রাত তখন দুটো। বিছানায় শুয়ে সমানে উসখুস করছে রিমিতা! ঘুম আসছে না কিছুতেই! কতক্ষণ যে এরকম ভাবে শুয়ে আছে মনে নেই আর! হাজারো চিন্তা চলে আসছে মাথার মধ্যে আসছে! “ঠিক ঘুমানোর সময়েই আসতে হল এদেরকে!” চোখ বুজে থেকে ঘুম আনার চেষ্টা করলেও ঘুম আসছে না! খুব অস্থির লাগছে এবার! কাল অফিসের জন্যে আবার সকালে উঠতেও হবে! যদি ভালো করে ঘুম না হয় তাহলে তো মুশকিল! কারও সাথে কি একটু কথা বলবে! বিক্রম তো ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই!
শেষ কিছুদিন একটু বাড়াবাড়িই হচ্ছে! কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না! তার উপর কোভিড লকডাউন ওয়ার্ক ফর্ম হোম! জীবনে একেবারে নতুন সেট আপে চলছে! ‘নিউ নর্মাল মোড’ যাকে বলে আর কী! ঘুমের সমস্যাটা শুরু হয়েছিল ওই একমাস আগে থেকেই! অল্প করে অল্প করে! স্বাভাবিক সময়ে শুয়ে পড়লেও ঘুম আসতে দেরি হচ্ছিল! ইদানীং ঘুমোতে গেলেই একটা চিন্তা চলে আসছে বারবার- “ঠিক করে ঘুম হবে তো! ঘুম না হলে কাল যদি কাজ করতে না পারি! আমার তো ঘুমই আসে না!” বিরক্তি বাড়তে থাকে রিমিতার! এর আগের দিন তো রাতে না ঘুমোতে পেরে সারাদিন কী অসম্ভব ক্লান্ত লাগছিল ওর! ঠিক করে কাজও করতে পারে নি সেদিন! এখন রাতে ঘুমোতে হবে এটা ভাবলেই একটা দুশ্চিন্তা হয়! যেন মনে হয় একটা বড়সড় কাজ করতে হবে! আগে একদম এরকম ছিল না! সুন্দর আলো নিভিয়ে চোখ বুজলেই ঘুম চলে আসত। এখন আসতেই চায় না! একদিন তো ব্রেকফাস্ট করতে করতে ১১ টা হয়ে গেল, অফিস মিটিং এ জয়েন করতে করতেই চোখ বুজে আসছিল! অন্যের কথা আর কী শুনবে! মা তো অলরেডি বলতে শুরু করে দিয়েছে-“কী রে রাতে ঘুম হচ্ছে না! কেমন উস্কখুস্ক লাগছে!” রিমিতা বুঝে পায় না কী বলবে! সত্যিই তো ঘুম হচ্ছে না! বিরক্তি লাগে! এতটা বিরক্তি ওর কখনও আসেনি আগে!
বিছানায় শুয়ে শুয়ে এত রাগ হতে লাগল ওর। মোবাইল বের করে ফের ইনস্টা আর ফেসবুক দেখতে শুরু করল, উপুর হয়ে! একটার পর একটা ভিডিও, অল্প মাথা ব্যথা করছে কি?? অত পাত্তা দিল না ও! ঘড়ির কাঁটা তিনটে ছুঁইছুঁই, ভয়ে চোখ বুজল রিমিতা! নাহ কিছুতেই ঘুম আসছে না! যেন বড্ড ঘাম ঝরানো, দমবন্ধ এক ফিলিংস নেমে আসছে! জানে না এভাবে কখন ঘুম আসবে, আদৌ আসবে কিনা!
