আমাদের সিনিয়র ডাঃ গৌরাঙ্গ গোস্বামীর একটা পুরোনো লেখা কয়েকদিন আগে ওনার ছেলে আনন্দরূপ পাঠিয়েছে তাতে গৌরাঙ্গদা তাঁর ছাত্রজীবনের রাজনৈতিক কার্যকলাপের স্মৃতিচারণ করেছেন। গৌরাঙ্গদা লিখেছেন দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের সময়ে (সম্ভবতঃ ‘৬৯-৭০ সময়কালে) মেডিকেল কলেজে সদ্যগঠিত BPSF-এর ইউনিটের উদ্যোগে ভারতে সফররত ভিয়েতনামের এক প্রতিনিধি দল আসেন আর সেই উপলক্ষ্যে রক্তদানকারী মেডিকেল ছাত্রদের প্রত্যেককে মার্কিন বোমারু বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরি ধাতব আঙটি উপহার দেন। সেবার ভারতবর্ষে এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাদাম বিন। তবে, মাদাম বিন মেডিকেল কলেজে আসেন নি কোনও কারণে।
বস্তুতঃ, সেই পর্যায়ে মার্কিন হামলার প্রচণ্ড তীব্রতা প্রতিরোধ করে ভিয়েতনাম এক অভূতপূর্ব ইতিহাস রচনায় ব্রতী। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম ও সংশ্লিষ্ট কাম্বোডিয়া-লাওসে এর উপর যে পরিমাণ বোমাবর্ষণ করেছে তা মেগাটনের হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইউরোপ-এশিয়ার উপর বর্ষিত বোমার সামগ্রিক পরিমাণের চেয়ে কম করে দুগুণেরও বেশি। প্রারম্ভিক পর্যায়ে এয়ারফোর্স জেনারেল কার্টিস লিমের উক্তি, “We’re going to bomb them back to stone age”….আর ‘৭২ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পুনরাবৃত্তি,”bomb the livin’ bejesus out of ’em”. কিন্তু, ১৯৭৫-এ সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই মেনে নিতে হয় চূড়ান্ত পরাজয়কে, নিজেদের প্রায় আটান্ন হাজার সৈন্যের প্রাণের বিনিময়ে। ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমান ও বর্ষিত বোমার খোল থেকে শুধুমাত্র স্মারক তৈরি হয়নি, প্রস্তুত হয়েছে প্রতিরোধের অস্ত্রসামগ্রী। সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন সাহায্য করলেও প্রতিরোধযুদ্ধের একটা বিরাট অংশ ছিল ভিয়েতনামে ব্যবহৃত মার্কিন অস্ত্রভাণ্ডার থেকেই পুনর্গঠিত এবং কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি অপহৃত!!!
পঞ্চাশ বছর পরে মহাশক্তিধর ইস্রায়েল ও তার পরম সাহায্যকারী আমেরিকা এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গাজার প্রতিরোধ বাহিনী যুদ্ধ শুরুর প্রায় চার মাস পরেও অনবদমিত। একেবারে প্রথম আরব-ইস্রাইল যুদ্ধ (১৯৪৮) কিছু প্রলম্বিত হয়েছিলো, কিন্তু ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে ইস্রায়েল, মিশর ও জর্ডান এবং মিশর ও সিরিয়া বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে যথাক্রমে মাত্র ৬ ও ১৯ দিনে!! অথচ, ১৭ বছর ইস্রায়েল কর্তৃক অবরুদ্ধ থেকেও ৪০কিমি×৬-১০ কিমি ভূখণ্ডের ছোট্ট অংশ অনায়াস দক্ষতায় পাঞ্জা লড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সর্বশক্তিমান সামরিক শক্তিদের সঙ্গে। এখনও পর্যন্ত নাকি মাত্র একজন অপহৃতকে উদ্ধার করতে পেরেছে ইস্রায়েল বাহিনী ; আর অপহৃত তিনজনকে নিজেরাই খুন করে ফেলেছে, সম্ভবতঃ ভয় বা ভুল বশতঃ! হামাসের কতটা ক্ষতি করতে পেরেছে জানা নেই, তবে সাধারণ মানুষ হত্যা করেছে প্রায় ত্রিশ হাজার, আহত ও নিখোঁজদের নিয়ে যে সংখ্যাটা ইতিমধ্যেই এক লক্ষ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সাড়ে তিনশ বর্গকিলোমিটারের এক অতি ক্ষুদ্র এলাকায় এই নির্বিচারে গণহত্যা কি পেরেছে প্রতিরোধকে স্তব্ধ করতে? পারলে তো আর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে দৌড়ে আসতে হতো না যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব যত না গাজার মানুষকে বাঁচানোর জন্য, তার থেকে অনেক বেশি ইস্রায়েলকে দীর্ঘস্থায়ী জটিল পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের কারণে; সম্মানের সঙ্গে কিছুটা হলেও পশ্চাদপসারণ জন্য! !
