আমার কাছে লোকেরা সুস্থ হতে আসে। আরোগ্য পেতে আসে। কিন্তু তাদের সুস্থতা আমাকে কখনও প্রভাবিত করে না। জীবন আমাকে কখনও প্রভাবিত করে না। আমাকে প্রভাবিত করে মৃত্যু।
জীবন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু। মৃত্যু পৃথিবীর চিরন্তন অমোঘ সত্য। মৃত্যু বারেবারে আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। নানাভাবে। অন্যান্য ডাক্তারবাবুদের মত আমিও মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পাই। আমার কোনো রুগির মৃত্যু সংবাদ শুনে সবার প্রথমে আমার নিজেকেই অপরাধী বলে মনে হয়। যখন আমার অল্প বয়স ছিল তখন এই বোধ খুব বেশি ছিল। এখন সময়ের সাথে সাথে অনুভূতিতে মরচে পড়ে গেছে। তবু এখনও কিছু কিছু মৃত্যু নিজেকে নীরব করে রাখে। আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি।
যেসব মানুষেরা মারা গেছেন তাদের হাসি-বেদনা-সংলাপ-ক্লান্তি-ক্রোধ আমার সামনে ঘুরে বেড়াতে থাকে। একই ঘটনার বারবার অনুবর্তন হয়। আমার দশ বাই পনেরো ঘরের মধ্যে মৃত্যুগুলো আটকে থাকে। ধীরে ধীরে তারা একদিন চলে যায় ঠিকই কিন্তু কিছুদিন তারা আমাকে তাদের উপস্থিতি নিয়ে বিব্রত করে বেড়ায়।
ভদ্রমহিলা একজন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। সুশ্রী। গায়ের রং যথেষ্ট ময়লা। তার স্বামীটি খুব সুদর্শন না হলেও গায়ের রং ধপধপে। মহিলার মুখে সবসময় একটি হাসি মাখানো আছে। কথা বলছেন অথচ হাসছেন না এমনটা হয় না। এহেন মানুষ যখন এসে বারবার বলেন ডাক্তারবাবু আমার সবসময় খুব দুশ্চিন্তা হয়, বুক ধড়ফড় করে তখন ডাক্তার হিসেবে আমার বিস্ময় হয় বইকি।
বারবার একই কথা বলেন। আমি তাকে বলি, দেখুন আপনার যা বয়স মেনোপজের সময় প্রায় হয়ে এসেছে এই সময় মেয়েদের দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা বেড়ে যায়। আপনি আপনার বয়সী অন্যদের সাথে কথা বলে দেখবেন সবারই একই ঘটনা ঘটে। এই নিয়ে বিরাট চিন্তার কিছু নেই।
তবু উনি মাঝেমাঝেই আসেন। সামান্য প্রেসারের কিছু ওষুধ ছাড়া তাকে কিছুই দিই নি। সামান্য অ্যান্টি ডিপ্রেসান্ট যোগ করে দিই। ভবী ভুলবার নয়। একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনার এত দুশ্চিন্তার কারণ কী আছে বলে আপনার মনে হয়? সেদিন ভদ্রলোকও আমার চেম্বারে এসেছেন। তাদের ছোট মেয়েটিও এসেছে।
– ডাক্তারবাবু, ও সবসময় এত ভগবান ভগবান করে, এত তীর্থ পুণ্যস্নান করে বেড়ায়- আমার সবসময় মনে হয় ও একদিন আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে।
– আপনিই বলুন ডাক্তারবাবু, ওর কথার কোনো যুক্তি আছে? আর আজ হোক বা কাল আমাদের সবাইকে তো সেই আধ্যাত্মিকতার রাস্তায় পা রাখতেই হবে তাই না? সবাইকে তো একদিন ওই পথেই যেতে হবে।
– দেখলেন ডাক্তারবাবু, আবার সেই একই কথা। একটা ছোট মেয়ে আছে। ও চলে গেলে আমি ওকে একা কিভাবে বড় করব?