সকালে যখন ওর চোখ খুলল তখন ৯ টা বেজে গেছে! প্রচণ্ড রকম মাথা ভারি হয়ে আছে! গায়ে একরাশ জড়তা!! অনেক কষ্টে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও! জানে না আজ কিভাবে মিটিং এ উপস্থিত থাকতে পারবে! কিন্তু এটা ঠিক জানে এভাবে চলতে থাকলে আর বেশিদিন কাজ করতে পারবে না ও।
রিমিতার মতো অনেকেই কম-বেশি এই রকম সমস্যায় আক্রান্ত! আমাদের ঘুম-আর জেগে থাকা সম্পর্কিত রোগ যাকে সাধারণ ভাবে ঘুমের সমস্যা বলা হয়! তা অনেক রকমের হতে পারে- যেমন অনিদ্রা (Insomnia), স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘুমানো (Hypersomnolence), হঠাৎ করে তীব্র অনিয়ন্ত্রিত ঘুমের রেশ চলে আসা (Narcolepsy), ঘুম সম্পর্কিত শ্বাসকষ্টের সমস্যা (Breathing related Sleep Disorder), যেমন– অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া হাইপ্যাপনিয়া (Obstructive Sleep Apnea Hypopnea) যেখানে ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, অত্যাধিক নাক ডাকা– যাদের ওজন বেশি ওবেসিটি রয়েছে তাদের এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি! অথবা Circadian Rhythm অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় দিন-রাতের সাথে আমাদের একটা অসামঞ্জস্য (Circadian Rhythm Sleep-Wake Disorders)। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে কথা বলা (Somniloquy) হেঁটে চলা (Sleep Walking), ভয়াবহ স্বপ্ন দেখা (Sleep Terror বা Nightmare), অনেকের ক্ষেত্রে পা নাড়ানো (Restless Leg Syndrome), আরও বিভিন্ন ধরণের সমস্যা হতে পারে! এতগুলো রোগের মধ্যে ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা তাহলে কি??
ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা
ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা হল এমন একধরনের ঘুমের সমস্যা যেখানে রাতে ঘুমের সময়সীমা (মোট ঘুমের পরিমাণ) ও তার গুণগত মান (Quality) অর্থাৎ ঘুম থেকে উঠে যে ফ্রেশ লাগার যে অনুভুতি তা নিয়ে রোগীদের অসন্তুষ্টি তৈরি হয়, যার পাশাপাশি নিচের তিনটি সিম্পটোমের মধ্যে একটি বা তার বেশিও থাকে-
(১) বিছানায় শুয়ে পড়ে ঘম আসতে দেরি হওয়া (মোটামুটি ভাবে ৩০ মিনিট ধরে নেওয়া হয় অর্থাৎ শুয়ে পড়ার ৩০মিনিট পরেও ঘুম আসছে না)
(২) ঘুমিয়ে গেলে বারবার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া! (৩০ মিনিটের বেশি ঘুম টিঁকছে না)
(৩) সকালের দিকে খুব আগে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া আর চেষ্টা করেও ঘুমোতে না পারা! (কোনও ব্যক্তির স্বাভাবিক ভাবে সকালে ওঠার যে সময় তার ৩০ মিনিট আগে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া)
এই সমস্যাগুলো তিন মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে তিন দিন ধরে হয় আর দিনের বেলায় তার জন্যে কাজের ক্ষেত্রে, পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, পড়াশোনার ক্ষেত্রে, সামাজিক অবস্থানে যদি অসুবিধার সৃষ্টি হয় আমরা ইনসমনিয়ার কথা ভাবতে পারি!! মনে রাখতে হবে একজন ব্যক্তি যিনি নিজের মতো করে সঠিক ভাবে ঘুমোনোর উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ পেয়েছেন তারপরেও এই সব সমস্যা হচ্ছে তখন তার সমস্যা নিয়ে পেশাদার ব্যক্তির কাছ থেকে সঠিক মূল্যায়ন দরকার!
