– আপনি তো রাইটার? মানে রাইটারদের একজন?
যে লোকটা জিজ্ঞেস করল তার চেহারাটা কেমন যেন। ছেঁড়া ছেঁড়া হলদেটে ফ্যাকাশে চামড়া। হাতে মুখে কালো মেচেতার মত দাগ।
অনেকদিন না শোনা, এককালের বহু আকাঙ্ক্ষিত রাইটার শব্দটা শুনে চমকে উঠলাম। চমকে ওঠার কারণও ছিল।
★
কলকাতায় এসে আটকে পড়েছি। আধা লকডাউন সিচুয়েশনে ফকিরের আটতলার ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিয়েছি। ফকির চন্দ্র রায়। আমার প্রথম যৌবনের পাঁচ বন্ধুর একজন। মধুপুর শহরে আমরা জোট বেঁধেছিলাম। সেই প্রথম যৌবনে আমরা খুব সাহিত্য বাতিকে মজেছিলাম। চিন্তা ভাবনা করে আমাদের আড্ডার নাম দিয়েছিলাম রাইটার্স বিল্ডিং। তখন আমাদের একটিই প্রেমিকা ছিল। মহাভারতের ভাইদেরও যেমন। তার নাম কবিতা। আমরা পাঁচজন বলে আমাদের কবিতা পত্রিকার নাম রেখেছিলাম পাণ্ডব। আমাদের বিশ্বাস ছিল, এই পাণ্ডবে কবিতা লিখেই আমরা একদিন…
সেই পাণ্ডবেরা বহুদিনই বিচ্ছিন্ন। কবিতা তাদের ছেড়ে চলে গেছে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও ক্ষীণ, প্রায় নেই। শুধু আমি আর ফটিকচন্দ্র মানে কর্পোরেট হাসপাতালের মাঝারি কর্তা পিসি রায় নিজেদের মধ্যে ইয়েটা রেখেছি। ব্যাটাচ্ছেলে বিয়ে শাদি করেনি। দিনে অফিস আর রাত্রে মদ্যপান, এই তার রুটিন। ফোনে যেই না বলেছি আমি কলকাতায়, আমাকে নির্দেশ দিয়েছে তার ফ্ল্যাটে এসে উঠতে। হ্যা হ্যা করে হেসে বলেছে,
– শালা গ্যালন গ্যালন মাল খেয়ে রক্ত স্যানিটাইজ করে রেখেছি। শিগগির চলে আয়। ট্রেন-ফেন চালু হলে নয় ফিরবি।
তার আটতলা ফ্ল্যাটে সিউরিটিকে এড়িয়ে একটা মাছিরও আসার উপায় নেই। তায় আবার বাইরের সাউথ ফেসিং ব্যালকনিতে বসে আছি। বাইরের দরজায় ছিটকিনি। কারওর এখানে আসার প্রশ্নই নেই। এক যদি স্পাইডার ম্যান টাইপের কিছু না হয়। লোকটা এল কী করে কে জানে।
★
ফকির ভেতর ঘরে দ্রব্যগুণে চিতপাত। আমিও কিঞ্চিৎ টিপসি। ওই দ্রব্যগুণ! তাই এই সব জটিল আর কূট প্রশ্ন সরিয়ে রাখলাম।
লোকটাকে শুধোলাম, – হ্যাঁ, তা লিখি বটে। মানে লিখতাম। আপনি জানলেন কী করে?
খিক খিক করে হাসল। – বাঃ আমি জানব না?
– কী নাম আপনার? সিআইডি টিআইডিতে আছেন নাকি মশাই?
– কী যে বলেন স্যার, হে হে হে…
– আগমনের উদ্দেশ্য?
– স্যার, কিছু শব্দের ভূত এনেছিলাম। আপনাদেরই পোষ্য ছিল এককালে। তারপর মরে ভূত হয়ে গেছে। স্যাম্পেল দেখাব স্যার?
এই সেলসম্যানটা দেখি স্যার স্যার করে ভেজাতে চাইছে। দিল আমার নেশাটার বারোটা বাজিয়ে। দিব্যি মৌতাতে ছিলাম। তাও লোকটার আকুলি বিকুলি দেখে মায়া লাগল। আইটেমটাও নতুন গোছের।
– দেখাও দেখি শব্দের কী ভূত না কী ছাতার মাথা এনেছ।
– এই যে… বলে খানকতক পুরোনো ছেঁড়া ছেঁড়া হলদেটে কাগজ বার করল লোকটা।
আমি অবাক বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকালাম, – এই সব কী? কাগজে কী?
