর্যায়ক্রমে দুদিকের দুধই খাওয়াতে হব। তিন চারদিন পর থেকেই মাতৃদুগ্ধের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। অর্থাৎ শিশুর খাবারের অভাব হবে না।
এবার আমরা বাচ্চাদের পাকস্থলীর মাপ সম্পর্কে দুটো কথা বলি। এক সপ্তাহের পর খোবানি বা এ্যাপ্রিকট মাপের। একমাস বয়সে মুরগির ডিমের মতো, ছমাস থেকে এক বছর বয়সে মোসাম্বির (কন্টালোপ) মাপের।
ছ মাস থেকেই weaning অর্থাৎ স্বাভাবিক বা শক্ত খাবারে চলে যেতে হবে। এই সময় বাচ্চাদের একটু পেটের গন্ডগোল হতে পারে। এবং ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ হলে ফুটি’র মতো অর্থাৎ তখন তার ধারণ ক্ষমতা এক লিটার ।
এবারে বুঝি কতক্ষণ ধরে খাবে সেটা জানতে চাইছেন ?
প্রথম কয়েক দিন প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগতে পারে কেননা তখনও টেনে খাওয়ার পক্ষে শিশুর ফুসফুসের এবং পেশীর জোর যথেষ্ট হয়নি। এর পর যত তার চাহিদা বাড়বে সঙ্গে ফুসফুস এবং পেশীর জোরও বাড়বে। সুতরাং তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলবে এবং খাওয়ার সময় ক্রমশঃ কমতে থাকবে।
সুতরাং জোরাজুরি নয় শিশুকে নিজের মতো করে বড়ো হতে দিন ।
এরপর একটু বাজে কথা কিন্তু কাজের কথায় আসি ।
পায়খানা সম্বন্ধে দু কথা বা চার কথা
গোগোলসন্ধানী হবু মায়ের দল অনেক কিছু জানেন। ব্ল্যাক স্টুল বা কালো পায়খানা যে একটা ভয়ানক জিনিস সেটা সবাই জানেন। কিন্তু প্রথম কয়েকটা দিন বাচ্চাদের কালো কালো পায়খানা হতে পারে। মেকোনিয়াম জানেন? গর্ভাবস্থার শেষ দিকে শিশু যে পায়খানা করে সেটা আ্যামনওটিক ফ্লুইড মানে জলের সঙ্গে মিশে যেটা তৈরি হয় তাকে মেকোনিয়াম বলে। স্বভাবতই সেটা গর্ভস্থ শিশুর পেটে যায়। জন্মের পরে সেটা যখন পায়খানা হয়ে বেরোয় সেটা কালো রংয়ের হয়। বুঝলেন? সুতরাং এক্কেবারে নো চিন্তা।
কতোবার পায়খানা করবে ?
আট থেকে বারো বার। অর্থাৎ কিনা যতবার খাবে ততবারই ইয়ে করবে।
পায়খানাটা কেমন হবে জানবেন না?
প্রায় জলের মতো সঙ্গে কিছু কিছু গোল গোল টিকটিকির ডিমের মতো ফ্যাট গ্লোবিউল থাকবে। (অবশ্য যারা বেবি ফুড খাবে তাদের কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। তাদের জন্য এই লেখা নয়।)
এবং প্রচুর প্রচুর হিসি করবে। অবশ্যই সেটা স্থানীয় আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। গরম শুকনো আবহাওয়া হলে কম হিসি আর ভেজা কম গরম আবহায়ায় বেশী বেশী। সাধারণতঃ অল্প একটু হলুদ হতে পারে। তবে সাধারণ কটু গন্ধ যেটা বড়দের ক্ষেত্রে থাকে সেটা থাকবে না।
এবং মায়ের খাওয়া দাওয়ায় কোনও বারণ নেই। শুধু খেয়ে শরীর খারাপ না হলেই হলো। কেননা যদি শরীর খারাপ হয়ে ওষুধ খেতে হয় তাহলে কিন্তু আপনার শিশুও সেই ওষুধ খেতে বাধ্য হবে। মনে রাখবেন প্রায় সব ওষুধই দুধে নিঃসৃত হয়। ভাষাটা কঠিন হয়ে গেল? তাহলে বলি সিক্রিটেড হয়।
জন্ডিস ন্যাবা বা কামলা
সদ্যজাতের জন্ডিস একবার হওয়া উচিত। এটা স্বাভাবিক। সাধারণতঃ তিন চার দিনের মাথায় জন্ডিসটা হয়।
কেন?
