১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন অনুসারে বাঘ, হাতি, কৃষ্ণসার হরিণের মত সাপ মারাও দন্ডনীয় অপরাধ। ২০২০ সালেও দেখেছি সাধারণ গ্রামের মানুষতো বটেই, শিক্ষিত লোকজনও সাপ মারা যে আইন করে বন্ধ হয়েছে সেটা শুনে বিরক্ত হন। সাপ মারা যে আইনত নিষিদ্ধ এটা আমরা গত বারো বছর ধরে গ্রামে গঞ্জে সব অনুষ্ঠানেই বলছি।
লোকজনের মনোভাব হল, সাপ আমাকে কামড়াবে, আর আমি সাপ মারব না? এ কেমন আবদার? সাপ যে আমাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য কতো জরুরী এটাই বোঝানো যায় না। আমাদের চাষে উৎপন্ন ফসলের বেশীর ভাগই ইঁদুরে খেয়ে শেষ করত যদি সাপে ইঁদুর না খেত।
এই যে সাপও আইনত সংরক্ষণ করা এক রকম প্রাণী, এটা সাধারণ মানুষকে জানানোর দায় কার?
সাপের বাঁচা মরার সাথে আমাদের সরাসরি কোন যোগ নেই, বা থাকলেও আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু এই সাপের কামড়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যায় প্রতি বছর। সাপের কামড়ের চিকিৎসা এখন গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রেই পাওয়া যায়। তবু হাজার হাজার মানুষ সাপে কামড়ালে ওঝার কাছে দৌড়ায়। এই ওঝার কাছে দেরী হয়ে যায় বলেই বেশিরভাগ মানুষ পরে হাসপাতালে এলেও বাঁচানো যায় না। এই ওঝাগিরি, ঝাড়ফুঁক, মাদুলী কবচ আইনত নিষিদ্ধ; তবুও তো শত শত বছর ধরে চলেই আসছে। গত বারো বছরের উপর আমরা এই নিয়ে ব্যাপক প্রচার করে যাচ্ছি; আজ পর্যন্ত একজন ওঝাও গ্রেপ্তার হয়েছে বলে আমরা শুনিনি। ওঝার কেরামতিতে শত শত মানুষ মারা গেছেন, একটা ওঝার নামে থানায় অভিযোগ হয়েছে বলে শুনিনি।
রাজা রামমোহন রায় শ’ দেড়েক বছর আগে সতীদাহ বন্ধ করার জন্য বিদেশী শাসকদের দিয়ে আইন করিয়েছিলেন। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইনও আমাদের দেশে বেশ পুরাতন। কিন্তু এখনও কি বাল্য বিবাহ বন্ধ করা গিয়েছে? মাঝে মাঝে খবর দেখা যায় যে, কোন স্কুলের ছাত্রীর বিয়ে আটকেছেন কোন শিক্ষিকা। কিন্তু তার পর ঐ বিয়ের কুশীলবরা কেউ আইনত দণ্ড ভোগ করেছে, এমন তো শোনা যায় না।
সিগারেট খাওয়া যেমন যে খাচ্ছে তার নিজের, তেমনি তার পাশের লোকটির জন্যও ক্ষতিকর, এটা আজ আর কাউকে বলে দিতে হয় না। আমাদের দেশে প্রকাশ্যে ধূমপান আইনত নিষিদ্ধ। এই যে একটা আইন এদেশে আছে, এটা লাখে একজন লোকও জানে কি? উল্টে কোন ধূমপায়ীকে একথা বলতে গেলে নির্ঘাৎ মারধোর খেতে হবে। শুধু রেলের এলাকায় ধূমপান বন্ধ করার জন্য রেল থেকে বছরের পর বছর ব্যাপক প্রচার করা হচ্ছে। তবুও তিন চার জনের দল হলেই, বেপরোয়া হয়ে বিড়ি সিগারেট খাওয়া চলে, চলন্ত ট্রেনের ভেতরে। রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে সিগারেট খাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে দু এক জনকে ধরে জরিমানা করা হয়েছে, তাই আজকাল প্লাটফর্মে সিগারেট টানছে এমন দেখা যায় না। কিন্তু এই লোকগুলোই প্ল্যাটফর্ম থেকে দু’ পা নেমে, লাইনের উপর দাঁড়িয়ে নির্বিকার চিত্তে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। ওটাও যে রেলের এলাকা, এটা কি তারা জানেনা?
আচ্ছা, সিগারেট খাওয়া আটকানোর জন্য এত আইনের কি দরকার? দেশে তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন বন্ধ করে দিলেই হয়। বাস্তবে তামাক জাত পণ্যের থেকে সরকার যতো টাকা ট্যাক্স রোজগার করে, তার থেকে বেশী টাকা তামাকের থেকে তৈরী রোগের পিছনেই খরচ হয়, সরকারের।
আমার এক শিশু বিশেষজ্ঞ দাদা আমাকে জানালেন যে, বাচ্চাদের কৌটোর দুধ খাওয়ানো বন্ধ করার জন্য ওনাদের সর্ব ভারতীয় সংগঠন ব্যপক আন্দোলন করেছেন। ওনাদের আন্দোলনের ফলে ২০০৩ সালে ভারত সরকার আইন করে কৌটোর দুধের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করেছে। তার পর আঠারো বছর পেরিয়ে গেছে, এখনও কি শিশুদের জন্য মারাত্মক ঐ সব জিনিসের ব্যবহার বন্ধ হয়ে ছে?
আমি মাত্র কয়েকটিই উদাহরণ দিলাম, যেখানে সাধারণ মানুষের কল্যাণে আইন হয়েছে, কিন্তু আমাদের বদ অভ্যাস বন্ধ করা যায় নি। সরকার বা আইনের রক্ষকরা আর কি করতে পারে? নীতি মালার শ্লোকে আছে, “যস্য নাস্তি স্বয়ং প্রজ্ঞা শাস্ত্রং তস্য করোতি কিম। লোচনাভ্যাম বিহীনস্য দর্পনং কিং করিস্যতি।।” যার নিজের বোধবুদ্ধি নেই শাস্ত্র বা আইন তার কি করবে? আসলে আইন মানার জন্য যে জাতীয় চরিত্র দরকার, আমাদের দেশের মানুষের সেটা তৈরীই হয় নি। আমাদের সামনে আদর্শ কি বা কারা?
প্রফেসর সান্যাল একজনের ক্যান্সার বিজ্ঞানী। তামাক বিরোধী প্রচারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। উনি একদিন দুঃখ করে বলছিলেন, আমাদের এক ভয়ঙ্করভাবে আদর্শবাদী তাত্ত্বিক নেতার সাথে উনি দেখা করেছিলেন, এই ক্যান্সার প্রতিরোধের কাজে সাহায্য আশা করে। সান্যাল স্যর-কে চমকে দিয়ে ঐ বিখ্যাত নেতা বলেছিলেন, “আপনাদের কি আর কোন কাজ নেই, এসব বাজে কাজে কেন সময় নষ্ট করছেন?” এ দেশে আইন করে কি হবে? আইন যারা মানতে বলবে তারাই যে আইন মানে না।
গাড়ী চালানোর সময় সিট বেল্ট বাঁধা আর বাইক চালানোর সময় হেলমেট পরা, এ কার জন্য? এটা করলে কার লাভ? এর জন্য আইন কোন সভ্য দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। এ যেন আইন করে বলতে হচ্ছে, জুতো না পরে রাস্তায় বেরনো চলবে না। কিংবা তোমার বেগ এলে হাগু করতেই হবে, না হলে আইন মত শস্তি পাবে!