আজ আমি তোমাদের আমার মায়ের গল্প বলব।
আমি? কে আমি? বিশ্বাস করো, আমি নিজেই জানি না।
জানিই না জন্মের পরে কোথায় কেমন ছিলাম। কেউ বলে দত্তক দিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমায়। কেউ বলে তেমন বড় হবার আগেই মরে গেছিলাম। মোটমাট আমি তোমাদের ওই কী বলে ইতিহাস, সেখান থেকে মুছে গেছি অনেক আগে।
মা, আমার মাগো, আমাকে কোল থেকে নামিয়ে অন্য ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবার সময় কী একটুও কাঁদোনি? বাবা, তোমাকে তখন সোহাগ করে ডলি বলে ডাকত। বিয়ের জন্য তার দেওয়া শর্ত কি ছিল নাড়ি ছেঁড়া সন্তানকে ভাসিয়ে দেওয়া? তুমি তার সেই জঘন্য শর্তে রাজি হয়েছিলে?
শর্তের প্রমাণ নেই। কিন্তু আমার বাবা এর চেয়েও কঠিন শর্ত তোমাকে দিয়েছিল মা। স্বামীত্বের অজুহাতে। বিয়ে টেকাতে আমার মা সেই নিষ্ঠুর একপেশে শর্ত কী আশ্চর্য, মেনেও নিয়েছিল।
বইয়ে লেখা আছে। আমার বানানো কথা না গো।
কী ছিল সেই শর্ত? শোনাই তোমাদের।
“নিজের নির্জনতা ও প্রশান্তি বজায় রাখার জন্য অসাধারণ সেই শর্ত স্ত্রীটি মেনে নিলেন।
বিদ্বান স্বামীর দেওয়া শর্তাবলি এ রকম—
ক. তোমায় নিশ্চিত করতে হবে যে,
১. আমার কাপড়চোপড় কাচা, পরিচ্ছন্ন ও গোছানো থাকবে
২. আমার ঘরে দিনে তিন বার খাওয়া পরিবেশন হবে
৩. আমার শোবার ঘর ও পড়ার ঘর পরিচ্ছন্ন থাকবে, বিশেষ করে আমার কাজের টেবল শুধু আমার কাজের জন্যই তৈরি থাকবে
খ. আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তুমি পরিহার করবে, কেবল সামাজিক ভাবে যেটুকু যা দরকার তা বাদে। বিশেষ করে তোমায় ছাড়তে হবে—
১. বাড়িতে আমার পাশে বসে সময় কাটানো
২. আমার সঙ্গে তোমার বেড়াতে বেরনো
গ. আমাদের সম্পর্কে এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে—
১. আমার থেকে কোনও অন্তরঙ্গ ব্যবহার আশা করবে না, কোনও বকাঝকা, শাসানি চলবে না
২. আমি অনুরোধ করলে আমার সঙ্গে কথা বন্ধ রাখবে
৩. আমি চাইলে আমার পড়ার বা শোবার ঘর ত্যাগ করবে
ঘ. কথা দেবে যে আমাদের সন্তানদের সামনে আমায় কথায় বা ব্যবহারে ছোট করবে না।
সম্পর্কহানির এর চেয়ে জোরালো ছবি আর কী হতে পারে!”
হায় রে অবোধ ভালোবাসা চাওয়া মেয়ে। সব মেনে নিল। তাও বিয়েটা টিকল না।
আমি জন্মেছিলাম মা আর বাবার বিয়ের আগে। নিন্দুকেরা বলে, ওই জন্যেই নাকি বাবা বাধ্য হয়েছিল মাকে বিয়ে করতে। কী আশ্চর্য, না? পুরুষেরা বিয়ে করে আর তারা দয়া করে বিয়ে করে বলেই মেয়েদের বিয়ে হয়। মেয়েরা ধন্য হয়।
অথচ একই ক্লাসে পড়া ওই দু’জনের মধ্যে মায়ের রেজাল্ট বাবার চাইতে ভালো ছিল। কিন্তু সে তো প্রথম দিকে। পরে যত মনের ওপর চাপ বেড়েছে, মা আমার পিছিয়ে গেছে লেখাপড়ায়। অন্তত কাগজপত্রে। ডিগ্রিটুকুও, না, সে পায়নি।
যদিও আসল ব্যাপার তা’ না। মা’ই বাবাকে বলে দিত কোন অঙ্কটা কী ভাবে কষতে হবে, ফিজিক্সের কোন ভাবনাটা কী ভাবে ভাবতে হবে। অন্যরাও সাক্ষী দেবে, জিজ্ঞেস করে দেখো! জিজ্ঞেসই বা করতে হবে কেন? মায়ের পেটে থাকতে আমিই তো সে সব শুনতে পেতাম! মা শেখাচ্ছে বাবাকে। (যারা এখানটা অবিশ্বাস করছ, তোমাদের মহাকাব্যে পড়ে নিয়ো, অভিমন্যু কী ভাবে শিখেছিল ব্যূহে ঢোকার উপায়!)
