সস্তা বললেই আমাদের মনে একটা কেমন অবজ্ঞার ভাব আসে। আমার আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব প্রায় সবাই দেখেছি, এই একটি ব্যাপারে একমত। সস্তা জিনিস ভালো হতেই পারে না।
আর কদিন পরই হুগলী, মেদিনীপুর আর বর্ধমানে আলু এত সস্তা হয়ে যাবে যে, মাঠেই পড়ে থাকবে। কোন ফরে যদি দয়া করে তুলে নিয়ে যায়, চাষি বেঁচে যায়। মাঠে যে আলু তিন টাকা দামে বিক্রি হবে, সেটাই মাস ছয়েক পর আমরা পঞ্চাশ টাকায় কিনব।
এমন একশ একটা উদাহরণ আছে। বাঁকুড়ার গ্রামের চাষি বাদামী বা কালো চাল চাষ করে বাজার পায় না। ঐ কালো চাল, কলকাতার মলে তিনশ টাকা কেজি দরে ও পাওয়া যাবে না। ডুয়ার্সের চা সস্তা বলে দার্জিলিং চায়ের কাছে দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু এই ডুয়ার্সের চা ভারত বিখ্যাত কোম্পানির মোড়কে বাজারে এলে আমরা খুশি মনে কিনি।
আমার এক ডাক্তার ভাই কোলকাতার বাড়িতে একটা নেড়ি কুকুর পুষেছে দেখে খুব ভালো লাগে। বিদেশী কুকুরের ছানা তিরিশ হাজার টাকা দিয়ে না কিনলে মান থাকে না। অথচ এই একটা নেড়ি কুকুর চটকেল আমাদের গ্রামের বাড়িতে চন্দ্রবোড়া সাপ আটকে হিরো হয়ে গেছে। এই নেড়িরা যে কত অভাগার মত থাকে ভাবা যায় না। অথচ বাড়ীর এটোকাঁটা খেয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়।
পাড়ার যুগলের সেলুনে তিরিশ টাকা দিয়ে চুল কাটালে মান থাকে না; ভারতজোড়া ছড়িয়ে থাকা হেয়ার স্টাইল ডিজাইনার-এর কাছে তিনশ টাকায় চুল কেটেছি বললে বন্ধু মহলে বেশ মান বাড়ে। এসব দেখেই যুগলরাও এখন নতুন নতন ছক বের করছে, চুল কাটতে গেলে ম্যাসাজ, মুখে সাবান, চুলে রং এসব করে একটু পয়সা করছে। বাড়িতে একটা দাড়ি কাটার সরঞ্জাম রাখলেই সবদিন নিজেই দাড়ি কামানো যায়; তবু দেখি সব সেলুনেই দাড়ি কামানোর লোকের লাইন। সেলুনে দাড়ি কামাতে গিয়ে কতো মারাত্মক রোগ ছড়াতে পারে, এসব কি লোকে জানে না?
বাজার থেকে সবথেকে ভালো কাপড় কিনে, ভালো দর্জি দিয়ে প্যান্ট বানিয়ে দেখেছি, ভারত বিখ্যাত কোম্পানির ঝাঁ চকচকে দোকানের প্যান্টের চার ভাগের এক ভাগ দাম পড়ছে। কিন্তু ঐ চারগুণ দামের দোকানের প্যান্টটি না পরলে মান থাকে না।
আমি তিরিশ বছর আগে মেদিনীপুর শহরে কুড়ি টাকা ফি নিয়ে রুগী দেখতাম। একজনকে একটা চোখের ড্রপ লিখে দিলাম। পাঁচ মিনিট পর ফিরে এসে বলল, মাত্র সাড়ে তিন টাকার ওষুধে কাজ হবে? বুঝিয়ে পারলাম না। আমার কাছেই একজন পুরনো ডাক্তারবাবুর চেম্বারে গিয়ে ঢুকল দেখলাম। আমার কিছু শিক্ষা হল।
