আজ এবং গত কয়েকদিনে কোভিড টিকাকারণের জন্য গঠিত জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি (NEGVAC) এদেশে টিকাকরণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন গাইডলাইন দিয়েছেন। ডাক্তার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলের জন্য সেগুলো এক জায়গায় জড়ো করার চেষ্টা করলামঃ
১. কোভিশিল্ডের প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের মধ্যে ১২ সপ্তাহ (তিন মাস) এর ব্যবধান থাকা প্রয়োজন। কোভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে নতুন করে কোনও বদল হয়নি, দুটি ডোজের ব্যবধান থাকবে ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের (এক থেকে দেড় মাসের)
২. কেউ যদি করোনা আক্রান্ত হন (ল্যাবরেটরি টেস্ট দ্বারা প্রমাণিত) তাহলে সেরে ওঠার তিন মাস পরেই টিকা নেওয়া উচিত।
(নিজস্ব সংযোজনঃ এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয়েছে যে করোনা রোগটি শাপ হয়ে এসেও রোগীকে অন্তত তিন মাস প্রাকৃতিক অনাক্রম্যতার বর দিয়ে যায়। ফলে এই সময়ের মধ্যে টিকার মাধ্যমে কৃত্রিম অনাক্রম্যতা তৈরির অত্যুৎসাহী চেষ্টা করার দরকার নেই
এবং ‘সেরে ওঠা’ বলতে উপসর্গ গুলি চলে যাওয়াই ধরে নিতে হবে। এই মুহূর্তের গাইডলাইন অনুযায়ী করোনামুক্ত ঘোষণা করার জন্য রোগীর টেস্ট করিয়ে নেগেটিভ হওয়াটা বাধ্যতামূলক নয় )
৩. কোনো করোনা আক্রান্ত রোগীকে যদি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি (anti- SARS-2 monoclonal antibody) অথবা প্লাজমা থেরাপি (Convalescent plasma) দেওয়া হয় তাহলেও তাকে টিকা দিতে হবে তিন মাস পরেই।
(সংযোজনঃ অতি সম্প্রতি ICMR কোভিড চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপিকে অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় বলে রায় দিয়েছে এবং সমস্ত গাইডলাইন থেকে প্লাজমা থেরাপিকে বাদ দিতে বলেছে)
৪. কেউ যদি একটি টিকা নেন এবং তারপর দ্বিতীয় টিকা নেওয়ার আগে যে কোনো সময় করোনা আক্রান্ত হ’ন তাহলে তিনিও রোগ থেকে সেরে ওঠার অন্তত তিন মাস পরে দ্বিতীয় ডোজটি নেবেন। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে প্রথম টিকার নয়, করোনা মুক্তির দিনক্ষণ টাই গুরুত্বপূর্ণ।
(সংযোজনঃ এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠা নিজেই টিকার দ্বিতীয় ডোজের সমতুল্য কাজ করে ফেলেছে। ফলে দ্বিতীয় ডোজে এত দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবে অযথা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনও মানে নেই)
৫. কোনও ব্যক্তি যদি যে কোনও কারণেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল অথবা আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার অবস্থায় থাকেন তাহলে তিনিও ৪- ৮ সপ্তাহ (এক থেকে দুই মাস) অপেক্ষা করে তবেই করোনার টিকা নেবেন।
(সংযোজনঃ আমার নিজের কাছে এই পয়েন্টটি খুব পরিষ্কার নয়। সম্ভবত বিশেষজ্ঞ কমিটি স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছেন যে, রোগী যদি হাসপাতালে/ আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার মতো গুরুতর অসুস্থ হ’ন তবে এই মুহূর্তে করোনার টিকার চেয়ে সেই চিকিৎসাটিই অগ্রাধিকার পাবে)
