রুপালী আপত্তি জানিয়েছিল। বউয়ের আপত্তি অবশ্যই শোনা উচিৎ। তাহলে ঝামেলায় পড়তাম না। ঘটনাটা শুরু হয়েছিল সাধারণ ভাবেই। রাত বারোটায় খাওয়াদাওয়া সেরে একটা বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলাম। নতুন বই। প্রীতম বসুর ‘প্রাণনাথ হৈও তুমি।’
দুর্জয় আর আমি গতকাল দেবুদার দোকান থেকে কিনে এনেছি। দুর্জয় কটা দিন বাদেই ইংল্যান্ডে চলে যাবে। যাওয়ার আগে শনিবার রাতের আড্ডায় হঠাত বই কেনার ভুত চাপল।
রুপালী বলেছিল ঘুমিয়ে পড়ো। কাল ভোরে চেম্বারে বেরোবে। বলেছিলাম, বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতেই ঘুমিয়ে পড়ব। তবে বই বড়ই ভয়ংকর বস্তু। খুললাম, কিন্তু বন্ধ করতে পারলাম না। প্রথমে শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম। তারপর উঠে বসলাম। তারপর ঘরের মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে পড়তে থাকলাম।
আমি যখন করতালীতলায় কীর্তনের মূর্ছনায় পুরোপুরি ভেসে গেছি, সেসময় প্রথম পাখির ডাক কানে এলো। সর্বনাশ, ভোর হয়ে গেছে। আমাকে এখুনি গৌরের চেম্বারে ছুটতে হবে।
দাঁত মাজতে মাজতে চায়ের জল বসালাম। আর হাই তুলতে তুলতে স্কূটার বের করলাম। আমার স্কুটারের অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। কিছুতেই ঘুম ভাঙতে চায় না। লাথালাথি করে যতবার স্টার্ট করি, আবার ঘুমিয়ে পড়ে। আমার সাথে সাথে এনারও বয়স বাড়ছে।
মিলনপল্লিতে গৌরের চেম্বারে পৌঁছে দেখি এই ভোরেও ভালোই রোগী জমে গেছে। কোথায় বসন্তের শিরশিরে হাওয়ার ভোরে হালকা চাদর মুড়ি দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাবে, তার বদলে গুচ্ছের রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার দেখাতে হাজির। সেইসব চিত্রগুপ্তের খাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে বুঝলাম, আজ খবর আছে। দুই চোখের পাতা বিদ্রোহ ঘোষনা করেছে। তাঁদের খুলে রাখাই মুশকিল। এভাবে রাত দশটা অবধি টানতে পারব? আরেকবার চা পেলে হতো। কিন্তু সামনের বুড়োদাদু এখনও দোকান খোলেনি। অতএব চা জুটবে না।
ছোট্ট খুপরিটায় বড্ড মশা। তবে তাদের সমবেত প্রচেষ্টাও বিফলে যাবে মনে হচ্ছিল। মাথার ভেতর ঘুমের রিমিঝিমি। ভাবছিলাম, কী ভাগ্য করে জন্মেছি। একটা বই ভালোভাবে পড়ার জো নেই। রাত জাগলাম, অথচ বইটাও শেষ হলো না। পদাবলি এখন কি করছে কে জানে? প্রাণনাথের সাথে আমার পরিচয়টা সবে শুরু হয়েছিল। আজ রাতে যে পড়ব সে উপায়ও নেই। পরপর দুরাত্রি না ঘুমালে গুরুতর সমস্যা হতে পারে। বয়সটাও ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। উফফ্, কী বিচ্ছিরি একটা জীবন কাটাচ্ছি।
রোগীও তেমন। পনেরো দিন আগে কোমরের ব্যথা আর পা ঝিনঝিনি নিয়ে দেখাতে এসেছিলেন। বর্তমানে কোমরের ব্যথা কমেছে। তবে একেবারে নতুন একটা সমস্যা শুরু হয়েছে। কিছু খেলেই পায়খানা পাচ্ছে। উনি সোৎসাহে পায়খানার গন্ধ, পরিমান ও গঠনগত চরিত্রের বর্ণনা দিলেন। এতোটা উৎসাহ নিয়ে বললেন, যেন ওনার ছোটো ছেলে মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছে। আমি চুপচাপ শুনলাম। জানি আবার পনেরো দিন বাদে উনি আসবেন। তখন পেটের সমস্যা কমে যাবে। নতুন কোনো সমস্যা হবে। বুক ধড়ফড় করবে, রাতে বড়বড় নিঃশ্বাস নেবেন, এক নাক বন্ধ হয়ে যাবে।
পরের রোগিণী পুটলি সর্বস্ব শীর্ণ মহিলা। একমাস আগে দেখিয়ে গেছেন, সুগার যা ছিল, ওষুধ খেয়ে আরো বেড়েছে। বললেন, শেষ দশদিন ওষুধ খাননি। হাতে টাকাপয়সা নেই। কাজের বাড়ি থেকে মাইনে পেলেই ওষুধ কিনবেন। তবে সমস্যা হল মাইনে কোনো মাসেই দশ তারিখের আগে হয়না। গৌর একজনের কাছ থেকে কিছু সুগারের ওষুধ জোগার করে এনেছে। তার থেকে দুই পাতা দিলাম। কিছুতো কমুক। বললাম, ‘মধ্যমগ্রাম হাসপাতালে দেখান। অনেক ওষুধ বিনাপয়সায় পেয়ে যাবেন।’
তার পরের রোগী রোগের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, ‘মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা হয় ডাক্তারবাবু, সারা রাত্রি বাড়ির সামনে সিড়িতে বসে থাকি। মশার কামড় খাই।‘
-কেন? ঘরে থাকলে কী সমস্যা? শুলে কি কষ্ট হয়? বুকে ব্যথা বেড়ে যায়? শ্বাসকষ্ট হয়? নাকি বদ্ধ ঘরে ভয় লাগে, দমবন্ধ হয়ে যায়।
-না তো। এসব কিছু না।
-তাহলে শুধুশুধু সারা রাত বাইরে বসে মশার কামড় খান কেন?
-শুধুশুধু না। বুকের ব্যথা তো হার্ট এটাকের জন্যও হতে পারে। যদি সত্যিই তাই হয়, যদি মরে যাই…
-সেতো ঘরে থাকলেও মরতে পারেন, বাইরে বেরোলেও মরতে পারেন। ঘরে থাকলে অন্তত মশার কামড় খেতে খেতে মরতে হবে না।
-ঘরে মারা গেলে সমস্যা আছে। ঘরের বাইরে মরলে সমস্যা নেই।
-কী সমস্যা?
-এই কটা মাত্র দিন আগে অনেক পয়সা খরচ করে সেগুন কাঠের একটা পেল্লায় দরজা বানিয়েছি। একেবারে জমিদার বাড়ির মতো। ফুল লতা পাতার নকসা করা দরজা। ঘরে আচমকা মরলে ওই দরজা ভেঙে আমার লাস বার করতে হবে। ওই দরজা ভাঙলে মরেও শান্তি পাব না।
না, আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এখুনি একটা বড়সড় গেলাসে চা খাওয়া দরকার। সকাল সাতটা বেজে গেছে। এককাপ চা পাওয়া যাবে না?