ঘুমের সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক যে সংস্থা International Classification of Sleep Disorder (ICSD-3), তার তিন নাম্বার সংস্করণ ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়! আর ২০১৮ এর ICD-11(International Classification of Diseases-১১ নাম্বার সংস্করণ) চ্যাপ্টার ৭ এ দুই জায়গাতেই তারা Insomnia বা অনিদ্রা কে দুইভাগে ভাগ করেন- Chronic Insomnia (দীর্ঘ সময় ধরে চলা)–তিন মাসের বেশি সময় ধরে চলা আর একটি তিন মাসের কম Short Term Insomnia (সংক্ষিপ্ত সময় পর্ব জুড়ে)।
চিকিৎসা না করলে অনেকের ক্ষেত্রে অনিদ্রার এই সমস্যা ধারাবাহিক ভাবে থাকতে পারে, কারও মাঝে মাঝে হয়, কারও বা তীব্র আকারে প্রচণ্ড ভাবে ভোগাতে পারে!
তাহলে কি স্বাভাবিকের চেয়ে আলাদা ভাবে ঘুমোনোর অভ্যাস থাকলেই তাকে ইনসমনিয়া বলতে হবে?? না তা নয়! আমরা স্বাভাবিক ঘুমনোর সময় রাত ১০-১১ টা থেকে সকাল ৬-৭ টা ধরতে পারি! কিন্তু অনেকেই আছেন যাঁরা একটু দেরি করে ঘুমিয়ে দেরি করে উঠতে পছন্দ করেন, ওটাই ওনাদের অভ্যেস রাত ৪ টে-তে ঘুমিয়ে ১০ টায় ওঠা! মাঝারাতের দিকে এনারা বেশি সজাগ থাকেন! এঁদের বলা হয় আউলস (Owls)। আবার অনেকেই রাত ৯টায় ঘুমিয়ে ভোর ৫-৬ টায় উঠে যান, তাঁরা সকালের দিকে বেশি চনমনে থাকেন! এঁদের বলা হয় লারক্স (Larks)। অনেকেই ছোট বেলা থেকে একটু কম ঘুমানোর অভ্যেস ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা আবার অনেকের বেশি না ঘুমোলে হয় না ৮-৯ ঘণ্টা! অর্থাৎ এই ঘুমনোর অভ্যাস প্রত্যেকের নিজস্ব! তবে যখন এই ঘুমনোর জন্যে দিনের বেলা জেগে থাকতে সমস্যা হয়, মনোযোগ দিতে অসুবিধা হয়, ক্লান্ত লাগে সারাদিন, মন মেজাজ খিঁচড়ে থাকে, তখন ঘুমের সমস্যার কথা আমরা ভাবতে পারি!
ইনসমনিয়া হলে কি কি হয়??
যে কোনও বয়সে এই অনিদ্রা রোগ আসতে পারে! তবে প্রাথমিক ভাবে ২০-৩০ বছরের মধ্যেই ইনসমনিয়ার প্রথম এপিসোড দেখা দেয়! ভারতে এই রোগের সাধারণ জনমানসে ১০-১৫% এর মত। বয়স বাড়তে থাকলে এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে এই রোগের প্রবণতা একটু হলেও বেশি দেখা যায়! যাদের আগে থেকে যাদের কোনও মানসিক চাপ (স্ট্রেস, বিচ্ছেদ, অর্থনৈতিক দুর্বলতা) রয়েছে, ঘুমনোর সময় খুব অনিয়মিত, ঘুমের জায়গা খুব অস্বাভাবিক ভাবে অস্বাস্থ্যকর, যাদের চিন্তা করার স্বভাব একটু বেশি, মোবাইল, ল্যাপটপে রাতের বেলা কাজ করার অভ্যে্স, প্রচুর সিগারেট, অ্যালকোহল, কফি বা চা খাওয়ার নেশা রয়েছে তাদের ইনসমনিয়া বা অনিদ্রাতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি!
অনেকের ক্ষেত্রে এই ঘুমের সমস্যা বিভিন্ন মানসিক শারীরিক কারণে আসতে পারে! যেমন ডিপ্রেশান, দুশ্চিন্তা, PTSD (Post Traumatic Stress Disorder), বাইপোলার, নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ, অন্য অনেক শারীরিক অসুখেও (ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, ফুস্ফুসের রোগ, হাঁটুর ব্যথা) এই অনিদ্রা সমস্যা আসতে পারে!