– উনি কী আপনাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন নাকি? ঈশ্বরের সঙ্গ যিনি ভালোবাসেন তিনি তো ঈশ্বরের জন্য নির্ধারিত জায়গায় ঘুরে বেড়াবেনই। তার মানে কি এই যে উনি সন্ন্যাস নিয়ে নেবেন। সংসার আর ঈশ্বরের আরাধনা কি একই সাথে করা যায় না? উনি কি নিজে আপনাকে কখনও বলেছেন যে উনি আপনাকে ছেড়ে দিতে চান?
ধমকের সুরে বললাম বটে তবে বুঝতে পারলাম দুজনের চেহারায় যে পার্থক্য সেটিকেই মহিলা বিয়ের পর থেকে নিজের ভেতরে একটা কমপ্লেক্স হিসেবে নিয়েছেন এবং সেটিকে তার অচেতন মন আড়াল করে ঈশ্বর বিশ্বাসের মোড়কে বারবার হাজির করছে। তার স্বামী যতই তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করুন না কেন তার মন থেকে স্বামীকে হারাবার চিন্তা কিছুতেই যায় না।
উনি বারবার আমার চেম্বারে আসতেই থাকেন আর বুক ধড়ফড় করার কথা বলেন। আমিও বিব্রত হয়ে ওনাকে হার্টের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালাম। বললাম একজন হার্টের ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে নিতে। তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। প্রেসারের ওষুধ আর ঘুমের ওষুধ নিয়েই ওনার জীবন চলতে লাগল।
একদিন হঠাৎ চেম্বারে ওনার স্বামী ওনাকে নিয়ে এলেন। পায়ের কাফ মাসলে প্রচন্ড ব্যথা তার সাথে শ্বাসকষ্ট। এই প্রথম ওনাকে আমি ব্যথায় কান্নাকাটি করতে দেখলাম। বুঝলাম এ সাধারণ ওষুধে সারার নয়। বললাম হাসপাতালে ভর্তি করতে। মহিলা একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। ভদ্রলোক ছোটখাটো একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন। তবু ওরা ওদের সাধ্যের অতিরিক্ত চেষ্টা করলেন।
কলকাতার ভালো নার্সিং হোমে ভর্তি করে চিকিৎসা করালেন। ওনার ডিপ ভেন থ্রমবোসিস হয়েছিল, তার সাথে পালমোনারি এম্বোলিজম। পায়ের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে সেখান থেকে ক্লট ফুসফুসে গিয়ে আটকে গিয়েছিল। খুব সাধারণ অসুখ নয় কিন্তু ভগবান এই দুর্ভাগ্যের জন্য ওনাকেই নির্বাচন করেছেন, উনি আর কী করেন। ঈশ্বরের আশির্বাদ যেমন আমাদের বহন করতে হয় অভিশাপও তাই।
অনেক চিকিৎসা করে অনেক খরচ করে উনি সুস্থ হলেন। তার অনেকদিন বাদে চেম্বারে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। মেয়েটি বড় হয়ে গেছে। মেয়েকে দেখে ওনার শরীরের খবর নিলাম। উনি এখন সুস্থ আছেন। বিপদ কাটিয়ে উঠে তার মুখের অমলিন হাসিটি আবার ফিরে এসেছে। যাবার সময় বলেন, ডাক্তারবাবু একটা ক্যালেন্ডার থাকলে দিন না।
বছরের শুরুতে প্রচুর ক্যালেন্ডার পাই। খুব কমই নিজের কাজে লাগে। বাকিগুলো রুগিদের বিতরণ করে দিই। দেখলাম সব শেষ। একটা কম্পিউটার টেবিলে রাখার বড় ম্যাট ক্যালেন্ডার ছিল। তাই দিলাম। মেয়েটি খুব খুশি হল। একটা পেন দিলাম। এগুলো আমার রুগিদের নিয়মিত দেবার জন্যই থাকে। এত পেন এম আর- দের থেকে পাই যে সেগুলো নিজের বা বাড়ির লোকেদের লাগে না।
এর মধ্যে বছর ঘুরে গেছে। কোভিডের দ্বিতীয়-তৃতীয় ঢেউ পার হয়ে গেছে। একদিন সকালে ভদ্রলোক দেখি বাড়িতে হাজির। দেখাবেন। আমি বললাম আমার বাড়ির চেম্বার তিন বছর বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িতে দেখি না। দেখাতে হলে উনি যেন আমার চেম্বারে আসেন।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ডাক্তারবাবু সব শুনেছেন তো?