– আজ্ঞে, শব্দের ভূত তো। কাগজেই তো থাকবে। কবেই মরে গেছে শব্দগুলো। শুধু কাগজেই রয়ে গেছে। এখনও। এই সব শব্দ লেখে না কেউ। এই যে দেখুন, তব মম মোর তেঁই এই রকম একশোটা মরে ভূত হয়ে যাওয়া শব্দ…। ঠিক আছে। এখনই নিতে হবে না। আপনি স্যাম্পলগুলো দেখুন। রাইটার বলেই বলা। যদি ইউজ করেন। বহুদিন ভূতগুলো ব্যবহার হয়নি বলেই একটু শুঁটকি মেরে গেছে। যদি একটু ক্ষমাঘেন্না করে ইয়ে করেন। এই রইল আমার কার্ড। নামটা মনে রাখবেন স্যার… পাণ্ডব… পাণ্ডব বিশ্বাস!
এইটুকু বলেই লোকটা ওই আটতলার ব্যালকনি থেকেই গ্রিল পেরিয়ে কেমন যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল।
ওর দেওয়া কাগজগুলো পেপারওয়েট চাপা দেওয়া। সেন্ট্রাল টেবিলের ওপরে। নেশার ঘোরেই ভাবলাম, অ্যাদ্দিন ধরে রয়াল স্ট্যাগ মারছি। ঠিক এই রকম খোয়ারি আগে কোনওদিন হয়নি।
★
ঘোর কাটল পুরো বারো ঘণ্টা পর। ভেতরের ঘরে টুকটাক আওয়াজ পাচ্ছি। কাজের দিদি এসেছে বোধ হয়। তার মানে ফকির উঠেছে আরও আগেই। আমার সাড়া পেয়ে বেডরুম থেকে মুণ্ডু বাড়াল। – কীরে, সারারাত সোফাতেই অ্যাঁ? রেগুলার মাল খাবি আমার মত। তাইলে আর ওই দু তিন পেগেই টাল খাবি না।
বলেই সেন্ট্রাল টেবিলের ওপর পেপার ওয়েট চাপা দেওয়া কাগজগুলো দেখতে পেল। তুলে পড়তে পড়তে বলল, – এগুলো কী অ্যাঁ, এ তো দেখছি সেই আমাদের লিটল ম্যাগ ‘পাণ্ডব’এর জন্য পাঠানো একটা কবিতার পাণ্ডুলিপি। তোরই লেখা।
যে’টা সুনীলদা’কে দেখাতে উনি হেসে অস্থির হয়েছিলেন, – এই সব মরে যাওয়া শব্দ দিয়ে কাব্যি ফাঁদছ তোমরা? এ’তো শব্দের ভূত হে।
অবশ্যি তারপর তো আর বেরোলোই না আমাদের ম্যাগাজিনটা।
★
আমি উঁকি মেরে দেখি, আমারই হাতের লেখা। রবীন্দ্রনাথের লাইন ঝেড়ে, নিজের শব্দ বসিয়ে, কবিতা বানানোর বৃথা চেষ্টা।
‘দেবী, তব নত নেত্র মোর পানে চেয়ে দেখিল না।
ফার্স্ট ওয়ার্নিং বেল মম বৃথাই ধ্বনিল,
কেহই দিল না সাড়া…
বিশালাক্ষী দেহ পদছাপ’ ইত্যাদি ইত্যাদি!
★
লোকটা কী যেন নাম বলেছিল? ওই সেলসম্যানটা?
মনে পড়ে গেল। সেই কবেই মরে যাওয়া আমাদের লিটল ম্যাগ। যাকে আমরা খুব বিশ্বাস করেছিলাম। আমাদের পাণ্ডব।
পাণ্ডব বিশ্বাস।
ফটিক দাঁত বার করে হাসছিল। এখনও তোর কাছে রয়েছে এই কবিতা লেখা কাগজটা?
★
আমি ভাবছিলাম লোকটার কথা। ও ছিল আসলে আমাদের সেই বোকাটে যৌবনের লিটল ম্যাগাজিনের ভূত।
এসেছিল। চলেও গেছে।