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাঁরা ইনসমনিয়া বা অনিদ্রাতে ভোগেন তাঁদের দিনের বেলা ক্লান্ত লাগে! খুব সহজে জড়তা চলে আসে! বিশেষ করে মন মেজাজ খিঁচড়ে থাকে- খুব সহজেই রেগে যান! অনেক দিন ধরে অনিদ্রাতে ভুগলে স্মৃতিশক্তি মনে করার ক্ষমতা কমে আসে, একটু জটিল কাজ করার এনার্জি ও ধৈর্য চলে যায়! পরিবারের বিভিন্ন কাজ সকালে উঠে ঠিক করে বাজার করে আনা, অফিসের কোনও কাজ ভুলে যাওয়া, পড়াশোনার ক্ষেত্রেও রেসাল্ট খারাপ হতে থাকতে পারে! অনেকেই খুব রাগী, ইম্পালসিভ হয়ে ওঠেন! ঘুম আনার জন্যে অনেকেই নেশা করা শুরু করে দেন! সঠিক ভাবে ঘুম না হলে অনেকসময় আমাদের ইমিউন সিস্টেমও দুর্বল হয়ে পড়ে!
কোভিড মহামারি, লকডাউন ও ঘুমের অভ্যাস
বিগত দেড় বছর ধরে যেভাবে কোভিড মহামারি সম্পূর্ণ লকডাউনে আমাদের গৃহবন্দি করে রেখেছে আমাদের কাজের আর বাড়ির জগতে পুরো রিসেট বোতামে চাপ দিয়ে নতুন ভাবে চালিত করেছে- বাড়িই হয়ে উঠেছে কাজের জায়গা! সব কিছু মিলিয়ে আমাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ঘুমের পরিবর্তন হয়েছে- কারও ক্ষেত্রে একদম দেরি করে ঘুমানো, কারও ক্ষেত্রে খুব খারাপ ধরণের ঘুম (অর্থাৎ রিফ্রেশিং নয়), কারও বা ঘুমই আসছে না! বাইরের দেশে তাই ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশানে ঘুমের ওষুধ লেখার পরিমাণ ৪০-৫০% বেড়ে গেছে! যা আগে থেকে থাকা অনিদ্রার রোগের তুলনায় অনেক গুণ বেশি!
ভারতের মত দেশে এই লকডাউন ও মহামারিতে যে দুই ধরণের ঘুমের সমস্যা প্রধানত উঠে এসেছে তা হল- শুয়ে পড়লে ঘুম না হওয়া আর দেরি করে ঘুমোতে যাওয়া! এর জন্যে সারদিনের কাজকর্মের দক্ষতা ও ক্ষমতা কমে যাওয়া, মন-মেজাজ খারাপ থাকা, দিনের বেলা ঝিমিয়ে থাকা– এই সব সমস্যা আমাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই অল্প-বিস্তর হচ্ছে! আমাদের প্রতিদিনের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ নিয়ে আমাদের ঘুমে ব্যঘাত ঘটছে। একইসঙ্গে ডিপ্রেশান অনেকটাই বেড়ে চলেছে! আমাদের স্ক্রিনিং টাইম (Screening Time) অর্থাৎ ল্যাপটপ, মোবাইল–এদের নিয়ে কাজ করার সময়ও বেড়েছে! পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঘুমের সমস্যাও!
