আমি মধ্যমগ্রামের অরুণাচলের ছেলে, সোদপুরের অরুণাচল থেকে ডা. দোলনচাঁপা দাশগুপ্তর ফোন পেলাম। ‘ঐন্দ্রিল, শোন না, আমাদের পাড়ার পুজোর এবারের থিম ‘মনের জানলা’ অর্থাৎ বই। মণ্ডপে একাধিক প্রকাশনীর বইয়ের স্টল থাকছে। যদি প্রণতি প্রকাশনীর পক্ষ থেকে তোরা একটা স্টল করতে পারিস। চতুর্থীতে উদ্বোধন।‘
আমি বললাম, ‘দাঁড়াও, আমাদের লোকবলের অবস্থা ভালো না। দেখছি।‘
কৌশিক মেসো খুব ব্যস্ত। সময় দিতে পারবে না। পার্থ আর গৌরকে বললাম। দুজনেই বলল, কোনো সমস্যা নেই। আমরাই স্টলে থাকব।
রাতে দোলনচাঁপাদিকে ফোন করলাম, ‘ব্যবস্থা হয়েছে। ওই দিন বিকেল পাঁচটার মধ্যে বই পত্র নিয়ে ঢুকে যাবে।‘
দিদি বলল, ‘তুই কখন আসবি?’
‘আমি কেন আসব? আমার তো রাতে চেম্বার রয়েছে। যে দুজন যাচ্ছে তারা ঠিক সামলে দেবে।’
‘না না তোকেও আসতে হবে। চেম্বার শেষ করে দেরি করে আয়। কিন্তু আয়।’
দোলনচাঁপাদিকে না বলা মুশকিল্। আনন্দমেলায় যখন ধারাবাহিক ভাবে তার চন্দ্রতালের পরিরা বেরোচ্ছে তখন থেকেই আমি তার ফ্যান। যদিও তখন আমি দোলনচাঁপাদিকে চিনতামই না।
যাব তো বললাম, কিন্তু মুশকিল দেখা গেল অন্য জায়গায়। সেদিন আবার রূপালীর নাইট ডিউটি। রূপালী বলল, যেখানে খুশি যাও। কিন্তু মেয়ে দুটোকে একলা রেখে যাবে না। একা বাড়িতে থাকলে ও দুটো বদমাশ সব কিছুর বারোটা বাজিয়ে দেবে। ‘
রূপালীর রাগের যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। দুদিন আগেই বিকেলে বেরোনোর সময় লিপস্টিক লাগাতে গেছে, ঢাকনা খুলতেই ভেতরে জলে ভর্তি। লিপস্টিক গলে একেবারে টমেটো সস হয়ে গেছে।
এটা কে করেছে জানার জন্য গোয়েন্দা হওয়ার দরকার নেই। অতএব রূপালী হুংকার ছাড়ল, ‘রানী…।‘
রানী যথারীতি কোথাও একটা লুকিয়েছে। এসময় মার কাছাকাছি গেলেই পিঠে গোটাকতক পড়বে, সেটা সে ভালো মতোই জানে।
আমি বাথরুমে ঢুকে যা আবিষ্কার করলাম সেটা আরও ভয়ানক। ল্যাট্রিনের প্যানটা লিপিস্টিকে মাখামাখি। অর্থাৎ ব্যাটা লিপস্টিকটা ল্যাট্রিনের মধ্যে ফেলেছিল। তারপর সেটা তুলে আয়নার সামনে রেখেছে। এটা রূপালী জানতে পারলে আর দেখতে হবে না।
নিচে গিয়ে দেখি তক্তপোষের তলা থেকে ফোঁপানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। একবার ডাকতেই রানী বেরিয়ে এলো। বললাম, ‘লিপস্টিকটা প্যানের মধ্যে ফেলেছিস কেন?’
‘আমি ফেলেছি নাকি। নিজে নিজেই পড়ে গেছে?’
‘ওটার তো আর হাত পা নেই। লিপস্টিক নিয়ে বাথরুমে গেছিলি কেন?’
‘মাখতে ইচ্ছে করছিল। খুব সুন্দর গন্ধ। কিন্তু মা হাত দিতে বারণ করেছিল। আগেরদিনই মার তিনটে নেলপালিশ উলটে দিয়েছিলাম তো। তাই বাথরুমে গিয়ে মাখছিলাম। আমি ফেলিনি, লিপিস্টিক নিজে নিজেই পরে গেল।’
‘বাথরুমে গিয়ে মাখছিলি তাও ঠিক আছে। তা বলে পায়খানায় বসে মাখবি?’
