জলের তল যে কত গহীন হতে পারে রামকান্ত জানে না । বয়োবৃদ্ধ ঝুঁকে পড়া অশ্বত্থ গাছের শীতল ছায়ায় বসে দীঘির জলের গভীরতা সে শুধু আঁচ করতে পারে। বয়স তো কম হল না রামকান্তর। ভোটের কাগজে একাত্তর। জানে না সেই বা ঠিক কি না?
রামকান্ত পাড়ুই, মদনপুরের পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা।
একবার ভরা বর্ষায় ডুবে গেছিল এই বারো বিঘার পুকুরে। তখন তার বয়স কম। তাল সমান জলে হাবুডুবু খেয়ে বেঁচে গেছিলো কোনরকমে । তখন থেকে সে জানে পুকুরের গভীরতা কত।
সব মিলিয়ে ঘাটের সংখ্যা পাঁচ। সে বসে আছে দক্ষিণ পশ্চিম কোণে।
এখানে রোদ্দুর কম আর ঝামেলাও কম। দুষ্টুু ছেলেরা ভয় পায় এই কোণের দিকের গেছো আঁধারকে। মগ ডালে দু একটা পাখি বা বাদুড় আওয়াজ করে বটে তবে বাকিটা নিশ্চুপ।
টোপ ফেলে বসে থাকে রামকান্ত, পঞ্চায়েতের প্রাক্তন নৈশ প্রহরী।
একটা ঘাঁই দিলো জলে। গভীর জলের কোন মাছ। এলে বেলে মাছের ছটাং ফটাং চেনে রামকান্ত। এ তেমন নয়। পাঁকে ডোবা মাছের বুড়বুড়ি নয়। এ মাঝ-গভীরতায় ভেসে বেড়ানো রাজকীয় মাছ। মধ্যিখানে অনেকটা জলের উত্তোলন আর তাকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়া ঢেউয়ের বৃত্ত। কাতল,রুই,মৃগেল বা কালবৌশ হবে ।
আজ টোপটা জবরদস্ত বানিয়েছে সে । পাঁউরুটি, পিঁপড়ের ডিম, মধু আর আটা মাখা। তার আগে ছড়িয়ে দিয়েছে চার হিসেবে মোটা চালের ভাত,ধানের ভূসি, একাঙ্গি, আমাদা আর মেথির গুঁড়ো মিশ্রণ । সুগন্ধে হাতটা এখনো ম’ ম’ করছে।
হাতে পুরোনো হুইল ছিপ, তার ছেলে কলকাতার বড়বাজার থেকে এনে দিয়েছিলো ।
বুড়ো বাপকে ছেলেটা হতচ্ছেদ্দা করে না। অসুখে বিসুখে হাটখোলার বিধু হোমিওপ্যাথকে দেখিয়ে নিয়ে আসে । উৎসব অনুষ্ঠানে একখানা ধুতি কাপড়,একটা গেঞ্জি বা লুঙ্গি দেয়। তারও যে অবস্থা ভালো তেমন নয়।
সে আমলের পঞ্চায়েত প্রধানকে হাতে পায়ে ধরে একটা ঠিকে পিওনের কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলো আমতলি গ্রামপঞ্চায়েতে। সেভাবেই আছে, ‘পার্মেন্ট’ আর হয়নি। তবে ‘না খেতে পেয়ে’ নেই। দুবেলা জুটে যায় দু মুঠো। তার ও তো সংসার আছে।
ছেলের আবার এক দোষ। সন্ধ্যে হলে পঞ্চু সা’-র দেশি মদের ঠেকে একবার ঢুঁ মেরে আসে। গম্ভীর হয়ে বাড়ি ফেরে। আর টুঁ শব্দ না করে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে।
গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে একটু আধটু বাঁকা আলো এসে পড়ছে ফাৎনায়। ময়ূরের পালকের ফাৎনা। টোপটায় ঠোকর দিলে ফাৎনা নড়ে ওঠে। পুঁটি, চ্যালা, মৌরলা, ট্যাঁংরা -র মতো ছোট মাছ ঠুকরে যায় টোপ, তবে তার জন্য যে নড়া সেটা খুব তির তিরে।