অনিদ্রার চিকিৎসা
ঘুম যেমন আমাদের একটি অভ্যাসের মতো তেমনি এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের মস্তিস্কের বিভিন্ন জায়গার যোগাযোগ ও নিউরোট্রান্সমিটারের ওঠানামা। তাই ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অভ্যাসগত পরিবর্তনও দরকার! একদিকে আধুনিক গবেষণাতে স্লিপ মেডিসিন যে উচ্চতায় পৌঁছেছে সেখানে অনেক অনেক নতুন নতুন ওষুধ তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে। বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ওষুধ এখন পাওয়া যায়! তাই কোন ব্যক্তির কি ধরনের সমস্যা, ঘুমের অভ্যাস কিরকম, অন্য কোনও রোগ আছে কিনা সমস্তটা দেখেই ওষুধ দেওয়া হয়! কখন, কী মাত্রায়, কতদিন ধরে খেতে হবে তারপর কিভাবে ওষুধ ছাড়তে হবে সমস্তটা বুঝে তারপর ঘুমের ওষুধ খাওয়া জরুরি! তাই অবশ্যই যেকোনো ঘুমের ওষুধ খাওয়ার আগে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করেই খাবেন!
ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি আমরা নিজেদের মধ্যে কি কি ধরণের অভ্যাসগত ও আচরণগত পরিবর্তন আনতে পারি তা নিয়ে একটু আলোচনা করতে পারি!
ইউনিভার্সাল স্লিপ হাইজিন (Universal Sleep Hygiene)
আমরা রোজ নিয়মিত যেখানে শুই, তার আশেপাশের পরিবেশ বিছানা, বেডরুম, ঘরের আলো এদের সাথে আমাদের একটা কন্ডিশানিং (Conditioning) তৈরি হয়, প্রতিটি লোকের ক্ষেত্রে তা আলাদা আলাদা। অনেকেই একদম ঘর অন্ধকার করে ঘুমোতে পারেন না, অনেকের অল্প আলো লাগে, অনেকে আবার আলোতেই ঘুমিয়ে পড়েন! কেউ একদম আওয়াজ সহ্য করতে পারনে না, কারও খুব ঠাণ্ডা ঘর দরকার হয়! তাই প্রত্যেকের অভ্যাসের সাথে এই ঘুমের আচরণ আলাদা আলাদা হয়। কেউ যদি ঘুমের সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন তখন সবার আগে তার ঘুমানোর জায়গা ও নিজের লাইফ স্টাইল পরিবর্তনের একটা চেষ্টা করে দেখা উচিত!
কি কি করব না??
(১) দিনের বেলা বেশি ঘুম। যাকে বলে টেকিং ন্যাপ সেটা যেন ৩০ মিনিটের বেশি না হয়!
(২) রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম না এলে শুয়ে শুয়ে ঘড়ি দেখা।
(৩) ঘুমনোর জাস্ট আগেই কোনও রকম ব্যায়াম বা এক্সারসাইস করা।
(৪) ঘুম না এলে কোনও রকম টিভি বা মোবাইল দেখা।
(৫) বিকেলে বা সন্ধ্যের সময় প্রচুর চা বা কফি খাওয়া।
(৬) ডিনারে অনেক বেশি খাবার খেয়ে ফেলা।
যদি ঘুম না আসে-
(৭) সিগারেট খাওয়া।
(৮) অ্যালকোহল খাওয়া।
(৯) বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন দেখা বা ফোনে কথা বলা।
(১০) বিছানায় ব্যায়াম বা এক্সারসাইস করা।
(১১) বিছানায় বসে খাওয়া দাওয়া করা!
কি কি অবশ্যই করব??