– কী শুনব? আমি তো কিছু জানি না।
– আমার মিসেস ছ-মাস হল মারা গেছেন।
– মারা গেছেন? কিভাবে?
– হঠাৎ করে স্ট্রোক হয়ে গেল। একুশ দিন নিউরোসায়েন্সে ভর্তি ছিল। অপারেশন হল। সব চেষ্টা করলাম। যা ছিল সব গেল। বাঁচাতে পারলাম না। এই তো সকালে বাজার করে, মাছ কেটে, রান্না করে আসছি। তাই সময় মত আপনার চেম্বারে আসতে পারি নি।
– আমার বাড়িতে দেখার কোনো ব্যবস্থাই নেই। আপনি বিকেলেই আসুন।
– তাহলে মেয়েকেও নিয়ে আসব।
ভদ্রমহিলা মারা গেছেন এই কথাটা সত্যিই আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। ওনার প্রায় আমার মতই বয়স। বয়স কম বলে নয় তার মৃত্যুর মধ্যে কী যেন একটা ছিল যা আমার ভেতর খচখচ করছিল। আমাকে পীড়া দিচ্ছিল।
বিকেলে ভদ্রলোক আর ওনার মেয়ে দেখালেন। মেয়েটি এখন বেথুনে অঙ্কে অনার্স নিয়ে পড়ছে। ফার্স্ট ইয়ার। মেয়েটি সবসময়ই একটু চুপচাপ। মনে হয় যেন শৈশব থেকেই কিছুটা অবসাদে আক্রান্ত। এখন আরো যেন চুপচাপ হয়ে গেছে।
আমি ওকে একটা পেন দিলাম। খুশি হল। পেন দিতে গিয়েই মহিলার কথা মনে হল। দেখলাম এ বছরের একটা ক্যালেন্ডার এখনও অবশিষ্ট আছে। সেটি দিলাম। ওর বাবা বলল, ডাক্তারবাবু আপনি গত বছর যেটি দিয়েছিলেন সেটা এখনও ও টেবিলে রেখে দিয়েছে।
ওরা চলে গেল। আমার পুরনো স্মৃতি মনে ঘুরে বেড়াতে লাগল। মহিলা সবসময় ভীত ও সন্দিগ্ধ হয়ে থাকতেন এই বুঝি তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাবে। আর আজ উনি সারাজীবনের কঠিন দায়িত্ব ও সমস্ত সংসারের ভার স্বামীর ওপর ফেলে দিয়ে তাকে চিরদিনের মত বন্দি করে রেখে গেছেন।
বাইরে অনেক রুগি ছিল। ভদ্রলোককে আমার জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে ছিল, এত কিছুর পরেও তিনি তাঁর জীবনে ঈশ্বরকে কিভাবে দেখেন? এখন ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস বা আস্থা তাঁর কতটাই বা বেঁচে আছে? পৃথিবী যদি ঈশ্বরহীন হয় তাহলে মানুষের ক্ষতি কতটা? লাভই বা কী?
ভাগ্যের কাছে মানুষের অসহায়তা দেখে এই কথাই আমার বারবার মনে হয়। মৃত্যু আমাকে এটাই বারবার মনে করিয়ে দেয়। উনি এলে পরে তাঁর জন্য এই প্রশ্নগুলো আমি মনে জমিয়ে রেখেছি। উনি কী বলেন আপনাদের জানাব।