ঠাকুরমা আর ঠাকুর্দার এ’ বিয়েতে মত ছিল না মোটে।
ঠাকুরমা কত বুঝিয়েছিল বাবাকে।- “ওরে, ওই নোংরা বংশের ছুঁড়িকে বিয়ে করবি খোকা? না আছে চাল না আছে চুলো। তোর চাইতে কোন না তিন চার বছরের বড়। দেখতে পেত্নির মত। তায় আবার ল্যাংড়া।” আমার মায়ের কোমরের অসুখ ছিল। শুনেছি হাড়ের যক্ষ্মা থেকে। নাকি আর কিছু।
বাবা তখন মায়ের প্রেমে পাগল। ঠাকুরমাকে বোঝালো দেখতে যাই হোক বুদ্ধিশুদ্ধি দারুণ। যদিও সেই বুড়ি বোঝেনি আদৌ।
আবারও বলেছিল, “কী আছে ওটার? তোর যখন তিরিশ হবে বয়স ও তখন তেত্রিশ বছরের বুড়ি!”
আঃ, ঠাকুরমা, মেয়েরাই কি মেয়েদের সেরা শত্রু হতে হয়? সর্ব দেশে সর্বকালে।
ব্যাপার কিন্তু তাইই। মানে ওই দেখতে ব্যাপারটা। মায়ের তখনকার এক বান্ধবীর বর্ণনায় মা ছিল ‘‘ছোট্টখাট্ট, নরমসরম, কালো চুলের, বেশ বাজে দেখতে।’’
বাবার বন্ধুরা ভারি অবাক হয়েছিল। বাবার মতো এত সুঠাম, উদাসীন রাজপুত্তুর হেন সুদর্শন পুরুষ এত বেঁটেখাটো, পা টেনে হাঁটা, রুগ্ন মহিলায় আকর্ষিত হল কেন?
বাবা নাকি জবাবে আমতা আমতা করে বলেছিল, ‘‘কিন্তু কী সুন্দর কণ্ঠস্বর ওর!’’ আসল কথাটা সুযোগসন্ধানী বাবা কাউকে বলেনি।
বাবাকে এই রকমের বলেছিল বটে সবাই। বাবা কিছুতেই বোঝেনি। তখন একে সে হন্যে প্রেমে পড়া পুরুষ, ত pop o আমার মায়ের থেকে অঙ্ক শেখা বাকি তার। বাকি পদার্থবিজ্ঞানের সুলুক জেনে নেওয়াও।
যা হয়, তাদের এই মেলামেশায় পেটে এসে গেলাম আমি। বিয়ের আগেই সন্তান? কী সর্বনাশ! চিরটা কাল কানীন পুত্র কন্যার যা গতি হয়, আমারও তাই হল।
মা দেখতে খারাপ ছিল। কিন্তু তার ছিল অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যায় ঘোর প্যাশন। স্বভাবে ছিল চিন্তামগ্নতার আত্মিক সৌন্দর্য। আর ছিল গভীর দুই চোখ। বেদনাহত মুখাবয়ব।
বলতে নেই, আমার বাবাটা দেখতে ছিল এক উদাসীন রাজপুত্র কিন্তু স্বভাবে ছিল মেয়ে ঠকানো কিঞ্চিৎ প্লে বয় টাইপের। যদিও অন্যদিকে অঙ্ক আর পদার্থবিদ্যায় ঘোর সিরিয়াস।
মায়ের আগেও প্রেম করেছে দু’বছরের বড় আর এক ললনার সঙ্গে। যাকে দিয়ে নিজের ছাড়া নোংরা জামাকাপড়ও কাচিয়েছে লোকটা। পরে আমার মায়ের বিদ্যেবুদ্ধিতে মোহিত হয়ে সেই আগের জনকে ছেড়েওছে যথাকালে।
অশেষ আর্থিক দুর্গতির মধ্যে এক সময় সংসার টেনেছে দুঃখী আমার মা। নিজে ডিগ্রি পায়নি, কিন্তু কঠিন অঙ্ক কষে দিয়ে, নানান তত্ত্ব মনে করিয়ে দিয়ে, বাবাকে দিয়ে পাবলিশ করিয়েছে একের পর এক পেপার।
মা নিজের কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে প্রেমের সাধনা করে গেছে, সেই রাজপুত্রের জন্য। যে কিনা আমার মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে অশ্লীল ভাবে ভেবেছে নিজের খুড়তুতো বোনের কথা। আবার বলি, হায় রে বোকা মেয়ের প্রেম।
আমার দু’টো ভাই জন্মেছিল, জানো? না, তাদেরকে আমার মত ভাসিয়ে দিতে হয়নি। তদ্দিনে তো বিয়ে হয়ে গেছে।
বাবা নিশ্চিত ছিল এই গ্রহে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আর দামী যে প্রাইজ, সেটা সে পাবেই। আমার ডিগ্রিহীন মাও বোধ হয় জানত, এই পুরস্কার, আসলেই তা কার প্রাপ্য ছিল।
তাই বাবা যখন তার সেই খুড়তুতো বোনের সঙ্গে বিছানায় মশগুল, আমার মা তখন শক্ত হৃদয়ে, পোড়া মন নিয়ে বড় করছে, তার ভালোবাসার ফসল আমার ভাই দুটিকে।
বাবা যখন ডিভোর্স চেয়ে ঘ্যান ঘ্যান করছে, মায়ের কানের কাছে, মা পরিষ্কার ভাবে বলে দিল বাবাকে – “শোনো, অনেক দিয়েছ আমাকে। আমি তো আর আমার ছোট্ট বাবু দুটোকে ছাড়তে পারব না। আমার ডিগ্রি নেই। ওই প্রাইজ তুমি জানো, আসলে কার। সম্মান? পরোয়া করি না। তুমি লোভী। সম্মান তুমি নাও। কিন্তু আমার বাচ্চাদের জন্য ওই টাকাটা আমার চাই।”
আমার বাবা(লোকটার নিজের স্বভাবের জন্য পাওয়া অশান্তির জন্য দুঃখ হয় ভাবলে) মিনমিন করে রাজি হয়েছে। তার যে তখন ওই খুড়তুতো দিদির সঙ্গে সংসার পাতার বড় তাড়া!
বাবা পুরস্কারটা পেল। ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা হল তার নাম। ডিভোর্সের শর্ত মেনে মায়ের কাছে পৌঁছুলো পুরস্কারের টাকাটা। মা কিন্তু নতুন করে কোনও সংসার পাতেনি। ঘোর দুর্ভাগ্যের তাড়া খেয়ে সারাটা জীবন ভাই দু’টোকে…
কিন্তু তাও বা পুরোটা পারল কই? বড় ভাইটা কুড়ি বছর বয়সে পাগল হয়ে গেল। ওই যাকে বলে সিজোফ্রেনিয়া। মৃত্যু অবধি অ্যাসাইলামে কাটাল বেচারা।
মা যাকে আলোয় উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিল, আলোকিত তার সেই যৌবনের প্রেমিক তখন অন্য মহাদেশে। বিশাল ইমেজ। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে বুদ্ধি দেয়। প্রাচ্যের বিশ্বজয়ী কবির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে।
আর অনেক পরে জানা গেছিল প্রাচ্যের সেই কবি যা পেরেছিল বাবাটা তা পারেনি। কবি খাদের ধারে গিয়েও ফিরে আসতে পেরেছিল। আমার বাবা পারেনি। মোট ছয়জন মেয়ের সঙ্গে প্রমাণিত প্রেম ছিল তার।
আমার সেই প্রতারিত মা, অবধারিত অন্ধকার মেখে, তাচ্ছিল্যের শীতে মুখ গুঁজে বাহাত্তর বছর বয়সে চলে গেছে চির বিস্মৃতির দেশে। বাবা দেখতেও আসেনি।
ও হো, তোমাদের তো আমার নামটা বলাই হয়নি। আমার নাম লিসেরেল। আমাকে বোধ হয় দত্তক দেওয়া হয়েছিল। নাকি আমি মরেই গেছিলাম চার বছর বয়সে অসুখ হয়ে? কেউ জানে না।
আমার সেই দুঃখী ঠকে যাওয়া নেপথ্যবাসিনী মায়ের নাম মিলেভা। মিলেভা ম্যারিক। পৃথিবী তাকে চেনে না। চিনতে চায়ওনি।
আর আমার বাবা? তাকে তোমরা সবাই চেনো। , ফিজিক্স বইয়ের মলাটে, আরও হাজার জায়গায় তার আলোকোজ্জ্বল ঋষিপ্রতিম ছবি আর নাম তোমরা দেখেছ তো! সেই যে গো উলুকঝুলুক চুল দীপ্তচোখ এক উদাসীন মানুষ… তোমাদের আলবার্ট আইনস্টাইন।
ঋণ: আইনস্টাইন: হিজ্ লাইফ অ্যান্ড ইউনিভার্স
(লেখক: ওয়াল্টার আইজ্যাকসন)
নেপথ্যে রয়ে যায় কত নাম
ভাবিইনি দায়ী কারা!
মুছে গেছে সব আসল সেনানী
নায়ক আর নায়িকারা।
ভাগ্যবানেরা মঞ্চে পেয়েছে
পাদ-প্রদীপের আলো।
নিয়তিহীনেরা নেপথ্যে বসে
চকমকি ঝলসালো।
সেই স্ফুলিঙ্গ, আলোর কণিকা…
নিভৃত ত্যাগের কথা
বুকে বয়ে নিয়ে সামনে এগোয়
মানুষের সভ্যতা।