ঘুম না এলে কী করেন? ভেড়া গুনি। তার মানে? একপাল ভেড়া ভেবে নিয়ে, এক-দুই-তিন . . . হাজার। তারপর ঠিক গুনলাম কিনা বোঝার জন্য হাজার নশো নিরানব্বই, নশো আটানব্বই . . . এভাবে উলটে দিয়ে গুনি।
তাতে ঘুম আসে?
কোনোদিন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কোনোদিন ক্লান্তই হই, ঘুম আর আসে না।
ঘুম না এলে যে যার মতো করে এরকম নানা পদ্ধতি অনুসরণ করেন। কেউ টিভি দেখেন, কেউ বই পড়েন। কেউ সিগারেট খান, কেউ মদ খান। কেউ শুধু ঘড়ি দেখেন আর ঘাড়ে মাথায় জল দেন। তাও ঘুম আর আসে না।
ঘুম কী, ঘুম না হওয়াই বা কী আর ঘুম না হলে কী কী করা যায় সেগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক।
ঘুম কত রকমের?
শারীরবৃত্তীয়ভাবে ঘুম দু-রকমের।
১. নন র্যাপিড আই মুভমেন্ট (NREM) ঘুম এবং
২. র্যাপিড আই মুভমেন্ট (REM)।
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এক ধরনের ঘুমে চোখের নড়াচড়া দ্রুত হয় আর এক ধরনের ঘুমে চোখের নড়াচড়া হয় না। এছাড়া মানুষের শরীরের আরও কিছু পরিবর্তন এই দু-ধরনের ঘুমের মধ্যে আসে।
NREM স্লিপে চারটে ধাপ বা স্টেজ আছে। তার মধ্যে সবথেকে গভীর ঘুম হয় তিন আর চার নম্বর স্টেজে। NREM স্লিপে মানুষের রক্তচাপ, শ্বাসের গতি, নাড়ির গতি সব কমে যায়। অর্থাৎ বোঝা যায় মানুষটি শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। তবে হঠাৎ করে সারা দেহ আন্দোলিত হয়ে উঠতে পারে। চার নম্বর ধাপের ঘুম ঠিকঠাক না হলে ঘুমের মধ্যে প্রস্রাব করে ফেলা, ঘুমের মধ্যে হাঁটা বা দুঃস্বপ্ন দেখা—এসব হতে পারে।
REM স্লিপের সঙ্গে শারীরবৃত্তীয় ভাবে জেগে থাকার বিশেষ পার্থক্য নেই। অর্থাৎ রক্তচাপ, নাড়ির গতি, শ্বাসের গতি NREM এর তুলনায় অনেক বেশি থাকে, কিছু ক্ষেত্রে জেগে থাকার থেকেও বেশি হয়। সেই জন্যে একে প্যারাডক্সিক্যাল (Paradoxical) স্লিপও বলে। দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সরীসৃপের মতো হয়ে যায়, অর্থাৎ বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গে দেহের তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়। শরীর কখনো কেঁপে বা ঘাম দিয়ে বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গে সমতা রক্ষা করে। দেহের সমস্ত পেশি শিথিল হয়ে যায়। তবে পুরুষ মানুষেরর লিঙ্গ উত্থিত হয়ে যায় REM স্লিপে। এরকম হলে প্রমাণ হয় তার লিঙ্গোত্থানজনিত সমস্যা, যাকে চলতি কথায় বলে ‘ধ্বজভঙ্গ, তা নেই, বা থাকলেও সেই সমস্যার শারীরবৃত্তীয় কোনো গুরুতর কারণ নেই।
মানুষ প্রথমে NREM স্লিপের চার ধাপ পেরিয়ে REM স্লিপে যায়। দেখা গেছে রাতের প্রথম তৃতীয়াংশে স্টেজ-৪ বা গভীর ঘুম সবথেকে বেশি হয়। আর রাতের শেষ তৃতীয়াংশে REM স্লিপ বেশি হয়। ঘুম শুরুর সাধারণত প্রথম ৯০ মিনিট বাদে প্রথম REM স্লিপ শুরু হয়। প্রথমে ১০ মিনিট থাকে, পরে ১৫ থেকে ৪০ মিনিট থাকে। স্বপ্ন দু-ধরনের ঘুমেই আসে। REM-এ স্বপ্নে একটা ঘটনা বা তার উদ্দেশ্য অনেক পরিষ্কার থাকে।
ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করে বেশ কিছু কেমিক্যাল। এর মধ্যে অ্যাসিটাইল কোলিন REM স্লিপে সাহায্য করে। অপরদিকে ডোপামিন জাগিয়ে রাখে। পিনিয়াল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত মেলাটনিন ঘুম পাড়াতে সাহায্য করে।
কেন আমরা ঘুমাই?
নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখা গেছে শরীরকে সুস্থির রাখতে ঘুমের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ খাটাখাটনিতে শরীরে যে ক্ষতি হয় তা মেরামতিতে ঘুম সাহায্য করে। শরীরের তাপমাত্রা ও শক্তি নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন ঘুমের প্রয়োজন ৬-৯ ঘণ্টা। ৬ ঘণ্টার কম যারা ঘুমায় তাদের শর্ট স্লিপার বলে এবং ৯ ঘণ্টার বেশি সময় যার ঘুমায় তাদের লং স্লিপার বলে। শর্ট স্লিপাররা সাধারণত সামাজিকভাবে সক্রিয় এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়। লং স্লিপাররা একটু চুপচাপ এবং হতাশাগ্রস্ত হয়।
অনিদ্রা রোগ বা ইনসমনিয়া (Insomnia)
ঘুম সম্পর্কিত যতরকম সমস্যা আছে তার মধ্যে ইনসমনিয়া (Insomnia) বা অনিদ্রা—এই উপসর্গ নিয়ে সবথেকে বেশি মানুষ আসে। অনিদ্রাকে তিন ভাগে ব্যাখ্যা করা যায়। নিদ্রা শুরু হতে দেরি হওয়ার সমস্যা, নিদ্রা ধরে রাখার সমস্যা, খুব তাড়াতাড়ি নিদ্রাভঙ্গের সমস্যা। এই তিন ধরনের সমস্যাই সবার থাকবে এরকম নয়।
সাধারণভাবে অল্প কয়েকদিনের নিদ্রাহীনতার সমস্যা কম বেশি সবারই হয়। পরীক্ষার আগে বা চাকরির ইন্টারভিউয়ের আগে এরকম হয়। কিছু ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় বিয়োগে ঘুমের সমস্যা হয়। এগুলোর চিকিৎসা বিশেষ দরকার হয় না। খুব কম দিনের জন্যে ঘুমের ওষুধ অনেক সময় দেওয়া হয়।
কিছু মানুষের দীর্ঘমেয়াদি ঘুমের সমস্যা থাকে। সেটাই এখানে মূল আলোচ্য। এদের মূল অভিযোগই হচ্ছে ঘুম না হওয়া আর সেটাই এদের ডাক্তারের কাছে আসার কারণ। এই অনিদ্রাও নানা রকমের হয়।
এক ধরনের অনিদ্রা রোগ আছে যাকে বলা হয় মন-শারীরবৃত্তীয় অনিদ্রা রোগ বা সাইকোফিজিওলজিক্যাল ইনসমনিয়া (Psychophysiological Insomnia) । এক্ষেত্রে রোগী বলে যে তার বছরের পর বছর ঘুম হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বিছানা দেখলেই তাদের ঘুম উঠে যায়। এবং নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় অন্য বিছানায় তাদের ঘুম এসে যায়। বিছানায় শুলে শরীর শিথিল হওয়ার বদলে বিভিন্ন পেশি টেনসড বা শক্ত হয়ে যায়। যেমন ঘাড় পিঠ হাত পায়ের পেশি । এছাড়া বিছানায় শুলে অনেকের মাথা ব্যথা বুক ধড়ফড়ানিও হয়। অধিকাংশ মানুষ রাতে না ঘুমিয়েও দিনে তাদের নির্দিষ্ট কাজ করে ফেলে। তবে কেউ কেউ দিনের শেষে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এই ঘুমের সমস্যার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে আরও কিছু সমস্যা জড়িত থাকে। যেমন উদ্বেগ রোগ, হঠাৎ ঘুমের ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি।
অনেক সময় ঘুম না হওয়াটাই একমাত্র সমস্যা হয়। এই অনিদ্রার সঙ্গে উপরে উল্লিখিত কোনো সমস্যা থাকে না। আর এই অনিদ্রার সঙ্গে অন্য কোনো কারণ অর্থাৎ উদ্বেগ বা অবসাদ রোগ বা হঠাৎ ঘুমের ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া এসব থাকে না, সেই জন্যে এই ধরনের অনিদ্রাকে প্রাইমারি ইনসমনিয়া বলে।
মানসিক রোগ নির্ণয় ও নামকরণ করা হয় যে নির্দেশিকা অনুযায়ী সেই DSM-5 বলেছে অনিদ্রা রোগ তখনই ডায়াগনোসিস করা যাবে যদি কোনো মানুষের সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ঘুমের সমস্যা হয় এবং সেটা অন্তত তিন মাস ধরে চলতে থাকে।
অনিদ্রার চিকিৎসা:
চিকিৎসা দু-ভাবে হয়। ১. ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা ২. ওষুধ ছাড়া চিকিৎসা।
১. ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা: খুব দ্রুত ঘুমের সমস্যা সমাধানের জন্য ওষুধের কোনো বিকল্প নেই। সাধারণত বেনজোডায়াজেপিন গ্রুপের ওষুধ বেশি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া জলপিডেম, এসজোপিক্লোন এবং জেলিপ্লোন ঘুমের ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধগুলি ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়।
২. ওষুধ ছাড়া চিকিৎসা: অনিদ্রা রোগ ওষুধ ছাড়াও নানা ভাবে চিকিৎসা হয়। আমরা তার কিছু সংক্ষেপে দেখে নেব।
ক. স্লিপ হাইজিন (Sleep hygiene) অর্থাৎ ঘুমানোর জন্যে যে স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলি করা দরকার, দেখা গেছে জীবনযাপন প্রণালীর গলদের জন্যে মানুষের ঘুমের সমস্যা হয়। এই আচরণগুলির পরিবর্তন করলে অনেক ক্ষেত্রেই ঘুমের সমস্যার সমাধান হয়। তবে একসঙ্গে অনেকগুলি আচরণকে লক্ষ্য না করে রোগীর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি বা দু-টি আচরণের পরিবর্তনের লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করলে এই পদ্ধতি ফলপ্রসূ হয়। মোটামুটি যে অভ্যাসগুলিতে নজর দিতে হয় নীচে দু-ভাগে লেখা হল। অর্থাৎ কী করবেন আর কী করবেন না।
১. যেটা করা উচিত
- প্রত্যেক দিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে শুতে যেতে হবে এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ে উঠতে হবে।
- ঘুমানোর আগে ক্ষিদে পেলে খুব হালকা খেতে হবে।
- শোবার আগে কোনো কাজের চিন্তা বার বার আসলে সেটাকে লিখে রাখতে হবে পরদিন সকালের জন্যে।
- শোয়ার ঘর ঠান্ডা রাখতে হবে।
- শোয়ার ঘর অন্ধকার রাখতে হবে।
- শোয়ার ঘর শান্ত রাখতে হবে।
২. যেটা করা উচিত নয়:
- ঘুম না এলেও বার বার ঘড়ি দেখা চলবে না।
- ঘুমের আগে কোনো ব্যায়াম করা যাবে না।
- ঘুম না এলে টিভি দেখা চলবে না।
- রাতে খুব ভারী খাবার চলবে না।
- ঘুমানোর আগে চা/কফি চলবে না।
- ঘুম না এলে সিগারেট খাওয়া চলবে না।
- মদ খাওয়া যাবে না।
- বিছানায় বসে খাবার খাওয়া যাবে না।
- ঘুম না এলে বিছানায় শুয়ে বই পড়া যাবে না।
- বিছানায় বসে ফোন করা যাবে না।
একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে যখন সবথেকে বেশি ঘুম আসবে তখনই বিছানায় যেতে হবে। ঘুম না এলে বিছানায় শুয়ে ছটফট না করে পাশের ঘরে গিয়ে এমন কিছু করতে হবে যেটাতে ঘুম না কেটে যায়।
খ. স্লিপ রেসট্রিকশান থেরাপি ( sleep restriction therapy)
এই পদ্ধতিতে বিছানায় শোবার মোট সময়টা কম করা হয়। যারা বিছানায় শুয়ে থাকে অনেকক্ষণ কিন্তু ঘুমায় অল্পক্ষণ তাদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অধিক কার্যকর। যেমন রোগী বলছে সে শুয়ে থাকে ৮ ঘণ্টা কিন্তু ঘুমায় ৫ ঘণ্টা তাকে বিছানায় শোবার সময় কম করতে বলতে হবে। তবে কোনোভাবেই সময়টা ৪ ঘণ্টার কম করা যাবে না। দিনের অন্য সময় ঘুম এলেও ঘুমানো যাবে না। তবে বয়স্কদের জন্যে দিনে ৩০ মিনিট ঘুমের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এইভাবে যদি বিছানায় শোবার সময়ের শতকরা ৮৫ ভাগ ঘুমন্ত থাকতে পারে, এবং সেটা অন্তত ৫ দিন প্রতি সপ্তাহে হয়, তবে তাকে আরও ১৫ মিনিট শোবার সময় বাড়াতে দেওয়া যাবে।
গ. প্রগ্রেসিভ মাসল রিল্যাকসেশান থেরাপি 1(Progressive Muscle Relaxation é de xzZ)
যারা বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছে না বলে এমন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে বিভিন্ন পেশি টেনসড বা শক্ত হয়ে যায় তাদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কার্যকরী হয়। এটা কোনো থেরাপিস্টের থেকে শিখে নিতে হবে। বলা হয় একটা পেশি গোষ্ঠীকে, ধরা যাক ঘাড়ের পেশি গোষ্ঠী, ৫-৬ সেকেন্ডে জোর করে শক্ত করতে হবে তারপর ২০-৩০ সেকেন্ড শিথিল করে দিতে হবে। আর এই শিথিল হওয়ার যে সুন্দর অনুভূতি সেটা উপভোগ করতে হবে। মাথা থেকে শুরু করে পায়ের পেশি গোষ্ঠীর দিকে যেতে হবে।
আরও বেশ কিছু পদ্ধতি আছে। আর আছে অবসাদ, উদ্বেগ স্কিজোফ্রেনিয়া রোগে অনিদ্রার চিকিৎসা, যেগুলো মূলত ওষুধ দিয়ে হয়।
ঘুম না হওয়া বড়ো কষ্টের। শরীর মন সুস্থ রাখতে ঘুমের বড়ো প্রয়োজন। আর এই অশান্ত সময়ে ঘুম পাড়ানো মাসি-পিসিরাও সব কোথায় হারিয়ে গেছে। তাই ঘুমের দেশে যেতে প্রয়োজনে কোনো বিশেষ পরামর্শ নিতে দ্বিধা করবেন না।