বড় মাছ গিলে খায়। আর যদি নাও গেলে ঠোকরটা বড় হয়। ঠিক সময়ে ছিপের ঝটকা টানে বেফাঁস বড়শী বিঁধে যায় হাঁ মুখের কিনারে ।
একটা শেয়াল সর্ সর্ করে পেছনের বাগান থেকে বেরিয়ে তাকে দেখে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হেঁচে আবার বাগানে ঢুকে গেলো।
রাতের প্রহরার সময় এই ভিটরে শেয়ালগুলো তাকে চিনতো । মনে হয় এখনও চেনে। তাই চেনা লোককে দেখে জানান দিয়ে গেলো কিছু।
বাগের পোতায় অমাবস্যার নিশুত রাতে ঘোর অন্ধকারে চারু দাইকে ভূতের মতো দেখে আঁতকে উঠেছিল জোয়ান রামকান্ত। রাম রাম বলে বাঁশ ঝাড়ে গা লুকিয়ে দেখে কি একটা মাটি চাপা দিচ্ছে চারু। উচ্চবাচ্য করে নি। টর্চটা অবধি জ্বালে নি সে।
পরের রাতে টানে টানে অকুস্থলে গিয়ে দেখে একটা ভিটরে শেয়াল মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে কি একটা টেনে কচমচ করে চিবিয়ে খাচ্ছে।
– হাঃ ভগবান! বলে সে চোরের মতো পিছিয়ে এসে পালিয়ে যায়।
শেয়ালটা শয়তান, না ঐ চারুই শয়তানি। কানাঘুষো শুনেছিলো । পূব-পাড়ার এক কুমারী মাকে চারু কি সব শিকড় বাকড় দিয়ে সে যাত্রায় নিস্কৃতি দিয়েছিলো।
সেই পাপের ভাগি হয় চারু, বুড়ো বয়সে কুষ্ঠ রোগে ‘এক ঘরে’ হয়ে গেলো। লোকে বলে ও নাকি ইনফেকশন এক রকমের। রামকান্ত জানে এ তার পাপের ফল।
একটা ঠোকরে অনেকটা নেমেছিলো ফাৎনা। ঝুল বুঝতে পারেনি সে। টানে কিছু উঠলো না। শুধু শুধু টোপটা ভেঙে গেলো।
কত পাপী রেতে-বিরেতে কুকর্মের ভাগীদারী হয়। রাতের আঁধারে হাঁসুয়া দিয়ে গলা নামিয়ে দিয়ে দিব্যি দিনের বেলায় গায়ে নামাবলী চড়ায়।
গফুরের ছেলে লতিফ, রাতের প্রথম টহলে চোখে পড়ে যায় শরিকী ঝামেলায় তার চাচাতো ভাইকে মসজিদের পেছনের ফাঁকা মাঠে কুপিয়ে গলা নামিয়ে গা ঢাকা দেয়। মাসের পরে মাস বেপাত্তা লতিফকে জালে তুলতে হিমসিম খেয়ে যায় দুই থানার পুলিশ।
পরে তার পয়সাওলা বাপ থানায় গিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে আসে।
সে সাক্ষী দিতে পারতো। তাতে রাগটা এসে পড়তো তার ওপরে। চোর পুলিশে মিলে গিয়ে সে পড়তো মহা ঝামেলায়। তবে সে তো চক্ষুষ্মান করে ঘটনাটা।
পাহারাদারি করা এক, আর খুনের সাক্ষী দেয়া এক। দুটো তো আর এক নয় । চোরকে তাড়ানো আর গৃহস্থকে সজাগ করার সাথে খুনের সাক্ষী দেয়া কি এক? চোররাও কম চালাক নাকি। টর্চ হাতে ঘুরতে দেখলে তারাই সজাগ হয়ে যায়।
হাতে হ্যারিকেন আর লাঠি নিয়ে শুরু হয় প্রহরীর জীবন। পরে আসে চার ব্যাটারির টর্চ। তবে খেটে লাঠিটা ছিলো শেষতক ।
সেই সকালে এসে বসেছে সরঞ্জাম নিয়ে। অন্য দিন ক্ষিদে পায়। আজ ক্ষিদে তো পাচ্ছে না উল্টে পেটটা ভারি ভারি লাগছে। একটা ঢেকুর উঠলো। চাপা অম্বল নাকি?
নাঃ, বিকেলে বিধুর কাছ থেকে এক শিশি সাদা দানা নিয়ে আসতে হবে। নতুন টোপ দিলো। একটু বড়ো আর শক্ত করে। একটা মহা রুই টোপ গিলেছিল গত বর্ষার শেষে। এক খ্যাঁচ টানে আটকে গেছিলো বড়শিতে। তারপরের পনেরো কুড়ি মিনিট কি টানাটানি। পারেনি রামকান্ত। হাল ছেড়ে দিয়েছিল। দম ফুরিয়ে এসেছিল। শেষ মেষ একটা প্রকান্ড লাফ দিয়ে জলের ওপরে উঠে আবার ডুবে যায় জলের গভীরে । আর সূতো কেটে বেরিয়ে যায় সেই দশ সেরি মহা রুইটা।
যুদ্ধটা তার সাথে নয়। তবে নিজের সাথে। কি এমন বয়স তার। তার বাপ আশি পেরিয়েও পরের ক্ষেতে লাঙ্গল দিতো। একটা মাছ বড়শিতে বেধে বেরিয়ে গেলো। এ কি কম লজ্জার কথা।
ছায়াতেও একটু ঘাম হচ্ছে রামকান্তর। বদনায় ঠান্ডা জল আছে এক ঢোক মুখে দিলো। বুকের চাপটা একটু কম মনে হলো। ফাৎনাটা কি একটু ঝাপসা দেখাচ্ছে? চোখটা এবার না কাটালে নয়। মাথাটায় কেমন যেন চক্কর দিচ্ছে। ঐ তো ফাৎনাটা একটু ডুবে আবার উঠলো।
আঃ একটা ফিনকি ব্যথা বুকের মাঝামাঝি থেকে ছুরির ফলার মতো পিঠের দিকে গেঁথে গেলো। দমটা আটকে এলো গলার কাছে।
আবার ডুবে গেলো ময়ূরের পালকের ফাৎনার টুকরো। আর সুযোগ পাবে না। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। না,না ঠিক নয়। শত্রু নয় প্রতিদ্বন্দ্বী ।
বুকের বাঁদিকটা বাঁ হাতে চেপে এক ঝটকায় ছিপটা তুলে নেওয়ার সাথে সাথে হুইলের সূতো ছাড়ার মধুর ক্রির ক্রির শব্দ কানে এলো। আর ডান হাতে ভারি চাপ অনুভব করলো।
একটানে সূতো চলে গেল মাঝ দরিয়ায়। আরো আরো দূরে চলে যাচ্ছে সূতোর টান।
দম আটকে আসছে। দর দর কর ঘামছে রামকান্ত। হাঁপরের মতো পাঁজর ওঠা নামা করছে। অসম্ভব ব্যথা বুকে। কোন রকমে সূতো গুটিয়ে নিলো কিছুটা, আবার সরে গেলো মাঝ বরাবর।
সূর্য কি ডুবে গেছে। এতো আঁধার কেন চোখে? মাঝরাতের তারারা চোখে ফুলকির মতো ফুটছে। আর পারছে না রামকান্ত। আরো কতক্ষণ চললো যুদ্ধ তার খেয়াল রাখে না রামকান্ত। বুকে ড্রামের শব্দটা কমে আসছে ধীরে ধীরে। হাঁ করা মুখেও পুরো নিশ্বাস পাচ্ছে না।
শিথিল মুষ্ঠি থেকে হুইল সমেত ছিপটা জলে ছিটকে পড়ে ডুবে গেলো বড়শীতে বিঁধে থাকা মাছের টানে ।
অসহায় রামকান্ত এই ছায়াঘন অশ্বত্থের নীচে ক্লান্তি আর ব্যথায় নীল হয়ে ঢলে পড়লো বাঁদিকে। তখনও মাঝ পুকুরে ছিপটাকে গভীর জলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বড়শিতে গাঁথা কালো জলের শ্যাওলা পড়া মহা রুই শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে। সে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে কুর্নিশ করে।
আশা করে, আজ হোক কাল হোক আবার যেন তাকে পায় ঈশান কোণের ঐ আলো আঁধারে।