(১) নিয়মিত ভাবে একইসময় ঘুমোতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠা।
(২) যদি খুব খিদে পায় তাহলে ঘুমোনর আগে অল্প টিফিন করা যেতে পারে।
(৩) সন্ধ্যে বিকেল বা সকালের দিকে একটা নিয়মিত এক্সারসাইস বা শরীরচর্চা করার রুটিন বানিয়ে নেওয়া।
(৪) যদি কোনও বিষয় নিয়ে খুব চিন্তিত বা স্ট্রেসে থাকেন তাহলে ঘুমনোর আগে তা লিখে রাখুন ভালো করে এবং সকালে ঘুম থেকে উঠে সেটা নিয়ে ভাবুন।
(৫) যতটা সম্ভব বেডরুম অন্ধকার করে রাখুন।
(৬) ঘরের উষ্ণতা ঠাণ্ডার দিকে থাকলে ভাল হয়।
(৭) বেডরুম যতটা সম্ভব আওয়াজ-মুক্ত রাখুন, কোনও তীব্র জোরালো শব্দ যেন না থাকে।
(৮) নিয়মিত স্নান করুন।
(৯) মোবাইল ও ল্যাপটপের স্ক্রিনিং টাইম যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা।
(৯) আমাদের নিয়মিত ও স্বাস্থ্যকর ঘুমের জন্যে দিনের বেলা চোখে আলো পড়াটা খুব জরুরি! যেহেতু লকডাউনে সবাই ঘরে বন্দী প্রায় বাইরে কেউ বেরোচ্ছি না! যতটা সম্ভব ঘরের দরজা জানলা খুলে রাখুন তাতে আলো বাতাস চলাচল হবে! দরকার হলে ছাদে বা ফাঁকা জায়গায় কিছুক্ষণ স্বাভাবিক আলোতে দাঁড়িয়ে থাকুন।
(১০) সর্বোপরি ঘুমোনোর আগে নিজেকে এক ঘণ্টা সময় দিন যে, এবার আমি ঘুমোতে যাব, যাকে বলে উইন্ড ডাউন সময় (Wind-Down Time)- অল্প আওয়াজে পছন্দের গান শোনা, আলো কমিয়ে দেওয়া, বিছানা গুছিয়ে নেওয়া, মানে নিজেকে রিল্যক্স করে গুছিয়ে শান্ত করে আনা।
স্টিমুলাস কন্ট্রোল থেরাপি (Stimulus Control Therapy)
রিচার্ড বুটজিন অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটিতে এই থেরাপি শুরু করেন। বিভিন্ন অদরকারি উদ্দীপনা ও নিয়মকে বাদ দিয়ে (Un-conditioning) এড়িয়ে চলা এই থেরাপির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রথমত, যখন সর্বোচ্চ ঘুম পাবে তখনই একমাত্র বিছানায় শুতে যাবেন! দ্বিতীয়ত, ঘুম ও সেক্স করা ছাড়া অন্য কোনও কাজে বিছানাকে ব্যবহার না করা! তৃতীয়ত, ঘুম না এলে বিছানায় শুয়ে থেকে নিজেকে বোরিং আর হতাশ করে তুলবেন না- ২০-২৫ মিনিট পর ঘুম না এলে উঠে পরুন, অল্প পায়চারি করুন, পছন্দের গান শুনুন (কিন্ত কোনও লাউড মিউসিক নয়), তারপর আবার শুতে যান। শেষত- আমাদের ২৪ ঘণ্টায় সূর্য ওঠানামা দিন রাতের চক্রের সাথে সাথে আমাদেরও ঘুম-জেগে ওঠার একটা সম্পর্ক আছে, এদের দুটোর মধ্যে সঠিক সামঞ্জস্য নিয়ে আসা।
স্লিপ রেস্ট্রিকশন থেরাপি (Sleep Restriction Therapy)
ডাক্তার আরথার স্পিলম্যান এই থেরাপি নিয়ে তৈরি করেন। তিনি বলে আমাদের স্লিপ এফিসিয়েন্সি (Sleep Efficiency) বাড়াতে হবে অর্থাৎ আমরা যে সময়টা বিছানায় প্রকৃত অর্থে ঘুমাই আর যে সময়টা বিছানায় শুয়ে থাকি তার অনুপাত (Ratio) বাড়াতে হবে! অর্থাৎ আমরা যদি ৮ ঘণ্টা বিছানায় শুয়ে থাকি যার মধ্যে মাত্র ৫ ঘণ্টা ঘুমোতে পারি তাহলে এই বাকি ৩ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে শুয়ে থাকার সময়টা কমিয়ে আনতে হবে! প্রথম দিকে কষ্টকর হলেও ধীরে ধীরে এই থেরাপিতে উপকার পাওয়া যায়!