গর্ভাবস্থায় এ্যামনিওটিক ফ্লুইডের মধ্যে ভাসমান শিশু আমাদের মতো অতো অক্সিজেন পায় না। ওরা প্ল্যাসেন্টা বা ফুল থেকে রক্তের মধ্যে দিয়ে অক্সিজেন পায়। তবু যাতে ওর সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন পায় তার জন্য একটা বিশেষ ব্যবস্থা আছে। ওদের হিমোগ্লোবিন একটু বিশেষ ধরনের হয় – তার নাম ফিটাল হিমোগ্লোবিন। এটা একটু অন্য রকম এবং এর অক্সিজেন বহন ক্ষমতা সাধারণ হিমোগ্লোবিনের থেকে চার গুণ বেশী। এবার জন্মের পর ঐ হিমোগ্লোবিন ভেঙে গিয়ে স্বাভাবিক বা অ্যাডাল্ট হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়। হিমোগ্লোবিন ভাঙলে তার একটা অংশ বিলিরুবিন হয়ে রক্তে মেশে।
বিলিরুবিন বাড়া মানে জন্ডিস। অথচ এই জন্ডিসটা না হলে ঐ ফিটাল হিমোগ্লোবিন রক্তেই থেকে যাবে। এই হিমোগ্লোবিন খুব ক্ষণজীবী এবং ভঙ্গুর। ফলে শিশুর প্রায়শই রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে। এই জন্ডিসে সাধারণতঃ শরীরের কোনও ক্ষতি হয় না। এবং আঠেরো ঊনিশ মাত্রা পর্যন্ত বিলিরুবিন বেড়ে যেতে পারে। চিকিৎসার প্রয়োজন হলে ডাক্তার বাবুই বলে দেবেন।
ইভনিং ক্রাই :-
সাধারণতঃ দু থেকে তিন মাস বয়সে শিশুরা সন্ধ্যাবেলায় প্রবল চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। পাড়ার লোক ও গুরুজন সম্প্রদায় সমবেত হয়ে পেট ব্যথা থেকে কান ব্যথা সব রকমের ডায়াগ্নোসিস করে ফেলে। আপনি কানে আঙ্গুল দিয়ে হাসি মুখে বসে থাকুন। এটার কারণ কেউ জানে না। এবং সম্ভবতঃ কোনও শারীরিক কারণে হয় না।
সব শেষে বলি, বারবার বলি, আবার বলি, নতুন করে বলি বিজ্ঞাপিত ফর্মুলা ফুড এবং ওষুধ খাওয়াবেন না। খাওয়াবেন না। খাওয়াবেন না।
ধন্যবাদান্তে অবসরমুখী এক চিকিৎসক।
Jader Brest milk kom hoy fourmula milk kyoatay hoy sa baparay janalay khub valo hoy
লেখাটা আবার পড়ুন । বাচ্চার পেট ভরেছে কিনা এবং দুধের ব্যাপারে লেখা আছে । আবার পড়ুন ।
কম হয় মানে কি ?
খুব প্রয়োজনীয় পোস্ট।সদ্য যারা মা হয়েছেন,খুব অশান্তির মধ্যে থাকেন।এক অজানা জগতে প্রবেশ করে হাতড়ে হাতড়ে পথ চলা।বাচ্চার খাওয়া দাওয়া ,আচার আচরন ,টয়লেট পটি,শরীর খারাপ এইসব সম্পর্কে কোন ধারণাই থাকে না।আর সঠিক তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না।আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল।খুব ই দুর্বিষহ দিন কেটেছে সে সময়।আমার খালি মনে হত আমার বুকে দুধ যেন কম আছে।সবাই বলত বাচ্চার পেট পরে আছে।পেট ভরে নি।যখনি খাওয়ানর সময় হত ,খুব ভয় করত।ওর পেট ভরবে তো।ডাক্তার বাবুর নির্দেশ মত বেবি ফুড খাওয়াতাম না।যেদিন থেকে ভাত খেলো ,কিছুটা স্বস্তি পেলাম।তাই এটা খুব উপযোগী একটা লেখা।
ধন্যবাদ । সামান্য তম কাজে লাগলেও ধন্য ।
এমন সহজ ভাষায় সুন্দর লেখা বিরল। বিশেষ, তথ্যগুলি অ-শিশুচিকিৎসক বৈদ্যকূলেও অনেকের অবিদিত।
সাধু@ডাঃ ঘোষ।
আকন্ঠ আপ্লুত