কিন্তু হামাসকে কে অস্ত্র সাহায্য করছে, ইরান? নাকি,আরব দুনিয়া? New York Times এ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইস্রায়েল কর্তৃক গাজায় ব্যবহৃত বিস্ফোরক ও অন্যান্য ammunition এবং IDF (Israel Defence Force)-এর অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অপহৃত অস্ত্রাংশই হামাসের ব্যবহৃত অস্ত্রের প্রধান উৎস। গাজায় ব্যবহৃত ইস্রায়েলের অস্ত্রের শতকরা ১৫ ভাগ unexploded; আর এর থেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তোলার জন্য রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি ও মৌলিক ভাবনাচিন্তাসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা গাজার অভ্যন্তরেই। তাছাড়া, ইস্রায়েলী সৈন্যবাহিনীর অস্ত্রের একটি বড় অংশ তো বহুদিন যাবৎ বিদ্রোহীদেরই শক্তি বৃদ্ধি করে আসছে, শুধু ঠিকানা ও মালিকানা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত, এই যা!!!
ভিয়েতনামের সঙ্গে গাজার তুলনা করা যায় কিনা জানি না, তবে দুটো ঘটনাই একটা জিনিস প্রমাণ করে যে পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তোলা আর যাই হোক অসম্ভব কখনোই নয়….!!! সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো গোটা আরব দুনিয়ার গা বাঁচিয়ে চলার প্রচেষ্টা, একটি দেশও কোনও কড়া পদক্ষেপ নেয়নি..কেউই ছিন্ন করেনি অন্ততঃ কূটনৈতিক সম্পর্ক !! গাজার বাইরে প্রতিরোধ শুধুমাত্র এসেছে হিজবুল্লাহ এবং হুথি সংগঠনের কাছ থেকে। এর মধ্যে হুথির আক্রমণে লোহিত সাগরে সামরিক বাণিজ্যিক সব ধরণের জল পরিবহণ বিপর্যস্ত। এশিয়া ইউরোপ সমুদ্রবাণিজ্যের চল্লিশ শতাংশের বেশি চলাচল করে লোহিত সাগর–সুয়েজ খাল পথে। দৈনিক এক মিলিয়নেরও বেশি ব্যারেল crude oil রপ্তানী হয় এই পথে। ফলে ইউরোপসহ বাকি বিশ্বকেও ভুগতে হচ্ছে তার অবশ্যম্ভাবী ফলাফলকে।
কিন্তু হামাস, হিজবুল্লাহ, হুথি..এরা তো সবাই তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদী’ ধর্মীয় সংগঠন। মানবাধিকার রক্ষা বা অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার বিষয়ে এদের রেকর্ড খুব পরিষ্কার/উৎসাহব্যঞ্জক নয়। এদের সমাজতান্ত্রিক পথের অনুসারী বলেও চিহ্নিত করার কোনও কারণ নেই। তা সত্ত্বেও সারা পৃথিবী যখন শুধুমাত্র দর্শক এক বিশাল চলমান গণহত্যার প্রতি, ধ্বংসাত্মক ক্ষমতায় অনেক অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী বাহিনীর বিপরীতে কঠিন মরণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার অসম্ভব অতুলনীয় কৃতিত্বকে অস্বীকার করবো কোন যুক্তিতে, কোন সাহসে???
বস্তুতঃ সারা পৃথিবীতে এখন কোনও পক্ষকেই শতকরা একশো ভাগ সঠিক প্রশংসাপত্র দেওয়া আদৌ সম্ভবপর কিনা জানিনা। মানুষকে পরিষ্কার বেছে নিতে হবে, এই মুহূর্তে মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু কারা আর তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে প্রতিরোধে সক্রিয় কারা তা সে তাদের সীমাবদ্ধতা বা অন্যান্য ট্র্যাক রেকর্ড যাই হোক না কেন। তাছাড়া, আর উপায় বা কি? আর কোনও অপসন আছে কি??