মেয়েটির নাম শিবানী। কতই বা বয়স হবে? বড়জোর সতেরো-আঠারো। আউটডোরে যখন একটা আধময়লা হলদে রঙের ওড়না জড়িয়ে মুখের অর্ধেকটা ঢেকে, ওর মা বাবার সঙ্গে এসে দাঁড়ালো — ওর টানা টানা গভীর কালো চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে অনুমানও করতে পারিনি ওই ময়লা চুনরির আড়ালে কি নিগূঢ় বেদনা লুকিয়ে ফিরছিল ও।
সাবম্যান্ডিবুলার মিক্সয়েড লাইপোসারকোমা। খটোমটো নামটা বললে কিছুই বলা হয় না। কাজলকালো চোখ, টিকোলো নাক আর ফুলের পাপড়ির মতো পাতলা উপরের ঠোঁটের নীচে থেকে যখন শিবানীর লজ্জাবস্ত্রের আবরণ সরে গেল, গোটা প্লাস্টিক সার্জারি আউটডোর শিউরে উঠল — স্যার বাদে। আমি দেখছিলাম, কি গভীর মমতা নিয়ে স্যার পর্যবেক্ষণ করছিলেন মেয়েটির চিবুকের বিশাল বীভৎস টিউমারটাকে — এক কান থেকে আর এক কান পর্যন্ত ছড়ানো, গোটা চোয়ালটাই প্রাগৈতিহাসিক গুহামানবের মতো বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
নানা পরীক্ষানিরীক্ষা, চেক আপ ইত্যাদির পরে সেই সাংঘাতিক অপারেশনটা হলো। দুটো সিটিংএ। প্রথম অস্ত্রোপচারে মেয়েটির টিউমার পুরোপুরি বাদ গেল — চোয়ালের হাড় সমেত। স্বস্তির কথা এই, যে বায়োপ্সিতে জানা গেল ক্যানসার আর কোথাও ছড়ায়নি।
দ্বিতীয় দফায় স্যার নতুন করে গড়লেন শিবানীর মুখের নিম্নাংশ। মাংসপেশী সুদ্ধ ওর পাঁজরের হাড়ের বাঁকানো অংশ দিয়ে তৈরি হলো ওর নতুন চোয়াল। তারপর হলো চামড়া প্রতিস্থাপন। দাঁত এবং মাড়ি প্রতিস্থাপন হলো পরে — সেই কাজটা করেছিলেন একজন স্বনামধন্য ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জেন।
শিবানীর এই রূপান্তরের কাহিনীতে ওই প্রথম দুটো অপারেশনে, স্যারের তিনজন সাহায্যকারীর মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। না, ইন্সট্রুমেন্ট চিনতে না পারা, গ্লাভস পরতে ভুল করা, শল্যচিকিৎসায় চূড়ান্ত অস্বচ্ছন্দ মেয়েটি তার স্যারকে লজ্জিত করেনি সেই দিনগুলোয়।
পরম যত্নে, স্যার যে তাকে নিজের অন্যতম অস্ত্র করে তুলেছিলেন — হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন নিপুণতম সেলাইএর কারিগরি, স্কিন গ্রাফটিংএর পাতলা কাটা চামড়ার উপর সরু ছুঁচের ফোঁড়, দক্ষ হাতের বার্ন ড্রেসিং, প্লাস্টিক সার্জারির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ললিতকলা।
হাসপাতালের বাইরের কেসেও আমি স্যারকে অ্যাসিস্ট করতাম। প্রথমদিকে বাছাই করা কিছু অপারেশনে সাহায্যকারী হিসেবে থাকতাম আমি। ধীরে ধীরে প্রায় প্রত্যেকটি কেসেই।
পরিচয় হলো বৌদির সঙ্গে। স্যারের স্ত্রী। তিনি সংস্কৃতের অধ্যাপিকা ছিলেন। অমন নিরহঙ্কার, ভালোমানুষ অধ্যাপিকা আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। বয়সের অনেকটা তফাৎ থাকা সত্ত্বেও বৌদি আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন — একান্তই তাঁর নিজের গুণে।
হাজিনগরের কোয়ার্টারে তখন সবে টেলিফোনের কানেকশন নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকদিন রাতে, ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পেরোলেই বেজে উঠতো ফোন। মায়ের ভ্রূকুটি, বাবার নীরব অসন্তোষ অগ্রাহ্য করেই আমি লাফাতে লাফাতে ফোন ধরতে ছুটতাম।
“আজ কখন ফিরলেন বৌদি?”
