এই তো ক’দিন আগেকার কথা, তার পর একটি সপ্তাহও পার হয়নি। স্বনামধন্য এক মন্ত্রী সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে জানালেন, অমুক অঞ্চলে কিছু ডাক্তার আবার দিনে ডাকাতি শুরু করেছে, এদের দাওয়াই দরকার।
প্রশ্ন করা যেতেই পারত, তাঁর মতো দাপুটে মন্ত্রীর এলাকায় ডাক্তার/উকিল/ব্যবসাদার/শিক্ষক/ইত্যাদি প্রভৃতি যে-ই হোন না কেন, তিনি ‘দিনে ডাকাতি’ করার সাহস পান কী করে, যেখানে স্বয়ং মন্ত্রীমহোদয় ও তাঁর দলের নিষ্ঠাবান কর্মী-সমর্থকরা রয়েছেন? তদুপরি, সেখানে তো নজর রাখার জন্য সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণে থাকা কর্মদক্ষ ও অতিমাত্রায় তৎপর প্রশাসকরা রয়েছেন, তাঁরাও কি সকলে একযোগে দায়িত্ব বিস্মৃত হয়েছেন?
অথবা এও জিজ্ঞেস করা যেতে পারত, পশ্চিমবঙ্গের মতো সততার সুনিবিড় ছায়ায় ঢাকা একটি রাজ্যে ‘কিছু ডাক্তার দিনে ডাকাতি’ শুরু করায় মন্ত্রীমহোদয় যে অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছেন, তাঁর সেই মনোকষ্ট আমরা মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারছি অবশ্যই – কিন্তু, তারপরও, ‘দাওয়াই দিতে হবে’ কথাটা কি তাঁর মতো সৎ শৃঙ্খলাপ্রেমী শান্তিপ্রিয় নেতার মুখে মানায়? বিশেষত যেখানে তাঁর সৎ ও নিয়মনিষ্ঠ সরকার ডাক্তারদের দায়িত্বের বিন্দুমাত্র স্খলন দেখলেই তার সুরাহা করার জন্য পাঁচসাতরকম ব্যবস্থা রেখেছেন – দেওয়ানি আদালত ফৌজদারি আদালত ক্রেতা সুরক্ষা আদালত মেডিকেল কাউন্সিলের তদন্ত ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইনানুসারী শাস্তি সরকারি ডাক্তারদের ক্ষেত্রে বিভাগীয় তদন্ত – দুচারখানা পয়েন্ট মিস করে গেলে মনে করিয়ে দেবেন, প্লিজ – তো তেমন ‘চলো নিয়মমতে’-র দেশে আগ বাড়িয়ে ‘দাওয়াই’ দেওয়ার আহ্বান তো ঠিক কথা নয়, তাই না?
কিন্তু আমরা সেসব প্রশ্ন করিনি। ইন ফ্যাক্ট, আমরা কিছুই বলিনি।
আমরা বলতে ডাক্তাররা। শুধু একটু শঙ্কিত হয়েছিলাম, কেননা ফুলের সুবাস সামান্য কিছু অঞ্চলে সীমিত থাকলেও পচা লাশের গন্ধ আরেকটু দূর অবধি ছড়ায়। অনুপ্রেরণাও তেমনই। স্থানীয় স্তরে থেমে থাকে না। বিষয় অনুসারে ছড়ায়। অতএব, ‘দাওয়াই দিতে হবে’ জাতীয় সুপরামর্শের অনুপ্রেরণা – বা উসকানি – যে শুধু মন্ত্রীমশাইয়ের খাসতালুকে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে না, সে আশঙ্কা আমাদের ছিলই। তদুপরি, এ এমন শাসনকাল, যা দেখলে জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশ স্বয়ং গর্ববোধ করতেন। কেননা, তাঁর সেই ঐতিহাসিক আক্ষেপ, “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে” – তেমন আক্ষেপের আর বিশেষ অবকাশ নেই। দিকে দিকে রাশি রাশি তেমন তাজা ছেলেদের ভিড়, যারা মাঝেমধ্যে ‘ছোট ছোট ছেলেদের ভুল’ করে বসলেও বসতে পারে, কিন্তু তারা কথা বাড়ায় না, এবং বলাই বাহুল্য, ‘কাজ’-এর ব্যাপারে তাহারা কদাপি পরাঙ্মুখ নহে।