প্যারাডক্সিকাল ইন্টেনশান (Paradoxical Intention)
এটা একটা চিন্তার পদ্ধতি যার উপকারিতা নিয়ে বিতর্ক আছে! তবুও কিছু কিছু ব্যক্তির কাছে এটি ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে! যেখানে যখন ঘুম আসে না, তখন আরও বেশি করে জেগে থাকতে বলা হয় যতক্ষণ জেগে থাকতে পারে! অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ঘুম নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা ও স্লিপ ল্যাটেন্সি (Sleep Latency অর্থাৎ ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়া থেকে ঘুম আসা অবধি যে সময়) এই থেরাপি অনেকটা উন্নতি করে।
কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি ফর ইনসমনিয়া (Cognitive Behavioural Therapy for Insomnia)
এখানে ঘুম না হওয়ার চিন্তার সঙ্গে আমাদের যে নেতিবাচক ইমোশান তৈরি হয়, তার একটা বিচ্ছেদ ঘটানো হয়! “আমার নিশ্চয়ই বাজে কোনও কিছু হয়েছে কারণ ঘুমোনোর ৩০ মিনিটের মধ্যে আমার ঘুম আসে না!” অথবা “আমি যদি আজ ৮ ঘণ্টা না ঘুমোতে পারি কাল কাজের জায়গায় খুব বাজে কিছু একটা হবে!” তাদের ক্ষেত্রে নিয়ম করে ঘুমনোর দিনলিপি (Sleep Diary) তৈরি করা রোজ কত ঘণ্টা ঘুম হচ্ছে, কখন ঘুম ভাঙছে, কতক্ষন বডে শুয়ে আছে, শুয়ে পড়ার কতক্ষন পরে ঘুম আসছে, ঘুম না এলে কী অনুভূতি আসছে এই সব নিয়ে। রোজ নিয়মিত চার্ট বানানো। এবং তা নিয়ে ডাক্তারবাবুদের সাথে কথা বলা! এখানে ধীরে ধীরে ঘুম সম্পর্কিত ভুল ধারণা ও বিশ্বাস গুলোকে পরিবর্তিত করা হয়!
রিল্যাক্সেশান থেরাপি (Relaxation Therapy)
বিভিন্ন ধরণের রিল্যাক্সেশান টেকনিক খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়-ম, যেমন– ডিপ ব্রেথিং (Deep Breathing) গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে, প্রোগ্রেসিভ মাসল রিল্যাক্সেশান থেরাপি (Progressive Muscle Relaxation) এর মাধ্যমে আমরা উপকার পেতে পারি! এখানে বর্ণনা করার চেয়ে ইউটিউবে অনেক সুন্দর সুন্দর ভিডিও আছে যা দেখে খুব সহজেই আপনারা শিখতে পারেন!
আমি অ্যাবডোমিনাল ব্রেথিং টেকনিক নিয়ে নিচে অল্প বিস্তর আলোচনা করছি।
প্রথম ধাপ-প্রথমে স্বাভাবিক ভাবে শুয়ে (পিঠ নিচে Supine Position) নাক বা মুখ দিয়ে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ুন। লক্ষ্য করুন আপনার স্বাভাবিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার ছন্দটা কী! চোখ বন্ধ করে সেটায় মনোযোগ দিতে শুরু করুন।
দ্বিতীয় ধাপ- ধীরে ধীরে আপনার পেটকে ব্যবহার করতে শুরু করুন। বুকে জোর কম দিয়ে পেট দিয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করুন!
তৃতীয় ধাপ- প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার পর হাফ সেকেন্ড থেমে যান! নিজের নিঃশ্বাসকে ফিল করতে শুরু করুন! কেমন লাগছে আপানর?? এটা কি আরামপ্রদ হচ্ছে?? স্বচ্ছ ঠাণ্ডা জলের এক ধীর শান্ত নদীর স্রোতের মত বইছে একই গতিতে?? ধীরে ধীরে প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাস গভীরভাবে শান্ত ও মসৃণ হয়ে উঠবে!
