রাত তিনটে বাজে। বসার ঘরের সোফাতে বসে আছি। গত তিনদিন ধরে এটাই রুটিন। কিছুতেই ঘুমতে পারছিনা। অসম্ভব দুর্বলতা শরীরে, খাওয়ার টেস্ট চলে গিয়েছে। একটু আগে পালস অক্সিমিটারে এক ঘরে বৃদ্ধ মা বাবা আর অন্য ঘরে স্ত্রী আর সাড়ে চার বছরের মেয়ের অক্সিজেন স্যাচুরেসন দেখে এসেছি।
আমরা সবাই করোনা পজিটিভ। খুবই সাবধান ছিলাম। হাসপাতাল থেকে এসে পা ধুয়ে সোজা চান, জামাকাপড় সব সাবান জলে। বাইরের সবকিছু স্যানিটাইজ করে ঢোকাতাম, কাজের লোক না করে দেওয়া হয়েছে (মাইনে পুরোপুরি দিয়েছি ৯ মাস)। মেয়েকে কাছে আসতে দিতাম না, আলাদা শুতাম। কিন্তু তাও আটকাতে পারিনি। আমাদের মত স্বাস্থ্য কর্মীদের পক্ষে আটকানো প্রায় অসম্ভব।
জুলাই মাস, হাসপাতালের সব বেড ফুল। মা-বাবা ৭৫-এর ওপর বয়স ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার, পেসমেকার, এঞ্জিওপ্লাস্টি করা, হিসেব মত হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত, কিন্তু বেড নেই। স্ত্রী সিওপিডি পেশেন্ট সেও হাই রিস্ক। কিন্তু আমাদের কোভিড ইন চার্জ ডাঃ সুব্বারেড্ডি নিরুপায়, কথা দিয়েছেন ইমার্জেন্সি হলে যেনতেন প্রকারে বেড দেবেন।
এখন চিন্তা হচ্ছে মা-বাবাকে ভর্তি করতে হলে কে দেখবে? আমিও তো কোভিড পজিটিভ। আর ওরা ভাষাও জানেন না। অসহায় বোধ করবেন। আরো খারাপ যদি আমাকে আর আমার স্ত্রীকেও ভর্তি হতে হয়,তাহলে আমার করোনা পজিটিভ বাচ্চা মেয়েকে কে দেখবে? এই হায়দ্রাবাদ এ?
আমার কলিগ নেফ্রোলজিস্ট ডাঃ এন্ডুজ আর ওনার স্ত্রী দুজনেই আই সি ইউ-তে ভেন্টিলেটরে। একমাত্র মেয়ে একা বাড়িতে কিন্তু সে একটু বড় আর তাদের আত্মীয় স্বজনরা আছেন এখানে। আমার মেয়ের কি হবে?
একটা উইল লিখলাম মাঝরাতে আমার শালীকে (Madhumanti Chatterjee)। আমাদের দুজনের কিছু হলে মেয়ের দায়িত্ব ওর, সব টাকা পয়সা ইন্সিওরেন্স-এর হিসেব দিয়ে।
এইভাবে এক একটা দিন কাটলো, অক্সিজেন কোথাও ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। একটা অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর কিনলাম একলাখ টাকা দিয়ে। পাঁচজন করোনা পেশেন্ট, বেড নেই, অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই, আগে তো বাঁচি।
এইভাবে এক দিন একদিন করে ১৪ দিন কাটলো। এযাত্রা সবাই বেঁচে গেলাম, এই সৌভাগ্য সবার হয়নি, অনেকেই প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। আজ সেই বিভীষিকাময় সময়ের সাথে যুদ্ধে নতুন অস্ত্র পেলাম।
অসংখ্য ধন্যবাদ বিজ্ঞানীদের, যারা এই ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করলেন। অসংখ্য ধন্যবাদ সমস্ত করোনা যোদ্ধাদের, ধন্যবাদ সরকারকে, ধন্যবাদ সবাইকে, যারা এই যুদ্ধে আমাদের সাথে ছিলেন আর প্রণাম আমাদের সেইসব কমরেডদের যাদের আমরা হারালাম।
ভ্যাক্সিন নিয়েছি, এখনো অব্দি কোন সাইড-এফেক্ট নেই। কোভিশিল্ড।