সেই শিক্ষা কদিন পরেই চশমার ব্যবসায়কে শেখালাম। বেচারা বি কম পাশ করে বেকার বসে ছিল; আমার চেম্বারের সামনে গোটা তিরিশেক চশমার ফ্রেম নিয়ে বসে থাকত। একদিন জানতে চাইলাম, তোমার এসব ফ্রেমের দাম কত? বলল, কুড়ি-বাইশ টাকা। শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মেদিনীপুর শহরে তখন ওসব ফ্রেম ষাট সত্তর টাকায় বিকোয়। ওকে বললাম, এত সস্তা দাম বললে লোকে ভরসা পাবে না, ভাববে কোন নকল জিনিস। তুমি অন্তত একান্ন টাকা দাম বলবে, লোকে দরাদরি করলে এক টাকা দাম কমিয়ে দেবে। তিরিশ বছর পর আমার সেই বন্ধুর দোকানে এখন পাঁচ জন কর্মচারী।
লোককে আর কি বলব; আমার নিজের একটা চোখের ছানি অপারেশন হল। ভারত বিখ্যাত হাসপাতালে ওদের সবথেকে দামী অপারেশন করালাম। চশমা না পরলে তিন লাইনের বেশী দেখি না। আমি নিজেই এক মহিলার চোখের ছানি অপারেশন করেছিলাম, হাসপাতালে, আমার অপারেশনের মাস দেড়েক আগে। সাধারণত অপারেশনের মাসখানেক পর এদের চশমা নিতে ডাকা থাকে। এই মহিলা আসেননি। আমার নিজের অপারেশনের মাস দুই পরে একদিন এলেন। বললাম, এত দেরী করে এলেন কেন? চশমা নিতে ডেকেছিলাম না? মহিলা বেশ জোর দিয়ে বলেন, চশমা কেন নেব? আমি তো সবই দেখতে পাচ্ছি! নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। পড়তে বললাম; একেবারে শেষ লাইন পর্যন্ত পড়ে দিলেন। অথচ ওনার চোখে সরকারী হাসপাতালের সস্তা লেন্স লাগিয়েছি।
আমার বন্ধু ডা গুণ, ডা ভট্টাচার্য, আমাদের শিক্ষক শ্রদ্ধেয় ডা পি কে সরকার স্যর খুব সস্তা ওষুধ দিয়ে, সব রকম রুগীর চিকিৎসা করেন। এই ওষুধগুলো জেনেরিক ওষুধ বলে পরিচিত। বাজারে নামী কোম্পানির একই ওষুধ দশগুণ বেশী দামে বিক্রি হয়। স্বাভাবিক ভাবেই এত সস্তা ওষুধে কাজ হবে কি না, এমন সন্দেহ থেকেই যায়। কিন্তু যে তিনজন ডাক্তারবাবুর কথা বললাম, ওনারা তো তিরিশ বছর বা তারও বেশিদিন ধরে এই সস্তা ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। রুগীর রোগ না সারলে ওনাদের কাছে যাচ্ছে কেন?
এই সস্তা যে কোন জিনিস সম্বন্ধে আমাদের যে মানসিক বাধা বা মেন্টাল ব্লক, এটা প্রায় সর্বজনীন। আমি আমার খুব পরিচিত দোকানে কয়েকটা জিনিস কেনার পর জানতে চাইলাম , বিরীয়ানিতে দেওয়ার গোলাপ জল আছে কি না; তাক থেকে একটা মাঝারী সাইজের বোতল বের করে বলল , দশ টাকা। চমকে গেলাম; এত সস্তা? দোকানদার বলল, একই জিনিস অন্য দোকানে কুড়ি টাকা। কিনে তো আনলাম; ও জিনিস খাওয়ার সাহস হল না। এই বস্তু তো হাজার হাজার লোক খাচ্ছে।
আমার মেয়ে একটা কালো রঙের সেলাই-এর সুতো কিনতে বলেছিল। দোকানে যাওয়ার সময় একটা দু’শো টাকার নোট আর দু’টি দশ টাকার নোট নিয়ে বেরোলাম। দোকানে একটা কালো সুতো দিতে বললাম; দোকানদার বললেন, চার টাকা। বুঝলাম, দশ টাকার নোট দিলেও বিরক্ত হবে। দু’টো দিতে বললাম। এত কম দামে কি করে এ জিনিস দিচ্ছে ভেবে পেলাম না। ঐ সুতোর সস্তা দাম থেকেই এই “সস্তা” লেখাটা মাথায় এল।
সত্যিই কি সস্তার তিন অবস্থা? আসলে আমাদের এই মানসিক বাধাই অসাধু ব্যবসায়ীদের মূলধন।