“ওই সাড়ে চারটের দিকে—”
“ফেরার সময় ব্যারাকপুর লোকালে বসার জায়গা পেয়েছিলেন?”
“না, না — দরকারই হয়নি। জানো, আজ ঘটি গরম উঠেছিল ব্যারাকপুরে — আর আমি একঠোঙা নিয়ে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, গুণগুণ করে গাইতে গাইতে আর খেতে খেতেই দমদম পৌঁছে গেলাম। বসার ইচ্ছেটুকুও হয়নি। দরজার কাছে কি হাওয়া — খুব আরাম লাগে, জানো?”
“এ মা, হিহি — আপনার ছাত্রীরা যদি কেউ দেখে ফেলত?”
“ও মা, ছিল তো একটা মেয়ে, স্যানসক্রিটেরই — বেলঘরিয়ায় থাকে। ও দেখল তো — ম্যাডাম ঘটি গরম খেতে খেতে গান গাইছে! দেখল তো ভারী বয়েই গেল —”
“আজ কি হয়েছে, জানো সুকন্যা?”— বৌদির গলার স্বর অস্বাভাবিক ভারী সেদিন।
“কি হয়েছে বৌদি?”— আমার সন্ত্রস্ত প্রশ্ন।
“মিতুল স্কুল থেকে ফিরে আমায় জিজ্ঞেস করেছে, আচ্ছা মা, আর উই রিচ পিপল?” — মিতুল স্যারের ছোট মেয়ে, দেরিতে হয়েছে একটু — বছর ছয়েক বয়স তার তখন —
“ভাবো সুকন্যা, কি রকম সব শিক্ষা দিচ্ছে স্কুলে, আর কি ভাবে পালটে যাচ্ছে দুনিয়াটা! এই বয়সেও গরিব বড়লোকের বোধটাই জন্মালো না আমার, আর আমারই মেয়ে কি না —”
“আচ্ছা সুকন্যা, তিতির তো বড় হচ্ছে বলো – আর ক’দিন পরে স্কুল থেকে কলেজে যাবে। তারপর ইউনিভার্সিটি — তারও পরে চাকরি—”
”হ্যাঁ, সে তো যাবেই বৌদি—”
তিতির ওঁদের বড় মেয়ে। ঐ কিশোরীবেলাতেও ডাকসাইটে সুন্দরী ছিল সে।
“আচ্ছা, যদি নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেলে?”
“তা করতেই পারে—“,আমি সান্ত্বনা দিই বৌদিকে, “আজকাল তো সব ছেলেমেয়েই প্রায় নিজেরাই পছন্দ করে বিয়ে থা করছে বৌদি” —
“ও যা বোকা না” বৌদির গলা কেঁপে যায় — “যদি কোনো রিকশাওয়ালাকে পছন্দ করে ফেলে? কি সাংঘাতিক ঘটনা হবে বলো তো!”
বৌদির অদ্ভুত অবাস্তব সব চিন্তাভাবনার নমুনায়, দুজনেই হেসে গড়িয়ে পড়তাম তারপর।
হঠাৎ স্যারকে অ্যাসিস্ট করে ফেরার পথে জানতে পেরেছি, সেদিন তিতিরের জন্মদিন। শিয়ালদার হুইলার থেকে চার পাঁচটা ফেলুদা কাহিনী কিনে নিয়ে ট্রেনে বাড়ি ফেরার পথে নেমে পড়েছি দমদমে। ওঁদের শোবার ঘরে, খাটের উপর উপুড় হয়ে প্রত্যেকটি বইতে লিখেছি তিতিরের নাম। আর অপ্রস্তুত হেসে বলেছি—“গিফট র্যাপার ছাড়াই দিচ্ছি কিন্তু তিতির, রাগ কোরো না প্লিজ —”
পরের দিন হাসপাতালে দেখা হতে স্যার বলেছেন —“দোকানের সবক’টা বই কিনে ফেলেছিস তো কাল?”