বক্তব্যের কেন্দ্র থেকে কিঞ্চিৎ দূরে হলেও, মন্ত্রীমহোদয়ের উদাত্ত আহ্বানে সত্ত্বর সাড়া মিলেছে। তাম্রলিপ্ত মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সিতে কাজ করার সময় দুই সদ্য-পাশ-করা তরুণ শল্যচিকিৎসককে কিছু তাজা ছেলে বাঁশ রড থান ইঁট ইত্যাদি সহযোগে মারধর করেছেন – গতকাল। আপনারা শুনে আশ্বস্ত হতে পারেন, দুই গণশত্রুই উচিত শিক্ষা পেয়েছে, দুজনেই গুরুতর জখম। দাওয়াই-এর পরিসর হাসপাতালে সীমাবদ্ধ না রেখে তাজা ছেলেরা লাগোয়া ছাত্রছাত্রীদের হস্টেলেও চড়াও হয়েছিলেন – দুর্ভাগ্যবশত সেখানে তেমন কৃতিত্বের স্বাক্ষর তাঁরা রেখে আসতে পারেননি।
মোদ্দা খবর বলতে এই। আগের আগের অনুচ্ছেদে ‘আমরা বলতে ডাক্তাররা’ বললাম, কেননা ডাক্তারদের গায়ে হাত-টাত পড়লে তথাকথিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন একযোগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, এমন নজির খুব একটা দেখিনি (ভুল কিছু বললে শুধরে দেবেন, প্লিজ)।
তো সাতিশয় বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করি, যে দুজন সদ্য-পাশ-করা শল্যচিকিৎসক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে জীবন শুরু করার মুহূর্তে এই অভিজ্ঞতার মুখে পড়লেন – এবং একইসঙ্গে তাঁরা আপনাদের হিরণ্ময় নীরবতাও প্রত্যক্ষ করলেন – পেশাজীবনে বৃহত্তর সমাজের প্রতি তাঁদের কী মনোভাব নিয়ে চলা উচিত বলে আপনার মনে হয়?
মেডিকেল কলেজে পড়তে আসা প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা – কিছু গুণ্ডা যখন মদ্যপ অবস্থায় বাঁশ রড থান ইঁট নিয়ে তাদের হস্টেলে চড়াও হয়, এবং স্রেফ বরাতজোরে সেই ছাত্রছাত্রীরা বেঁচে যায় – চিকিৎসা-শিক্ষাজীবনের শুরুর এই অভিজ্ঞতা এবং সবকিছু দেখেও আপনাদের চুপ করে থাকা – এমন সামগ্রিক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তাদের ভবিষ্যৎ পেশাদর্শন ঠিক কেমন হওয়াটা স্বাভাবিক? আপনার কী মনে হয়??
এত কথা বলার অবশ্য মানে হয় না।
মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বেরোলে মেধাতালিকার প্রথমদিকে থাকা এক ছাত্র জীবনের লক্ষ্য হিসেবে জানায়, তার স্বপ্ন সে ডাক্তার হওয়া। সেই স্বপ্নের কথা কেউ শেয়ার করলে তার ঠিক নিচে কোনও এক বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তি মন্তব্য করে – বাঃ! খুব ভালো। হারামের পয়সা আর কমিশন কাটমানি কোথায় আছে, সেটা শুরুতেই বুঝে নিয়েছে।
সেই মন্তব্যে বেশ কয়েকজন লাইক দিয়েছে, অনেকে হাহা ইমোজি দিয়েছে, আর কেউ কেউ লাভ। কিন্তু কেউই প্রতিবাদ করেননি।
মাইরি বলছি, অপরিণতবুদ্ধির বশে আগে কিছু উচ্চ আদর্শের কথা বিশ্বাস করলেও আজ স্পষ্ট বুঝতে পারি – হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি, এই ঘুণধরা পচাগলা পূতিগন্ধময় সমাজটা আপনার পক্ষে, আপনাদের পক্ষে পার্ফেক্ট [এবং তার বিপরীত কোনও আদর্শে যে কতিপয় সংখ্যক লোক বিশ্বাস করতে চায়, তারা আস্ত বোকা (চাইলে বাকিটা জুড়ে নিতে পারেন)]। কেননা, আপনাদের চরিত্রগত ক্লীবতা আপনাদের ঘেন্না শেখাতে পারেনি (পারছে, তেমন প্রমাণ অন্তত নেই) আর যারা ঘেন্না করতে পারে না, যারা রেগে যেতে শেখিনি, তারা মানিয়ে নেয়। এবং মানিয়ে নিতে নিতে তারা সেই সিস্টেমেরই অংশ হয়ে যায়। আর, পাব্লিক গেটস দ্য সিস্টেম দে ডিজার্ভ।