————
রাত দশটায় বিশেষ দরকারে এক সিনিয়ার দাদা কে ফোন করেছিলাম। একজন রোগীর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার ছিল। দাদা নিজে ফিজিসিয়ান। বলল,’ একটু বাদে ফোন কর। এখন বাসন মাজছি।’
আর কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল না। মহামারীর প্রকোপে আমাদের প্রায় সবারই কম বেশী একই দশা। গত দশমাস যাবৎ নিজেই গাড়ী চালাচ্ছি এবং বেশ করেকবার ভুল রাস্তায় চলে গিয়ে বা টায়ার ফেঁসে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েছি। আর আমার ড্রাইভার আমার চেম্বারে রোগীদের নাম ডাকছে এবং স্যানিটাইজার ঢেলে দেওয়ার কাজ করছে। গত ন’মাস যাবৎ এই ব্যবস্থা চলছে।
বাড়িতে সহকারী নেই, গাড়িতেও। আপনা হাত জগন্নাথ। কিন্তু সার্জেনদের সেই সুবিধা নেই। সার্জারি করতে গেলে সহকারীর প্রয়োজন হবেই। সহকারী ছাড়া একা একা প্রায় কোনো অপারেশনই করা যায় না। যদিও সময়ের সাথে সাথে শিখেছি বিশেষ বিশেষ যন্ত্রপাতির ব্যবহার করে, টেকনিকের পরিবর্তন করে কি ভাবে সহকারীর সংখ্যা কমানো যায়। এত হয়ত কিছুটা কর্মসংকোচন হয় কিন্তু অপারেশনে সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে। অপারেশন থিয়েটারে মানুষ যত কম, সংক্রমণও তত কম। তবে সংখ্যায় কম হলেও অপারেশন থিয়েটারে সহকারী লাগবেই।
ইন্টার্ন, হাউসষ্টাফ, পোষ্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেনি এমনকি কখনো ক্ষেত্র বিশেষে সিনিয়র সার্জেনকেও অপারেশনে সহকারীর কাজ করতে হয়। সহকারী রূপে কাজ করা সার্জিক্যাল ট্রেনিং-এর একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এভাবে সহকারী রূপে কাজ করতে করতেই একজন সার্জিক্যাল ট্রেনি পূর্ণাঙ্গ সার্জেনে রূপান্তরিত হয়। অপারেশন থিয়েটারের নার্সরাও অনেকটা একই ধরনের কাজ করেন। যদিও, রুটিন পরিস্থিতিতে বিশেষতঃ মফস্বলে, সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালে শল্যচিকিৎসার সহকারীরা ডাক্তার বা নার্স নন। বরং প্রথাগত ট্রেনিংপ্রাপ্ত বা ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত ব্যক্তি।
শল্যচিকিৎসায় আদর্শ সহকারী হলেন তিনি, যিনি উল্লেখ্য অপারেশনটা নিজেও করে ফেলতে সক্ষম। একমাত্র কোনো সিনিয়র সার্জেন বা অভিজ্ঞ ট্রেনি সার্জেন যদি সহকারী হন তাহলেই এরকম আদর্শ সহকারী পাওয়া সম্ভব। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যেটা আকাশকুসুম। এই বিষয়ে একটা ঘটনা বলি।
নব্বই দশকের প্রথমদিকে আমি তখন এমবিবিএস-এর ছাত্র। আমার এক সিনিয়র দাদা, যে তখন অর্থোপেডিক্সের হাউসষ্টাফ, অর্থোপেডিক্সের একজন শিক্ষক-চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করছিল অন্য আরো দুজন ডাক্তারের সাথে। অপারেশনের মাঝপথে সেই সিনিয়র সার্জেনের হার্ট অ্যাটাক হয়। তাঁকে তৎক্ষনাৎ অপারেশন থিয়েটার থেকে আইসিইউ তে ভর্তি করে চিকিৎসা করা হয়। তিনি সে যাত্রা বেঁচে যান। এখন প্রশ্ন, অপারেশনের মাঝপথে থাকা সেই রোগীর কি হয়েছিল? ভয় নেই, সেই রোগীর অপারেশন সফলভাবে শেষ করেছিলেন তাঁর সহকারীরা। সহকারীদের হাতযশে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি যান। অপারেশনে সহকারীর ভুমিকা এতটাই গুরত্বপূর্ণ।
চিকিৎসক বা নার্স বাদে শল্যচিকিৎসার অন্য সহকারীদের বলা হয় ‘অপারেটিং রুম পারসোনেল’। এদের কেউ কেউ জীবাণুমুক্ত হয়ে সার্জিক্যাল গাউন পরে সরাসরি অপারেশনে নেমে সার্জেনদের হাতে হাতে সাহায্য করেন। আবার কেউ কেউ জীবানুমুক্ত হয়ে অপারেশনে না নেমে জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়া, যন্ত্রপাতি চালু-বন্ধ করা, প্রয়োজন মত অপারেশন টেবিলের উচ্চতা কম-বেশী করা ইত্যাদি কাজ করেন। স্ত্রীরোগ, জেনারেল সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারি, চোখ,নাক-কান-গলা সার্জারী, নিউরো, কার্ডিওথোরাসিক, প্লাষ্টিক, ইউরো সহ সমস্ত অপারেশনে এদের উপস্থিতি এবং অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ও গুরুত্বপূর্ণ। অপারেশন থিয়েটারে এরা একটা অন্যতম স্তম্ভ। অথচ এইসব নীরব কর্মীরা বরাবর ‘কাব্যে উপেক্ষিত’ থেকে যান। দৃশ্যমান হন না। করোনা পরিস্থিতিতে আপাততঃ এখন এরা সাধারণের একটু নজরে পড়েছেন।
অপারেশন থিয়েটার একটা বদ্ধ পরিবেশ। তাই এখান থেকেও করোনা সংক্রমণ হচ্ছে। ডাক্তার-নার্সদের মত শল্যচিকিৎসার সহকারীরাও অনেকেই হাসপাতাল থেকে সংক্রমিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ প্রাণ হারিয়েছেন।
মহামারী নিয়ন্ত্রণে সহকারীদের ভুমিকা যেমন ডাক্তার-নার্সদের মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ, এদের শারীরিক ঝুঁকিও সমানভাবে বেশী। তাই মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে এদের সুরক্ষার কথাও ভাবতে হবে এবং টীকাকরণ ছাড়পত্র পেলে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এদেরও টীকাকরণ করতে হবে।