মাঝে মাঝে কলকাতার কোনো নার্সিংহোমে অপারেশন করে, স্যারের সঙ্গেই চলে যেতাম ওঁর বাড়ি। বৌদি হয়তো ফেরেননি কলেজ থেকে। খেতে খেতে তখন গল্প জুড়তাম মাসীমার সঙ্গে। স্যারের মা।
“এগুলো কি মাসীমা?”
“কোনগুলো রে?”
“এই যে উচ্ছে উচ্ছে দেখতে, কিন্তু ঠিক উচ্ছে নয়, তেতো নয় তো একটুও —”
“এ কি রে মেয়ে, কাঁকরোল চিনিস না? খুব ভাল স্বাদ—”
বাবা পেপার মিলের চাকরি থেকে অবসর নিল ১৯৯৬ সালে। ততদিনে আমাদের উত্তর শহরতলিতে বুড়োদাদুর সেই পুরোনো বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে।
কলকাতার দক্ষিণ উপকন্ঠে বাবা আর মা পছন্দ করে কিনেছিল একফালি জমি। নিজেদের বাড়ি হবে একদিন, এই ভেবে। বাবার রিটায়ারমেন্টের পরে আমরা চলে এলাম সেই অচেনা পাড়ায়, হাজিনগরের বিশাল ব্রিটিশ আমলের কোয়ার্টার ছেড়ে, একচিলতে ভাড়া বাড়িতে — বাবার ইচ্ছে, অবসরকালীন পাওনার টাকায় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি করাবে।
আমি বাড়ির কোনো কিছুর সঙ্গেই সম্পৃক্ত থাকতাম না সে সময়। আমার নিজের, একান্ত নিজস্ব কোনো চিন্তা যেন ছিল না তখন। ছিল না ভবিষ্যতের ভাবনাও। স্যার, বৌদি, মাসীমা, ওঁদের মেয়েরা, ওঁদের সংসার, আমার সার্জারির অ্যাসিস্ট্যান্টগিরি — এই সব নিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা জগত তৈরি করে নিয়েছিলাম আমি। এক অদ্ভুত পরাবাস্তব মোহে যেন আমি আচ্ছন্ন থাকতাম সেই সময়।
আমার চোখে তখন ‘সকলি শোভন, সকলি নবীন, সকলি বিমল,—- সকলি আমারি মতো।’
আমি বাবা মায়ের সাধ করে কেনা সে জমি দেখতেও আসিনি কোনোদিন। বাড়ি সম্পর্কে কোনো কৌতূহলও ছিল না আমার। তাই বাড়ির ব্যাপারে আমার মতামত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি বাবা মা কেউই। গভীর অভিমানে কি? হয়তো।
যত গভীর নিস্পৃহতাই থাকুক, একদিন যখন সেই ছোট্ট দু’কামরার ভাড়াবাড়িটা থেকে, চ্যাপটা টিফিনকৌটোয় মায়ের তৈরি করা পরোটা আলুভাজা নিয়ে, বাবাকে সকাল আটটায়, কালো রঙের ফোলিও ব্যাগ বগলে বেরিয়ে পড়তে দেখলাম, উদাসীন আর থাকা গেল না। “বাবা কোথায় বেরিয়ে গেল, মা?”
“তোমার জেনে লাভ?”
“বাজে বোকো না — কোথায় বেরোলো, বলো না?”
“তোর তাহলে এখনো বাবা মাকে চোখে পড়ে?”
“মা!”
“বাবা একটা চাকরি নিয়েছে। কনসালট্যান্সি।”
“চাকরি! কোথায়?”
“মধ্যমগ্রামের কাছে, একটা হোসিয়ারি কোম্পানিতে। লিগ্যাল অ্যাডভাইজার” —
“মধ্যমগ্রাম! সে তো স্যারের বাড়ির কাছেই।”
মা সেই অদ্ভুত ঠান্ডা, কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল —” জিজ্ঞেস করলি না তো, কেন চাকরি নিলো তোর বাবা?”