রূপালী সব শুনে টুনে লিপিস্টিকটা ফেলে দিতে যাচ্ছিল। রানী কাতর স্বরে বলল, ‘ফেল না মা। আমাকে দিয়ে দাও।’ ব্যাস, রাগ যেটুকু কমেছিল, আবার বেড়ে গেল।
যাই হোক দোলনচাঁপাদিকে যাব বলেছি, ছোটোকাকুর দোকানের চেম্বার সাতটার মধ্যে শেষ করলাম। তারপর বাড়ি ফিরে মেয়ে দুটোকে নিয়ে এক মধ্যমগ্রামের অরুণাচল থেকে সোদপুরের অরুণাচলে চললাম। ভাগ্যিস গেলাম। গিয়ে দেখি আমার এক স্বপ্নের মানুষ পুজো উদ্বোধন করতে উপস্থিত হয়েছেন। শান্ত স্বরে তিনি বাংলা সাহিত্য নিয়ে অনেক কিছু বলছিলেন। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। কবি জয় গোস্বামী।
প্রিয় কবির উপর অভিমান জন্মেছিল সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী নিয়ে চুপ থাকার জন্য। কিন্তু সামনা সামনি দাঁড়িয়ে সেসব অভিমান অলকানন্দার জলে ভেসে গেল। মঞ্চের থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়েই কবিকে অপলক দেখছিলাম। হঠাত শুনলাম, দোলনচাঁপাদি আমার নাম ধরে ডাকছে।
আমার ভয়ানক মঞ্চ ভীতি আছে। বিশেষ করে সেই মঞ্চে যদি কবি জয় গোস্বামী, বিজ্ঞানী পার্থ মজুমদারের মতো ব্যক্তিরা থাকেন। চুনোপুঁটি আমি মঞ্চে উঠে কবিকে প্রণাম করে দুটি বই তাঁর হাতে তুলে দিলাম। তারপরেই চমক। প্রথম বইটি ছিল, ডা. অরুনাচল দত্ত চৌধুরীর “হাসপাতালের জার্নাল”। সেটি হাতে নিয়েই কবি শান্ত স্বরে বললেন, ‘ইনিই কী সেই অরুণাচলবাবু, যিনি ভয়ানক ভালো কবিতা লেখেন।‘
এক আশ্চর্য আনন্দে গা শির শির করে উঠল। কথা বন্ধ হয়ে আসছিল। আমার একজন প্রিয় মানুষ আরেকজন প্রিয় মানুষের সম্পর্কে প্রশংসা করছেন। কোনোরকমে বললাম, ‘হ্যাঁ।‘
‘এটাতো গদ্যের বই। ওনার কোনো কবিতার বই নেই?’
বললাম, ‘হ্যাঁ আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই।‘
উনি বললেন, ‘ওনাকে বলবেন, আমি পড়ব। নিশ্চয়ই পড়ব।‘
তারপর উনি আরও কিছু বললেন। বুকের মধ্যে এতোটাই ধুক ধুক করছিল সেসব কথা কিছুই মনে করতে পারছি না। শুধু মনে আছে উনি বলেছিলেন, ‘এক অরুণাচলে এসে আরেক অরুণাচলের বই পেলাম।‘
রাতে দুই মেয়েকে স্কুটারে নিয়ে যখন মধ্যমগ্রামের অরুণাচলে ফিরছি তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যিই কবির পাশে বসে মুখোমুখি তাঁর সাথে কথা বলেছি। অরুণাচল পুজো কমিটির সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ এমন একটি স্বপ্নের রাত উপহার দেওয়ার জন্য।
নিজেদের পাড়ায় এসে ঠাকুর আনতে গেলাম। ঠাকুর নিয়ে ফিরলাম যখন রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। সব সেরে টেরে ঘরে ঢুকে রানীকে বললাম, ‘ভাগ্যিস আজ মায়ের নাইট ছিল। না হলে এভাবে টো টো করে ঘুরে বেড়াতে পারতিস না। তোদের সাথে আমিও ঝাড় খেতাম।’
রানী বলল, ‘না বাবা, মা থাকলেই ভালো হত। মাকে ছাড়া কিচ্ছু ভালো লাগে না।’