৬. করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি সেরে ওঠার (RTPCR পরীক্ষায় নেগেটিভ আসার) অথবা টিকাকরণ হয়ে যাওয়ার ১৪ দিন পরেই রক্তদান করতে পারবেন।
(সংযোজনঃ অর্থাৎ যারা সেরে উঠে রক্তদান করতে চাইছেন তাদের জন্য কিন্তু শুধু উপসর্গ মুক্তি নয়, RTPCR পরীক্ষা করিয়ে নেগেটিভ আসাটা প্রয়োজন; খেয়াল রাখবেন একটু)
৭. দুগ্ধবতী মায়েরা নিশ্চিন্তে টিকা নিতে পারেন
(সংযোজনঃ গর্ভবতী মায়েদের জন্য যেহেতু নতুন করে কিছু বলা হয়নি তাই আগের গাইডলাইন অনুযায়ী তারা টিকা নেওয়া থেকে বিরতই থাকবেন)
৮. টিকাকরণের আগে র্যাপিড টেস্ট (Rapid Antigen Test) এর মাধ্যমে টিকা-গ্রহীতার স্ক্রিনিং করে দেখার কোনও প্রয়োজন নেই।
______________________________________________
করোনার টিকা নিয়ে অসংখ্য ভুয়ো খবর এবং থিয়োরি আলোচনার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। এই মুহূর্তে এদেশে লভ্য কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাক্সিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা কার্যকারিতা নিয়ে তুল্যমূল্য আলোচনার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
শুধু বলার, এই ভয়ঙ্কর অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য আমাদের তূণীরে আপাতত একটিই অস্ত্র- টিকাকরণ। না, টিকা আপনাকে করোনা হওয়ার হাত থেকে নিশ্চিতভাবে বাঁচাতে পারবে না। কারণ শরীরে ভাইরাসের প্রবেশ এবং পরবর্তীতে রোগ হওয়ার প্রক্রিয়াটা টিকা আটকাতে পারে না, সেটা একমাত্র পারে মাস্ক, হাত ধোয়া এবং দূরত্ব বজায় রাখা। কিন্তু টিকা আপনার শরীরকে রোগের সাথে লড়তে শেখাবে, লড়তে সাহায্য করবে। যে সমস্ত দেশে জনসাধারণের একটা বড় অংশের টিকাকরণ হয়েছে সেখান থেকে পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুযায়ী, টিকার দুটি ডোজ নেওয়ার পরেও করোনা রোগীকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে বা তারা মারা যাচ্ছেন সেই সংখ্যাটা কোটিতে হাতে গোনা!
আর হ্যাঁ, টিকা আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে লড়তে তো শেখাবেই, পাশাপাশি সে গোষ্ঠীগতভাবেও অনাক্রম্যতা তৈরি করবে। ফলে এই বিশাল দেশে জনসাধারণের একটা অংশ যদি বাকিও রয়ে যায়, তাও আমরা সম্মিলিতভাবে জিতে যাব যুদ্ধটা। তাই সুযোগ এলেই টিকা (যে কোনও টিকা) নিন।
এবং সরকারকে বলুন বিনামূল্যে জনসাধারণের জন্য টিকার দায়িত্ব নিতে। শুধুমাত্র টিকাকরণের মাধ্যমেই নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল স্মলপক্স, হয়েছে পোলিওকে। আর সেই দায়িত্বটা নিতে হয় দেশের সরকারকে। এদেশের মানুষকে টাকা দিয়ে কিনে নিজের টিকা নিজে নিতে হলে এই দু’টি রোগের একটিও নির্মূল হ’ত না আজ। জোনাস স্যাল্ক পোলিওর টিকার পেটেন্ট নেন নি, আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগেও কয়েক কোটি ডলার কামানোর সুযোগ হেলায় ছুঁড়ে ফেলেছিলেন, সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন “পেটেন্ট নেই নি তার কারণ মানুষ; কেউ কি সূর্যের পেটেন্ট নিতে পারে!”
ব্যবসা আর দায়িত্ববোধহীন বর্বরতা সরিয়ে রেখে এই মুহূর্তে গণটিকাকরণের দায়িত্বটা যে সরকারের সেটা আদর পুনাওয়ালা অথবা নরেন্দ্র মোদীকে আঙুল তুলে বলার দায়িত্বটাও আমাদেরই।