আমি ঠোঁট উলটে বলেছিলাম —“রিটায়ারমেন্টে যে ক’টা টাকা পেয়েছে, তাতে তোমাদের প্রাসাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা যাবে না নিশ্চয়ই। তাই জন্যই—”
“না।”— কেটে কেটে স্পষ্ট উচ্চারণে মা বলেছিল —“বাড়ি হয়ে যাবে ওই টাকাতেই। কিন্তু কত বছর বাঁচব দুজনে, ঠিক কি? খাওয়া পরার সংস্থান রাখতে হবে তো নিজেদের — তাছাড়া বয়স হচ্ছে, অসুখ বিসুখ আছে — গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবার বিলাসিতা তো তোর মা-বাবার সাজে না খুকু!”
কল্যাণীর হাসপাতাল ছেড়ে, তখন আমি উত্তর কলকাতার একটা নার্সিংহোমে আর এম ও হিসেবে জয়েন করেছি স্যারেরই সুপারিশে।
খুব কষ্ট হতো সেই উত্তরপ্রান্ত থেকে দক্ষিণপ্রান্ত যাতায়াত করতে। একটাই মিনিবাস ছিল — ব্যানার্জিহাট-মিল্ক কলোনি রুটের। তাতে চেপে, নার্সিংহোম থেকে বাড়ি আসতে আমার আড়াই থেকে তিনঘন্টা লেগে যেত।
আমাদের পাড়াটা নতুন বসতি — কলকাতা কর্পোরেশন আর মহেশতলা পৌরসভার সংযোগস্থলে — মহানগরের দূরতম প্রান্তে। সেখানে তখন না বসেছে রোডলাইট, না হয়েছে পিচ রাস্তা। বাসস্টপেও আলো ছিল না তখন। মোড়ের মাথার মুদির দোকানের টিমটিমে বাতির কিরণ কাঁচামাটির রাস্তায় পড়ে আলো আঁধারির একটা আবছায়া তৈরি করত।
বেশির ভাগ প্লটই ফাঁকা, আগাছায় ঢাকা — মাঝেমধ্যে একটা দুটো বাড়ি। আমাদের জমি আর ভাড়া বাড়ি, দুটোই বাস রাস্তা থেকে খানিকটা ভিতরে।
একদিন প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। আমি ফিরছি নার্সিংহোম থেকে। স্যারের কিছু কথায় মনটা একটু বিক্ষিপ্ত সেদিন।
“তুই কি এই দু’হাজার টাকার আরএমওশিপ করেই জীবনটা কাটিয়ে দিবি ঠিক করলি?”
“এ রকম করে বলছেন কেন স্যার?”
“কি বলব বল্? পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের দিকে গেলি না, কোনো গভর্নমেন্ট সার্ভিসের জন্যও অ্যাপ্লাই করছিস না — তোর ক্লাসমেটরা সব কোথায় কোথায় পৌঁছে গেছে! অ্যান্ড লুক অ্যাট ইউ—”
“এই তো বেশ আছি স্যার — আপনাকে অ্যাসিস্ট করছি, যেমনই হোক একটা জব তো করছি — আমার তো খারাপ লাগছে না একটুও।”
“যা করছিস, তাতে তুই স্যাটিসফায়েড?”
এ আবার কি রকম প্রশ্ন? স্যার কি জানেন না? আজ তিনবছর হলো দেখছেন আমাকে — নিজে হাতে গড়ে নিয়েছেন, আমার মধ্যে গড়ে দিয়েছেন পেশার প্রতি ভালবাসা — যা সাতবছরের ন্যাশনাল মেডিক্যাল পারেনি।
“এর চেয়ে বেশী কিছু চাওয়ার ছিল না স্যার কোনোদিনই —”
“সুকন্যা, লাইফ ইজ নট আ সিন্ডারেলা স্টোরি” — কেটে কেটে অবিকল মায়ের মতো গলায় বলেছিলেন স্যার —
“গ্রো আপ!”
