— অনেকটা সেই চলতে ফিরতে ছুটছাট আরশিতে নিজেকে দেখে নেয়া যেন| পাঠ্যবিষয় বা গপসপ যাই হোক না কেন– শিশুর হৃদয়ে তার আসাযাওয়াটা এমনই স্বাভাবিক ভাবে ঘটতে লাগবে যে এক ছটাক মনটি তার আনমনেই আনচান করতে লাগবে— একটি ছেড়ে আরেকটা বিষয়ে|
শিশুর জন্য বই বা বিষয় বাঁধতে বসে এমন এক দুরাশায় নিয়ত উজ্জ্বল হয়ে উঠতেন শিশু মনোবিদ ও শিশুশিক্ষক লাদা আইদারোভা| শিশুর জন্য আলাদা করে বই বাছায় বিমুখ থাকতেন লাদা| লাদার সাফ কথা— যে কোনো বিষয়কে যতদূর পারো শিশুর মতো মানে শিশুর মনে ধরার মতো করে তোলো ভাই|
মজার কথা লাদা আইদারোভার আগে অব্দি গোটা বিশ্ব যাকে শিশুশিক্ষায় এক নম্বর মেনে এসেছে সেই ইতালির গিয়ানি কোটারী কিন্তু বারবার ধমকে গিয়েছেন— ওহে শিক্ষককূল শিশুকে স্রেফ খাতা ভরতি করে আজগুবি বিষয় লিখিয়ে যাও| গ্রামটিকা ডেলা ফ্যানতাসিয়া বই এ গিয়ানি শিশুদের অভ্যেস করানোর জন্য মজার মজার উদাহরণ দিলেন| আলমারির মধ্যে কুকুর কি ধরুন জুতো আর আলোর মেশামেশি| গিয়ানির সাথে লাদার কোনো সাক্ষাৎ বা সমুখ লড়াইয়ের খবর নেই| অন্তত আমি জানি না|
লাদা কিন্তু করলেন দারুণ এক মজা মজা প্রতিবাদ| সম্পূর্ণ অন্য মত পালন করেও লাদা গিয়ানিকে মানলেনও আবার জানু পেতে| গিয়ানিরই কল্পনার অ আ ক খ দিয়ে বানালেন এক আস্ত মস্ত ব্যাকরণ| গিয়ানি শিশুর কল্পনাকে আয়েশ দেবার কথা বললেন– লাদা শুনলেন| কিন্তু তার সাথে যোগ করলেন শিশুর যাবতীয় অশিষ্ট আচরণকে প্রশ্রয় দেবার একটি যুক্তিগ্রাহ্য ফর্মুলা|
ওহ না তো! এ তো ফর্মুলা নয়— এ হলো শিশুর নেশা বোঝার জন্য শিক্ষিকার নিজের ভেতরে ভেতরে একটি নেশা জারিয়ে তোলা| দুপুরবেলা মাসিপিসীদের কদবেলের আচারের মত|
বলতে গেলে পাড়াবেড়ানো খুড়িপিসীদের মতোই ক্লাসঘরে নানারকম সব নাটুকে সংলাপের বোনাবুনিতে ভালোরকম মজা জন্মে যাচ্ছিলো লাদার| ছাত্রদের সাথে মিছামিছি কোন্দল করার ক্লাসে ঢুকে নানা ধানাইপানাই শুরু করতেন লাদা| সেও এক ফাটাফাটি “মিছিমিছি”| পাকা নাট্যকারের চালে একটা নাটকই বানিয়ে ফেলতেন ক্লাসে| ফটাক সে ফটাক|
ক্লাসঘরে পা রেখে খেয়াল করতেন— কোন কোন শিশু তাঁর ক্লাসঘর নাট্যে চরিত্র হতে চাইছে—কতখানি চাইছে এবং কীভাবে চাইছে| কীভাবে একটি সামান্য মুখোশনাট্য দেখে ডুবোডুবো হয়ে যাচ্ছে হচ্ছে| চরিত্র হয়ে নাট্য বা পাঠ্য বোঝার জোরালো ইচ্ছেটা তার আরো খোলতাই হচ্ছে—- খোলস ছাড়াচ্ছে নিজেই নিজের| কারোর জীবনে যে ইচ্ছে কোনোদিন কখনো মেলেনি বা আগামীদিনেও মিলবে না— সেই “বড় হয়ে কী হতে চাও” ধরণের প্রশ্নগুলোকেও লাদা বলতে বলতেন নাটকের সংলাপ করে| ফলে লাদাদেবীর ক্লাসে একটি শিশু চেঁচাল আমি নাবিক হবো —তো দুনম্বরটি দুগুনা ঝাঁপালো তার ইচ্ছে নিয়ে —সে নাকি কোদাল দিয়ে পাহাড় কেটে ভূমি বানাবে| কী করে তা কে জানে| কিন্তু সে বানাবেই| এতসব ইচ্ছেগুলো জুটে শিক্ষক লাদার চক্ষে তখন চলে বেড়াচ্ছে এক পাহাড়প্রমান ইচ্ছেমানুষ|
