ন্যাশনাল ইনস্টিট্যুট অফ মেনটাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসাইনসেস – নিমহ্যানস। ভারতবর্ষের প্রধান মনোরোগ এবং স্নায়ুরোগ চিকিৎসা এবং শিক্ষাকেন্দ্র। শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবে ছাত্র–ছাত্রীদের নানারকম ঘষামাজার মধ্যে দিয়ে যেতে হত। বই পড়ে শেখা ছাড়াও রোগী দেখে সর্বক্ষণ সিনিয়রদের সঙ্গে আলোচনা, রোগী নিয়ে ছোটো–বড়ো দলে আলোচনা এবং সেই সঙ্গে বই এবং জার্নাল পড়ে সবাই মিলে আলোচনা – সবই ছিল শেখার অঙ্গ।
একজন রোগীকে নিয়ে অনেকে মিলে বসে আলোচনা করে তার রোগনির্নয় (ডায়াগনসিস), বা চিকিৎসা স্থির করা, ইত্যাদিকে কেস কনফারেনস বলা হয়। কেস কনফারেনস করার উদ্দেশ্য হল ছাত্ররা রোগী, রোগ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করলে প্রথমত নিজের চিন্তাভাবনা পরিষ্কার হয় এবং অন্যের সঙ্গে আলোচনা করলে তাদের চিন্তা থেকে লাভবান হওয়া যায়। সবচেয়ে বড়ো কথা, সব গ্রুপেই এমন কেউ থাকে যারা ভাবতে চায় না, বলতেই চায় না, কিন্তু এই ধরণের আলোচনায় সবাইকেই যেহেতু কথা বলতেই হয়, তাই আমরা সকলেই চিন্তায়, ভাবনায়, উপলব্ধিতে, সিদ্ধান্তে দৃঢ় হয়ে উঠছিলাম।
কিন্তু সমস্যা ছিল এই, যে প্রতি সপ্তাহে একটা করে কেস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একজন করে ইন্টারেস্টিং ‘কেস’, বা রোগী ধরে আনা বড্ড ঝঞ্ঝাট। সাদামাটা কেস নিয়ে গেলে তো আর রোজ রোজ আলোচনা সম্ভব নয়। ফলে অনেক সময়ে একটা দুর্বিসহ অবস্থার সৃষ্টি হত। সবসময়ে ভালো কেস আমার জন্য ওঁৎ পেতে না–ও থাকতে পারে। বরং উলটোটাই সম্ভব। ওদিকে কেস কনফারেনসের তারিখ তিন মাস আগে থেকে ঠিক করা থাকে – সুতরাং কেস পাইনি স্যার – বলাও সম্ভব না। আর বললেই বা শুনছে কে?
সেদিন ছিল সুনন্দা লক্ষ্মীনারায়ণের কেস কনফারেনস। অর্থাৎ, সুনন্দা কেস নিয়ে এসে তার সম্বন্ধে বলবে – আমরা, অর্থাৎ অন্যান্য বোদ্ধারা, আলোচনা করব।
সুনন্দা দু’সপ্তাহ আগে থেকে কেস খুঁজতে শুরু করেছে। কিন্তু কপাল ওর এমনই, যে কোনও কেস–ই পায় না। হয় ভর্তি হতে হবে শুনে রোগী পালিয়ে যায়, নয় ভর্তি হলেও তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যায়, নয়ত ভর্তি হবার পরে দেখা যায় যেমন দারুণ কেস বলে মনে করা হয়েছিল তা নয়, সাদামাটা কিছু। শেষে সুনন্দা বলল, “একজন ভালো রোগী পেয়েছি, কিন্তু ভর্তি হতে চাইছে না। আচ্ছা, ভর্তি না করে যদি কনফারেনসের দিনই ডেকে পাঠাই, তাহলে হবে না? ভর্তি করা পেশেন্ট–ই নিতে হবে?”
সিনিয়র ছাত্রছাত্রীরা বলল, “নিশ্চয়ই নিতে পারিস… বরং ভর্তি না–করা পেশেন্ট হলে অনেক ভালো ভালো কেস পাবি। কিন্তু যদি শেষ অবধি পেশেন্টটা এলই না? তখন কী বলবি?”
দুশ্চিন্তায় প্রায় ঘুম হয় না, এই সময়ে সুনন্দা গিয়ে ধরল আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষককে। তিনি সব শুনে বললেন, “তুমি আউটডোর থেকেই কেস নিয়ে তৈরি হও। কনফারেনসে পেশেন্ট না–ই থাকতে পারে। আউটডোরের পেশেন্টকে ডাকা সত্ত্বেও না এলে তোমার কী করার আছে? ভর্তির মতো পেশেন্ট না পাওয়া গেলে, বা ভর্তি পেশেন্ট আলোচনার মতো না হলে তোমার কী দোষ? আবার ধরো, ওয়ার্ডের যে পেশেন্টকে নিয়ে কনফারেনস করবে ঠিক করেছ, সে যদি কনফারেনসের দিন সকালে পালিয়ে যায়? বা মারা–ই যায়? তখন? যাও, যাও – ও সব সামান্য জিনিস নিয়ে মাথা ঘামিও না।
আনন্দে সুনন্দা বলল, “এই জন্যই টিচাররা টিচার, আর সিনিয়র স্টুডেন্টরা টিচার নয়।” বলে কাজ শুরু করল আউটডোরেরই এক রোগীকে নিয়ে। তাতে অসুবিধে হল সেই ছাত্রদের যারা শিক্ষককে ইমপ্রেস করার জন্য আগে থেকে কেস দেখে, বই পড়ে রাখত।
তাতে সুনন্দার কী?
কেস কনফারেনসের দিন সকালের কাজ শেষ করে সুনন্দা খেতে গেল না। সোজা চলে গেল কেস কনফারেনসের ঘরে – সেখানেই আসতে বলেছিল রোগীকে।
আমরা ধীর–সুস্থে, খেয়ে–দেয়ে দুপুরে এসে পৌঁছলাম। সুনন্দার মুখ শুকনো। রোগীর দেখা নেই।
আমরা বললাম, “তো অত চিন্তার কী আছে? প্রফেসর নিজলিঙ্গাপ্পা তো বলেইছেন, রোগী লাগবে না।”
আমাদের সান্ত্বনায় নিশ্চিন্ত না হয়ে সুনন্দা বলল, “না রে। প্রফেসর নিজলিঙ্গাপ্পা আসবেন না। কী কাজ আছে। প্রফেসর রামকুমার চেয়ার করবেন। আর জুনিয়র টিচারদের মধ্যে ডা. শ্রীবাস্তবকে নিজলিঙ্গাপ্পা নিয়ে যাচ্ছেন কোথায় – সুতরাং রামাস্বামী থাকবে।
এইবার সুনন্দার দুশ্চিন্তার কারণ বুঝলাম। সুনন্দা দক্ষিণভারতের যে রাজ্যের আদি বাসিন্দা, রামকুমার আর রামাস্বামী দুজনেই তার পাশের রাজ্যের। এবং দুজনেই সাংঘাতিক প্যারোকিয়াল, পার্শিয়াল এবং ভিনরাজ্যবাসী সকলকেই তারা শত্রু মনে করে (আমাকেও – কিন্তু সুনন্দার রাজ্যবাসী দেখলে তেলেবেগুনে অবস্থা হয়)। নিজলিঙ্গাপ্পা অন্য রাজ্যবাসী, রামকুমারের ঊর্ধ্বতন বস। শ্রীবাস্তব উত্তর ভারতের, রামাস্বামীর সমগোত্রীয় পদে আসীন, কিন্তু রামাস্বামীর চেয়ে সিনিয়র। এঁরা থাকলে রামকুমার আর রামাস্বামী খুব ট্যাঁ–ফোঁ করতে পারেন না।
খানিক বাদেই রামাস্বামীর প্রবেশ। সুনন্দাকে বলল, “রেডি?”
সুনন্দা খানিকটা থতমত খেয়ে বলল, “রোগী এসে পৌঁছয়নি এখনও।”
চোখ কপালে তোলার ভান করে রামাস্বামী বলল, “তুমি আউটডোরের পেশেন্ট এনেছ? কেন? ভর্তি পেশেন্টের মধ্যে কেউ তোমার কেস কনফারেনসের যোগ্য বলে গণ্য হল না? তা হবে – তোমরা আজকালকার ছাত্রছাত্রী – তোমরা আমাদের চেয়ে বেশি জান।”
সুনন্দা কিছু বলার আগেই এসে পড়লেন প্রফেসর রামকুমার। “রেডি? রোগী কোথায়? পাঠায়নি ওয়ার্ড থেকে?”
সুনন্দা কিছু বলার আগেই রামাস্বামী বলল, “ও তো ওয়ার্ড থেকে কেস নেয়নি স্যার। আউটডোরের পেশেন্ট সিলেক্ট করেছে।”
“আউটডোরের পেশেন্ট? কার অনুমতি নিয়ে তুমি আউটডোরের পেশেন্ট নিয়েছ?” ফেটে পড়লেন রামকুমার। “প্রফেসর নিজলিঙ্গাপ্পার কথা ছিল আজ চেয়ার করার। উনি জানেন?”
ধমক খেয়ে কান্নায় গলা ধরে এসেছে সুনন্দার। বলল, “হ্যাঁ, স্যার। ভর্তি কেস থেকে পাইনি বলেই উনি বললেন…”
“পাওনি? পাওনি? বললেই হল? আমার ওয়ার্ডেই অন্তত চারজন ইন্টারেস্টিং পেশেন্ট আছে গত দু–সপ্তাহ ধরে – রামাস্বামী, তুমি ওকে আমাদের ওই কেসগুলোর কথা বলনি?”
রামাস্বামী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “জানতে চাইলে তো বলব স্যার, আজকাল স্টুডেন্টরা কিছু জিজ্ঞেসই করে না তো!” অম্লানবদনে সম্পূর্ণ মিথ্যে কথাটা বলে সুট করে কনফারেনস রুমে ঢুকে গেল রামাস্বামী। সুনন্দা রামাস্বামীকে বার বার জিজ্ঞেস করেছিল – কোনও সাহায্য পায়নি। বরং ধর্মেন্দ্র যখন ওর কেস–এর কথা বলেছিল, তখনও ওপর–পড়া হয়ে এসে বলেছিল, “না, না। ওটা কনফারেনসের জন্য উপযুক্ত হবে না।”
রামাস্বামী কনফারেনস রুমে ঢুকে যাওয়ার পরে রামকুমারও ঢুকলেন। আমরাও গেলাম পেছন পেছন। নিজলিঙ্গাপ্পার অবর্তমানে রামকুমার চেয়ার করবেন। বললেন, “তুমি শুরু করো, সুনন্দা। ধর্মেন্দ্র, তুমি বাইরে দারোয়ানকে বলে এসো, পেশেন্ট এলে যেন বসিয়ে রাখে। না এলে সেটা অবশ্য তোমার পক্ষে ভালো হবে না, সুনন্দা।”
ধর্মেন্দ্র বেরিয়ে গেল। কাঁপা গলায় সুনন্দা বলল, “শুরু করি স্যার?”
রামকুমার বললেন, “ধর্মেন্দ্র আসুক। এক মিনিট তো লাগবে।”
এক মিনিট না – প্রায় পাঁচ মিনিট লাগল ফিরতে। রামকুমার রেগে বললেন, “কতক্ষণ লাগে?”
ধর্মেন্দ্র বলল, “স্যার সিকিউরিটির লোকটা গেটে ছিল না। তাই ওয়ার্ড–বয় গেল তাকে ডাকতে… ক্যানটিনে কফি খাচ্ছিল…”
রামকুমার নাক দিয়ে একটা হুঁঃ শব্দ করে বললেন, “আচ্ছা, সুনন্দা, শুরু করো।”
কাঁপা গলায় সুনন্দা শুরু করল। ব্যাঙ্গালোর শহরেরই একটি বছর কুড়ি বয়সের ছেলে। তার সমস্যা এই, যে তার নাকটা খুব বড়ো। সে নানা ডাক্তার বদ্যি দেখিয়েছে। শেষে কেউ বলে কোনও প্লাস্টিক সার্জনের কাছে যাও, সে নাক কেটেকুটে সাইজমতো করে দেবে। কিন্তু প্লাস্টিক সার্জন তাকে পাঠায় কোনও ই–এন–টি সার্জনের কাছে – এই মতামত চেয়ে যে নাকটা কতটা কাটলে ঠিক দেখাবে। সেই ই–এন–টি সার্জন নাকি ছেলেটার কথা শুনেই রাগ করে মানসিক রোগ চিকিৎসালয়ে পাঠিয়ে দিলেন।
এইটুকু জানতে জানতেই দরজা ঠেলে ঢুকল ডা. শ্রীবাস্তব। প্রফেসর রামকুমারকে বলল, “স্যার, প্রফেসর নিজলিঙ্গাপ্পা আপনাকে একবার ওনার ঘরে যেতে বললেন। ওই সেই প্রজেক্টের রিপোর্ট–টা আজই ডিরেকটর পাঠাতে বলেছেন।”
“ওঃ, তাই? তাহলে চলো,” বলে উঠে দাঁড়ালেন রামকুমার। “রামাস্বামী – তুমি চালিয়ে নাও।”
শ্রীবাস্তব বলল, “না স্যার। আমি যাব না।” আমার পাশের খালি চেয়ারটায় বসে শ্রীবাস্তব বলল, “প্রফেসর নিজলিঙ্গাপ্পা আপনার সঙ্গে একান্তে কিছু আলোচনা করতে চান। আমাকে বললেন ততক্ষণ আমি যেন না যাই। এখানেই থাকব – ঘণ্টাখানেক পরে যাব আবার।”
রামকুমার চলে গেলেন, রামাস্বামী বলল, “শ্রীবাস্তব, তুমি চেয়ার করো?”
শ্রীবাস্তব বলল, “ও সব ফর্মালিটি করে কী হবে? কাজটা হওয়া নিয়ে কথা – চলো, চলো, সুনন্দা, আবার প্রথম থেকে বলবে? আমি তো ছিলাম না…”
সুনন্দার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল, কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে আবার শুরু করল। শ্রীবাস্তব আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, “পেছনে লেগে গেছিল দুজনে মিলে?”
আমি নাক দিয়ে শ্বাস ছেড়ে বললাম, “হুঁ।”
“ধর্মেন্দ্র ফোন করল। নিজলিঙ্গাপ্পা আমাকে পাঠিয়ে দিলেন।”
ধর্মেন্দ্র আর সুনন্দা একই প্রদেশের বাসিন্দা। এবার বুঝলাম সিকিউরিটিকে পেতে কেন দেরি হয়েছিল।
সুনন্দা বলে চলেছে। দ্বিতীয়বারের পাঠে একটা বিষয় আমার কানে ঠেকল। ছেলেটার নাক শুধু বড়ো না। আর একটা ব্যাপার আছে। রোজ সকালে ওর নাকটা বিরাট বড়ো থাকে। যত বেলা গড়ায়, ততই আস্তে আস্তে কমে আসে। স্বাভাবিক হয় না কখনোই, কিন্তু অত আর বড়ো থাকে না।
সমস্ত কাহিনি শেষ হল মিনিট পনেরোর মধ্যে। এবারে একপ্রস্থ আলোচনা। এখনই রামকুমার–রামাস্বামী জুটি ছাত্রদের কিমা বানান। আজ রামকুমার নেই, কিন্তু রামাস্বামী একাই পঞ্চাশ। এর হাত থেকে শ্রীবাস্তব কাউকে বাঁচাবে না। সুতরাং আমরা নড়েচড়ে বসলাম।
যেমনটা আশা করা গেছিল, রামাস্বামী শুরু করল ওর প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। “কী হতে পারে?”
কেউ বলল, “এমন হতে পারে যে ছেলেটা ভুল দেখছে। নাকটা স্বাভাবিক সাইজের। ও দেখেছে বড়ো… (ডাক্তারি পরিভাষায় হ্যালুসিনেশন বা ইল্যুশন)। কেউ বলল, “স্বাভাবিক নাক, দেখছেও স্বাভাবিক, কিন্তু ভ্রান্ত বিশ্বাস যে ওটা মস্ত বড়ো… (ডেল্যুশন)। এই ভাবে নানা আলোচনা চলছে, হ্যালুসিনেশন, ইল্যুশন, ডেল্যুশন, অবসেশন… সব শন্ শন্ করে শেষ হয়ে বডি ডিসমরফোফোবিয়ার মতো কঠিন বাক্যাংশও শেষ হয়েছে। সব রকম মনোরোগভিত্তিক সিমটমের নাম যত শেষ হয়ে আসছে, পরের ছাত্রের পক্ষে বিষয়টা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। আমি ভাবছি, রামাস্বামী আমাকে (সঙ্গত কারণেই) মহা পাকা মনে করে। সবার পরেই আমাকে ধরবে। তখন কী বলব রে বাবা! এমন সময়, সবার শেষেই, রামাস্বামী আমাকে বলল, “আনিরুধ, তুমি কী ভাবছ?”
রামাস্বামী না হয়ে অন্য কেউ হলে আমি বলতাম, “আমি ডা. ওমুকের সঙ্গে একমত। ওটাই সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা।” তাতে অল্পের ওপর দিয়ে যেত। কারও বলা কথার ওপর আরও দুটো কথা বলে দিলেই চলত, কিন্তু রামাস্বামী মানবে না। অন্য কিছু বলতে হবে।
বললাম, “এমনও তো হতে পারে, যে ছেলেটার নাক সত্যিই বড়ো। অর্থাৎ, ওর অ্যাবনরমালিটি যদি কিছু থাকে, তা নাকের সাইজেই। চিন্তায়, বা বিশ্বাসে নয়।”
রেগে উঠল রামাস্বামী। “এটা একটা সিরিয়াস আলোচনা, আনিরুধ্। হালকা কোরো না। সুনন্দা, ছেলেটার নাক কি বড়ো, না ছোটো?”