বাস তখন প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। শেষ স্টপ এগিয়ে আসছে বলেই বোধহয়। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে বেশ জোরে। আমি ব্যাগ হাতড়ে ছাতাটা বের করতে গিয়ে দেখি, ওটা আনাই হয়নি আজ।
‘সারদা পার্ক, সারদা পার্ক এগিয়ে আসুন’ — কনডাকটর অনাবশ্যক চেঁচাচ্ছে। আমি নামার জন্য এগোলাম। অতটা হাঁটতে হবে, ভালরকম ভিজে যাব — ভাবতে ভাবতে মনটা তেতো হয়ে গেল আমার। এত দূরে, এই শেয়ালডাকা ধাবধাড়া গোবিন্দপুরে বাড়ি করতে এসেছেন জনকজননী। কোনো বাস্তববোধ নেই! এখানে জমি কেনার আগে, একবার, অন্তত একবারও পরামর্শ করেছে আমার সঙ্গে? দরকারই মনে করেনি সম্ভবত। অথচ, এখন ফল ভুগতে হচ্ছে আমাকে —
অন্ধকার বাসস্টপে আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল ব্যানার্জিহাট মিনি।
আঁচলটা মাথায় তুলে রাস্তা পেরিয়েই দেখি, বাবা! ছাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল –“ধর! তোর মা বলল, ফেলে গিয়েছিলি আজ!”
“তুমি যে আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছ বড়?”
“সব ভুলে যাস আজকাল—আজ কি বার?”
তাই তো! আজ তো রোববার—বাবার অফিস ছুটি থাকে আজ।
“তুমি জানলে কি করে, আমি এখনই ফিরব?”
“রাস্তায় জ্যাম ছিল না কি রে? প্রায় আধঘন্টা ওয়েট করছিলাম”— বাবার গলাটা শ্রান্ত শোনায় —
“তোর মা বলছিল, এইরকম সময়েই তো ফিরিস”!
“আআধঘন্টা! এই বৃষ্টি মাথায় করে দাঁড়িয়েছিলে বাবা?”
“না না, কচির দোকানে বেঞ্চ আছে — ওখানেই বসে রাহাবাবুর সঙ্গে একটু গল্পগাছা করছিলাম। বর্ষায় বড্ড মশা বেড়েছে, খুব কামড়াচ্ছিল —”
লাল মাটির স্বল্পালোকিত পথে ছোট ছোট নদীর মতো জলধারা ছুটে চলেছে পাশের নয়ানজুলিতে মিশবে বলে। বড় কালো ছাতা নিয়ে আমার চিরকালের পথপ্রদর্শকের মতো বাবা চলেছে আগে আগে।
আগে কেন লক্ষ করিনি, বাবার পিঠটা যেন বেঁকে গেছে একটু — চওড়া কাঁধ ঝুলে গেছে কেমন — মাথাটা ঝুঁকিয়ে শ্লথ পায়ে পথ হাঁটছে বাবা, কাদামাখা মাটিতে নিশ্চিত ক্লান্তির ছাপ এঁকে।
বৃদ্ধ অ্যাটলাস বুঝি আর পারছে না — ঘাড়ের বোঝাটা আর বুঝি বওয়া যায় না, নামাতে চায় — কিন্তু কে নেবে ভার, কে?
আমার আচমকা মনে পড়ে গেল, হাজিনগরে থাকতেই বাবার ইসকিমিক হার্ট ডিজিজ ধরা পড়েছিল। কার্ডিওলজিস্ট সিগারেট বন্ধ করতে বলেছিলেন —‘যা ক্ষতি হয়ে গেছে, তা তো আর ফেরানো যাবে না মিস্টার ব্যানার্জি, তবে নিয়ম মেনে চললে, ওষুধপত্র খেলে আরো ক্ষতি আটকানো যেতে পারে। অ্যান্ড রিমেমবার, ডোন্ট স্ট্রেস ইয়োরসেলফ টু মাচ — শরীরের নাম কিন্তু সত্যিই মহাশয় নয়, যে যা সওয়াবে, তাই সইবে।’
সেই বাবা এই ধাবধাড়া গোবিন্দপুর থেকে, দুবার বাস পালটে, মধ্যমগ্রাম যাচ্ছে, রোজ।
আমার চোখের জল মিশে গেল বৃষ্টির জলের সঙ্গে। নিঃশব্দে।
উত্তর কলকাতার নার্সিংহোমের চাকরিটা আমি ছেড়ে দিলাম।
আবার খবরের কাগজ। ভ্যাকেন্সির বিজ্ঞাপন। ইন্টারভিউ। ফের নতুন চাকরি। এবার চব্বিশ ঘন্টার রেসিডেন্সিয়াল জব। মাইনে বেশ কিছুটা বেশি। বেহালা বালানন্দ ব্রহ্মচারী হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে।
“বাড়ি থেকে অটোয় গেলে মিনিট পঁচিশ বড়জোর — সেখানে রেসিডেন্সিয়াল চাকরি নিলি?” — মা কিছুটা অবাক হয়েছিল।
“ওদের সেটাই চাহিদা ছিল মা। নয়ত দিনে কাজ করা ডাক্তার তো অনেক পাচ্ছিল ওরা। তাছাড়া শনিবার শনিবার তো আসবই।”
মা একটা হালকা ‘ও আচ্ছা’ বলে চুপ করে গিয়েছিল — আমার চাকরি নেওয়া-না নেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন, নৈর্ব্যক্তিক প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম মায়ের।
আমাদের বাড়ি তখন ভিত ছাড়িয়ে লিনটেল অবধি মাথা তুলে ফেলেছে। আমাকে নিয়ে ভাবার আর অবকাশ ছিল না বাবা মায়ের। তাদের দ্বিতীয় সন্তান তখন বেড়ে উঠছে খোলা আকাশের নীচে। বেয়াড়া প্রথম সন্তানের খামখেয়ালিপনার দিকে নজর দেবার সময় ছিল না আর।
বালানন্দ ব্রহ্মচারী হাসপাতালে পুরুষ আরএমও ছিল অনেকজন। আই ব্লকে ছিল তাদের মেস। মহিলা আরএমও-র জন্য কোনো নির্দিষ্ট ঘর ছিল না এতদিন। মহিলা রেসিডেনসিয়াল ডাক্তারই ছিল না মোটে।
বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে জয়েন করার জন্য যেদিন হাজির হলাম হাসপাতালে, অফিসের খুঁটিনাটি ফর্মালিটি শেষ করে সুপার সাহেব আমাকে নিয়ে উঠে এলেন মেন বিল্ডিংএর ছ’তলায়। ছাদে।
বিশাল ঢালা ছাদের এক কোণে অ্যাসবেস্টস আর টিন মেশানো চালের একখানা ছোট্ট ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন —“তোমাদের কোয়ার্টার।”
সেই রুম দেখেই গুম হয়ে গিয়েছিলাম আমি। এবার উৎকর্ণ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম —“আমাদের? আর কেউ থাকবে না কি আমার সঙ্গে?”
“হ্যাঁ, আমরা দুজন লেডি আরএমও নিয়েছি তো। একজন পেডিয়াট্রিকস, আর একজন আই। আজ রাতটা একলা থাকো। কাল থেকে ডঃ মিসিসিপি ঘোষ থাকতে আসবে তোমার সঙ্গে।”
আমি ঠিক শুনলাম কি না নামটা তাই ভাবতে ভাবতেই প্রশ্ন করলাম —“এক্সকিউজ মি স্যার, কি নাম বললেন বুঝতে পারলাম না —” আমার ধারণাই ছিল না যে কারো ভাল নাম অমনটা হতে পারে।
মৃদু হেসে বললেন সুপারসাহেব —“ঠিকই শুনেছ। ওর নাম মিসিসিপি। আর জি করের মেয়ে। তোমার চেয়ে বছরখানেক কি বছরদুয়েকের জুনিয়র হবে হয়ত।”
তারপর? তারপর, এক মহানগরের ব্যস্ত এলাকার ঘরোয়া হাসপাতালের ছ’তলার ঘরে শুরু হলো আমার নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার লড়াই — in my own room on the roof.
আর সেই ঘরে আমার জীবনযাপন, জীবনদর্শনের সঙ্গে আমূল জড়িয়ে যেতে, সঙ্গিনী হয়ে এলো এক দূর মহাদেশের দীর্ঘগভীর কলস্বিনী — আমার মনের দু’পারের অনেক পাঁক, সময়ের পলি, তার স্বচ্ছ উচ্ছল খরস্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল যেন।
(ক্রমশ)