ভাবা যায়? –এই শিশুবিদটি অবলীলায় ক্লাস ফাইভের বাচ্চাকে দিয়ে লেখাচ্ছেন ক্লাস সিক্সের গল্প বানানো| আর ক্লাস ফাইভের ভারে মানে তার গল্পের ধারে ভারে সেরফ খাবি খাচ্ছে ক্লাস সিক্স| আর সেই ক্লাস ফাইভের হাড়বজ্জাত বাচ্চা ক্লাস সিকসের খাতায় কী লিখেছিল? লিখেছিল একটি প্রার্থনা— পৃথিবীতে কেউ যেন তার গোষ্ঠীর মানুষের মতো নিষ্ঠুর হয়ে না জন্মায়| গল্পের সাথে আনকা এবং সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক এই বাক্যটির মানেটা যখন অনেক চেষ্টা করেও কেউ ধরতে পারলো না–গল্পকার সেই শিশুটি ঠোঁট ফুলিয়ে বলেছিলো, রোজ সে দেখে তার বাবা কিছুক্ষণ জমিচাষের পর যখন ঘেমে চুমে হাঁফায় এক অশ্বরোহী একটি বেজায় লম্বা চাবুক দিয়ে তার বাবাকে মারে|
শিশুর গল্পটি শুনতে শুনতে শিক্ষক লাদা দেখেন–গল্পটি বলতে বলতে আরো মায়ালু হয়ে যাচ্ছে শিশু| থামে না| বলতে লাগে— বলতেই লাগে—-“আহা কী মারটাই আমার বাবাকে মারে গো—. গাছের ডাল দিয়ে মারে| ইয়া ইয়া বড় ডাল|
গপ্পে শিশুর তখন মারকুটে এক বাসনা— পারলে সে ঘোড়ায় চড়া মানুষটার চোখ দুটো নেয় খুবলে| অস্ত্র দেয় বিকল করে|
ভাবতে পারেন— একজন শিক্ষক নিজে কতটা সৃজনশীল ছাত্রকে নিয়ে ছুটতে পারেন কল্পনার এই স্তরে– যেখান থেকে শিশু দেখে তার আগত বাস্তবকেও|
গল্পটা শুনেছেন তো? এবার ভুলে যান| যেমন করে ভুলেছেন শান্তিনিকেতনের বৃক্ষতলের কল্পিত ক্লাসঘরকে ঠিক সেইভাবে| হুবহু সেইভাবে| ব্যাগে পঞ্চাশহাজার ভরুন এবং বাচ্চাটিকে নিয়ে ছুটতে লাগুন প্লেহাউসে— যেখানে শীতে কাঁপা পাখিটি হয়ে থাকে একগাদা দুবছরের পাখি| উড়ে গিয়ে ভিনদেশের তাপ সে নেবে কী করে? পাঁচিল তোলা ঘরে দোলে দোলা–
টিফিনবক্সে আছে তো দামী স্যান্ডউইচ|
খা বাছা গাঁতিয়ে খা|
আকাশের রবি ক্লান্ত হাসেন|
Thik I. Golpo shunlam.
Bhuleo gelam.
Maya horin er pichonei dourochchi.
শিক্ষাবিদ দাদা আইদারাভ এক নজির রেখে গেছেন। বহু মানুষ ওনার পদ্ধতির বিষয় জানেন না। তোমার লেখায় সত্যি সমৃদ্ধ হলাম। শুভ কামনা রইল।
এত ভাল লিখেছ, সত্যিই পাখি গুলো র ডানা মেলতে কোনো উপায় ই নেই। শুধু দিনে দিনে বড়ো হয়, চিন্তা শক্তির কোনো বৃদ্ধি হয় না।