চতুর্থ ধাপ- মনোযোগ বাড়িয়ে তুলুন যেখানে আপনার নিঃশ্বাসের প্রতিটি কণা আপনার নাক ছুঁয়ে ভেতরে ঢুকছে আর বাইরে বেরোচ্ছে। আপনি তাকে ফিল করতে পারবেন।
পঞ্চম ধাপ- মনের মধ্যে চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করতে থাকুন-যেখানে আপনি হাল্কা হয়ে ভেসে যাচ্ছেন যদি অন্য কোনও ভাবনা এসে বাধা দেয় আবার বন্ধ করে চেষ্টা করা শুরু করুন।
প্রথমদিকে একটু সময় লাগবে রপ্ত করতে তারপর ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে! এক ধাপ থেকে আর এক ধাপে পরিবর্তন যেন খুব সুন্দর মসৃণ ভাবে হয়। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন আপনি কতটা রিল্যাক্স হয়ে উঠছেন, আপনার চারপাশ এবং নিজেকে নিয়ে আলাদা রকম বোঝাপড়া তৈরি হবে!
দীর্ঘ চার মাস কষ্ট পাওয়ার পর রিমিতা একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে আলোচনা শুরু করে! ওর ঘুমের সমস্যা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে ওর পক্ষে দিনের বেলা জেগে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছিল! অফিসে ছুটি নিচ্ছিল! তারপর এই ঘুম না হওয়ার কথা বিক্রমকে বলায় ও একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে দেয়! প্রথম দু’সপ্তাহ বেশ ঘুমের ওষুধ খায় তারপর ধীরে ধীরে ডাক্তারের কথা মতো বন্ধ করে দেয়! পাশাপাশি কিছু নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করে! শুরুর দিকটায় বেশ কষ্ট হত! কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে উপকার পেতে শুরু করে! বিছানা ছেড়ে ঘরে একটা চেয়ার এনে তাতে কাজকর্ম করা শুরু করে! রাত ১২ টার পর আর মোবাইল দেখে না, ঘুমোনোর আগে ঘরের আলো কমিয়ে আনে, খানিকটা পছন্দের গান শোনে, দরকার হলে যে রিল্যাক্সিং টেকনিকগুলো শিখে নিয়েছে সেগুলো প্র্যক্টিস করে, রোজ নিয়মিত সময়ে ঘুমোতে যায় আর একই সময়ে উঠে পড়ে! এভাবে ধীরে ধীরে নিজের অনিদ্রা থেকে সেরে ওঠে রিমিতা।
ঘুম আমাদের জীবনের এক খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ! জীবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ আমাদের ঘুমের জন্যে বরাদ্দ থাকে! ঘুম আমাদের স্মৃতিশক্তি ঠিক রাখতে, চিন্তা ভাবনার সচলতা ও দ্রুততা, মন-মেজাজ ভালো রাখতে, শরীরে এনার্জি ধরে রাখতে সাহায্য করে! তাই সুস্থ থাকতে হলে সঠিক উপায়ে স্বাস্থ্যকর ঘুম খুব প্রয়োজনীয়! খুব অল্প ঘুমের অভ্যাসও যেমন খারাপ তেমনি অনিয়মিত ভেবে অনেকক্ষণ ধরে ঘুমিয়ে থাকাও ভালো নয়! সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় এর উপস্থিতি খুব বাঞ্ছনীয়! তাই প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুয়ে পড়ুন, নিয়মমাফিক সকালে বিছানা ছেড়ে দিন! প্রত্যেকে প্রত্যেকের মত করে নিজেদের রোজকার জীবনে মোটামুটি একটা রুটিন বানিয়ে নিজেদের গুছিয়ে নিক-এইটাই জরুরি! অনিয়মিত ও স্বাস্থ্যকর সময়সূচী বানিয়ে অযথা নিজেকে অনিদ্রার দিকে ঠেলে দেবেন না!
খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে