খুব স্পষ্টত দু’টো বিষয় নিয়ে বলার আছে। প্রথমটি প্রশ্ন, দ্বিতীয়টি আশঙ্কা।
এক, হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত সংক্রমণে (পোশাকি নাম Nosocomial infection) যদি এমন ব্যাকটিরিয়ার হদিশ পাওয়া যায় যারা বেশিরভাগ অথবা সমস্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী (Extensively drug resistant) এবং সেই সংক্রমণে একজন রোগীর অনর্থক শারীরিক জটিলতা/ অবস্থার অবনতি/ অথবা দুঃখজনক মৃত্যু হয় তার দায় তাহলে শুধুমাত্র হাসপাতালের?
হাসপাতাল চত্বরে, ওয়ার্ডে বিশেষত আইসিইউ তে এই ধরণের ব্যাকটিরিয়ার সংখ্যা খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে; এবং স্বাভাবিক কারণেই তাদের নির্মূল করার জন্য প্রয়োগ করতে হয় বড়সড় এবং কড়া (পোশাকি নাম Broad spectrum) অ্যান্টিবায়োটিক। ফলে ওপরের খারাপ ধরণের ব্যাকটিরিয়াদের মিউটেশন এবং প্রতিরোধও ঘটে দ্রুত– তাদের মারার জন্য আরও কড়া অ্যান্টিবায়োটিক– একটা ভিশাস সাইকেল!
এবার ব্যাপার হল হাসপাতাল- নার্সিংহোমেরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকে এই লড়াইতে? না, গাইডলাইন মেনেই জীবাণুনাশক রাসায়নিক দিয়ে মেঝে পরিষ্কার হয়, ফিউমিগেশন হয় ওটি- আই সি ইউ, যে কোনও সার্জিকাল প্রসিডিওরে হাত ধোয়া থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি হয়ে সামান্য একটা তুলো বা মপ পর্যন্ত মেনে চলা হয় সর্বোচ্চ মানের জীবাণুমুক্ত করার পদ্ধতি (Aseptic techniques)
কিন্তু এরপরেও সমস্ত সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব নয়, কারণ হাসপাতালে ডাক্তার- নার্স মিলে কোনও গোপন ডেরায় বিষাক্ত জীবাণুর চাষ করেন না, জীবাণুরা উল্টো পথে হাসপাতালে আসে রোগীর শরীর বেয়েই। নানান ধরণের রোগী, তাদের বিভিন্ন ধরণের সংক্রমণের পেছনে লুকিয়ে থাকে ততোধিক নানান ধরণের ব্যাকটিরিয়ারা। তারা বংশ পরম্পরায় ঘর সংসার বাঁধে হাসপাতালের কোণায় কোণায়, বিবর্তনের নিয়মে শক্তিশালী হয়ে বেঁচে থাকতে শেখে, শিখিয়ে যায় সন্তানদের। কালের নিয়মে, সম্ভাবনার অঙ্কে তাদের কোনোটি সামান্য ব্রোকার, কোনোটি আবার হয়ে ওঠে হর্ষদ মেহেতা আর কেতন পারেখ!
ফলে আজ যদি একজন রোগীর ভয়ঙ্করতম ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণে এবং তারপর দুঃখজনক মৃত্যুতে হাসপাতালকে দায়ী করা হয় তাহলে প্রশ্ন জাগে, মাননীয় বিচারপতি ঠিক কাকে দায়ী করলেন? অভিযোগটা ঠিক কী? উক্ত হাসপাতালেই কেন এই ধরণের ব্যাকটিরিয়া তৈরি হয়ে সংক্রমণ হ’ল? নাকি কেন সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করল না? কেউ কি প্রশ্নগুলি করতে গিয়েও একবার বুঝতে পারছেন না যে নিজের কানেই কতটা বোকাবোকা শোনাচ্ছে সেগুলো?
মুড়ি মুড়কির মত অনিয়ন্ত্রিত ওভার দ্য কাউন্টার অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি এবং তার দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যবহারে কমিউনিটিতে যে XDR ব্যাকটিরিয়া তৈরি হচ্ছে, রোগী যাকে গোপনে শরীরে করে বয়ে নিয়ে আসছে হাসপাতালে, তার জন্য শুধু শেষতম ধাপ আই সি ইউকে দায়ী করে হাত ঝেড়ে ফেললে এই প্রচন্ড জটিল এবং ভয়ানক সমস্যাটার সমাধান হয়ে যাবে? প্রতিটি হাসপাতালে, প্রত্যেকটি নার্সিংহোমে যেখানে জটিল রোগীরা ভর্তি থাকে, তাদের চিকিৎসা হয়, সেখানে প্রবাবিলিটি এবং রিয়েলিটির যে কোনও অঙ্কেই গিজগিজ করছে এরকম ব্যাকটিরিয়ারা। তাদের বিরুদ্ধে শেষতম অ্যান্টিবায়োটিকও আর কাজ করছে না জানার পর এবং এ খেলার শেষতম ধাপে পরিবার- সমাজ- আদালতের অভিযোগ আর শাস্তির ট্রফি অপেক্ষা করছে জানার পর তাহলে ডাক্তারদের কী করণীয় এবার? মেডিসিনের ডাক্তার কি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারে ছুটবেন? নাকি সার্জেন ছুটবেন ড্রাগ রেগুলেশনে কড়া আইন আনতে? তাহলে এবার মূত্রনালীতে সংক্রমণের চিকিৎসা থেকে শুরু করে গলব্লাডার সার্জারি- সবই বন্ধ করে দেওয়া উচিত নয় কি?
______________________________________________
এবং অভিমান জড়িত প্রশ্নের পিঠেই এবার আশঙ্কার উপাখ্যানঃ
‘অ্যাসিনেটোব্যাকটর বাউমানি’ অথবা ‘ক্লেবসিয়েল্লা নিউমোনি’রা আপনাদের জন্য শুধুই কিছু দাঁতভাঙা ব্যাকটিরিয়া আর ‘কলিস্টিন’ একখানা ফ্যান্সি আর নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের নাম হতে পারে। কিন্তু আমাদের এখনও আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে এসব সাক্ষাত মৃত্যুদূতের নাম শুনে, এদের বিরুদ্ধে লড়াইতে আমাদের শেষতম হাতিয়ারও আর কাজ করছে না শুনে মুখে জুড়ে জমে ওঠে আশঙ্কার কালো মেঘ!
আজ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ছবিটা গোটা পৃথিবী জুড়ে ঠিক এরকমই। 1928 এ ফ্লেমিং সাহেব এবং পেনিসিলিনের হাত ধরে যে যুগ শুরু হয়েছিল আজ তার একশ বছরও হয়নি, তবু গোটা পৃথিবীর স্বাস্থ্যকর্মী সহ বিজ্ঞানীদের কপালে দুশ্চিন্তার গাঢ় রেখা। কারণ একদিকে নিতান্ত বিবর্তনগত জায়গা থেকেই যেমন প্রতিনিয়ত রূপ বদলায়, বদলাচ্ছে ব্যাকটিরিয়ারা আর আমাদের অনিয়ন্ত্রিত এবং অযৌক্তিক ব্যবহারে আমরা নিজেরাই তাদের সুবিধে করে দিচ্ছি, উল্টোদিকে এই লড়াইতে বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছরে আমাদের তূণীরে নেই নতুন কোনও অস্ত্র! নতুন একখানা মলিকিউল বাজারে আনতে ড্রাগ কোম্পানির খরচা হয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আর অন্ততপক্ষে দশ থেকে বারো বছর, উপরন্তু অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রিতে লাভের মার্জিন তুলনামূলকভাবে কম! কার আর দায় পড়েছে লাভ- ক্ষতির এই অসম হিসেবের আগুনে সেধে নিজের হাত পোড়ানোর!
ফলে অ্যান্টিবায়োটিক অ্যাপোক্যালিপ্স আপাতত আসন্ন। এদিক ওদিক থেকে তারই কিছু টুকরো খবর উড়ে আসে বসন্ত বাতাসে। আর অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রিতে লাগাম না পরিয়ে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে জনসচেতনতা গড়ে তোলার দায় না নিয়ে অভিভাবকেরা দিন শেষে শুধু হাসপাতাল আর ডাক্তারদের কান মলে দিয়ে, জরিমানা চাপিয়ে দায় সারে নিজেদের! একটা মাল্টিফ্যাসেটেড, জটিল সমস্যার সমাধানের জন্য যে পরিমাণে সচেতনতা, সদিচ্ছা এবং উদ্যোগ প্রয়োজন, দুর্ভাগ্যবশত আমাদের অভিভাবকদের কারোরই সেসব নেই। ভৌগোলিক এবং আর্থসামাজিকভাবে ভারতের মতো সংক্রমণ প্রবণ এক দেশে আমরা শুধু দিন গুনি ব্যাকগ্রাউন্ডে “ইয়োর লিপস, মাই লিপস, অ্যাপোক্যালিপ্স” চালিয়ে…
______________________________________________
সেনসেক্স হাজার পয়েন্ট ক্র্যাশ করে যেদিন রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষিপ্ত লাশ আর রক্তের দাগ ছড়িয়ে থাকে সেদিন এনকোয়ারি কমিটি বসানোর চেয়ে আগে থেকে সাবধান হয়ে মার্কেট রেগুলেশন এবং রিফর্ম অনেক জরুরী কাজ। হর্ষদদের তা নিয়ে মাথাব্যথা না থাকাটাই স্বাভাবিক, আরবিআই গভর্নরের না থাকাটা অপরাধ।
ধ্বংসের সাথে আপাত সংস্রবহীন রক্তের দাগ ফুটপাথে লেগে থাকলে কোনও আরবসাগরের জলই তাকে শেষপর্যন্ত পুরোপুরি ধুয়ে ফেলতে পারে না…