সুনন্দা একটু ভেবে বলল, “তেমন বড়ো কিছু না।”
“এক্স্যাক্টলি,” রামাস্বামী লাফিয়ে উঠল। “বড়ো হলে সার্জন মানসিক হাসপাতালে পাঠাত?”
সেই কথাটা পেড়ে আনলাম। বললাম, “সার্জন নাকের সাইজের জন্য পাঠিয়েছেন বলে আমি মনে করি না।”
“তবে?”
“ছেলেটা বলেছে সকালে নাক বড়ো, আর বেলা বাড়লে অত বড়ো না। সেইজন্য পাঠিয়েছেন। নাকের সাইজ কি বাড়ে কমে নাকি?”
রামাস্বামী ভাবল আমাকে ধরেছে চেপে। বলল, “ঠিক। তবে কেন বলছ নাক বড়ো নয়?”
বললাম, “আমি মনে করছি, যে ছেলেটা যখন সকালবেলা উঠে আয়নায় মুখ দেখে, ওর মনে হয় ওরে বাবা, নাকটা কত্তো বড়ো! কিন্তু যত বেলা বাড়ে, দেখতে দেখতে চোখে সয়ে যায়। মনে হয়, নাঃ, অত বড়ো নয়।”
সবাই হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে।
আমি বলে চললাম, “আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। গত মাস–ছয়েক আমার মাথার চুল কমতে শুরু করেছে। রোজ সকালে যখন প্রথম ঘুম থেকে উঠে আয়নার দিকে তাকাই, বুকটা ধড়াস করে ওঠে। অ্যাত্তোবড়ো টাক হয়েছে? কিন্তু তারপর, যখন দাঁত–টাত মেজে, চোখ–মুখ ধুয়ে ফিরে আসি, চান–টান করে চুল আঁচড়াই – তখন আর অত ভয়ানক দেখায় না। মনে হয় গতকাল যেমনটা ছিল, আজও মোটামুটি একই রয়েছে।”
ঘরের মধ্যে হাসাহাসি শুরু হয়েছে। রামাস্বামীর মুখ ক্রমশ লাল থেকে বেগুনি হয়ে আরও নানা অদ্ভুত রঙের হয়ে যাচ্ছে – বুঝে ডা. শ্রীবাস্তব ডা. তরুণকে বলল, “এই ব্যাপারে তোমার কী মত?”
ডা. তরুণ আর ডা. বিক্রম আমাদের চেয়ে সিনিয়র ডাক্তার, কিন্তু পদমর্যাদায় একই পর্যায়ের। তাঁদের দুজনের মাথা মিলিয়ে সর্বমোট কুড়িটাও চুল হবে কি না সন্দেহ। তরুণ আবার বিক্রমের দিকে তাকিয়ে বলল, “বিক্রম, তোমার কি মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা, যখন তোমাকে দেখে কেউ টেকো বলত না, বলত তোমার রিসিডিং হেয়ারলাইন?”
দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বিক্রম বলল, “না বস্, স্যরি। অতদিনের কথা মনে নেই।”
একই রকম দুঃখী মুখে তরুণ বলল, “আমারও না।”
গদাম্ করে রামাস্বামীর মুষ্টিবদ্ধ হাত নেমে এল টেবিলে। আমরা চমকে উঠলাম।
“যথেষ্ট হাসাহাসি হয়েছে। আনিরুধ্, তুমি ব্যাপারটাকে লঘু করে দিয়েছ। এটা একটা সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক এক্সারসাইজ। এই আলোচনা এখানেই শেষ। সুনন্দা, তুমি বাইরে গিয়ে দেখো, রোগী এসেছে কি না। না–হলে আমরা শেষ আলোচনায় যাব।”
সুনন্দা সবে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করতে শুরু করেছিল। রামাস্বামীর কথায় বেচারা আবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে উঠে দরজা খুলে বাইরে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এল। চোখ–মুখের চেহারা পালটে গেছে। একগাল হেসে বলল, “এসেছে, এসেছে!” বলে দরজা খুলে দাঁড়াল। দরজা দিয়ে ওর পেছনে পেছনে ঢুকল রোগী।
ঘরে পিন–ড্রপ সাইলেনস।
মাইরি, অত বড়ো নাক আমি জীবনে দেখিনি।
একেই বলে পরের বিষয়ে নাক গলানো!!!