যুদ্ধ কখনোই আনন্দের নয়, উল্লাসের নয়, এমনকি গর্বেরও নয়, যদিও সাম্রাজ্যবাদী থেকে শুরু করে উগ্র জাতীয়তাবাদী, সেক্টারিয়ান বিচ্ছিন্নতাবাদী, স্বৈরশাসক বা নিপীড়নবিরোধী বিপ্লবী… সকলেই নানাভাবে যুদ্ধকে গ্লোরিফাই করে থাকেন এবং যুদ্ধজয় নিয়ে তেড়েফুঁড়ে গর্ব করেন। অন্যের যুদ্ধের নিন্দা করা এবং নিজেদেরটা নিয়ে গর্ব করার জন্য প্রয়োজনমাফিক গোলপোস্টকে সরিয়ে নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় নিয়ে যান।
আমার মতো বেকুব মানুষের কাছে যুদ্ধ সব সময়েই যন্ত্রণাদায়ক। না হলেই ভালো। অন্যের আক্রমণের মুখে বিপর্যস্ত হলে তাৎক্ষণিক আত্মরক্ষা এবং ভবিষ্যতের সুরক্ষার জন্য বিশেষ প্রয়োজনে খানিক শক্তিপ্রয়োগ বা লিমিটেড ওয়ারফেয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যবহার করার মুহূর্তেও কাজটিকে “necessary evil” ভেবেই করা উচিত, গর্বের সঙ্গে নয়। যুদ্ধ গর্বের বিষয় হয়ে উঠলে মানসিকতার মধ্যে হিংস্রতা প্রবেশ করে এবং যুদ্ধকেই সব প্রশ্নের উত্তর মনে হতে শুরু করে। তাতে পৃথিবী সার্বিকভাবে অন্ধকার দিকে যায়।
সেইজন্যই সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে ভারতের সামরিক অপারেশন নিয়ে আমি কোনো গর্বের গাথা লিখিনি। আগেও বলেছি, মুম্বাই থেকে পহেলগাঁও লাগাতার হামলার পরিস্থিতিতে ভারত যা করবে (তখনও করেনি), আমি তাকে ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে নয়, ‘প্রতিরোধ’ হিসেবে দেখছি এবং সেই নীতি অনুসারেই কার্যক্রম ঠিক হলে খুশি হব। কিছুই না করে চুপ করে বসে থেকে দুনিয়ার কাছ থেকে সিম্প্যাথি আর সমালোচকের কাছ থেকে ‘গুড বয়’ তকমা আদায় করার পরিস্থিতি যে আর নেই, তা স্পষ্ট ছিল। কষ্টের দিনে সমবেত বা ভালোমানুষীর জন্য প্রশংসা/ শ্রদ্ধা, কোনোটাই আজকের দিনে পাওয়া যায় না, তাই সেগুলো পাওয়ার চেষ্টাও পদ্ধতি হিসেবে অচল হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় ৭ মে গভীর রাতের সামরিক অভিযান নিয়ে আমার শান্তির জায়গা এটাই যে ভারত পাকিস্তান দখলের বা বড় মাপের প্রতিশোধমূলক ধ্বংসলীলা চালানোর পথে না হেঁটে, হাসপাতাল-বাজার ইত্যাদিতে বো মা না ফেলে গোয়েন্দাসূত্রে প্রাপ্ত জঙ্গি ঠিকানাগুলোকেই নিশানা করেছে, অন্তত করার চেষ্টা করেছে। একজনও নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু না হলে সবচেয়ে ভালো হত কিন্তু জানা গেল তিন-চারজন অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং নারীর মৃত্যু হয়েছে, যেমন মৌলানা মাসুদ আজহারের স্ত্রী এবং আত্মীয়া। মাসুদ আজহারের ঘাঁটি ধ্বংস করতে গিয়ে এঁদের মৃত্যু হয়েছে। মাসুদ সাহেব নিজে অন্যত্র গা ঢাকা দিয়ে নিরাপদে আছেন কিন্তু পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নেবার প্রয়োজন বোধ করেননি, যেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। মাসুদ সাহেবকে দুনিয়া বোধহয় খুব মানবদরদী নিরীহ ব্যক্তি হিসেবে চেনে না, তবু তাঁর অপরাধে তাঁর পরিবারের নারী বা শিশুর মৃত্যুতে আলাদাভাবে উল্লসিত হবার কারণ নেই, যদি না তাঁরা নিজেরা সন্ত্রাসী হন। যুদ্ধে জেতার পর শত্রুপক্ষের নিহতদের এবং ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজে’ মৃতদের জন্য টুপি খুলে বা মাথা নিচু করে শোক পালন করা সভ্যজগতের রেওয়াজ, মৃতদের চিরশান্তি কামনা করা আমাদের পরম্পরা। সেটাই করছি৷ ডিস্কো ডান্সার ময়ূখ বা তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৃত্য করার উৎসাহ পাচ্ছি না।
সৌভাগ্যের কথা, খুবই অল্প কয়েকজন বিবেকহীনকে দেখলাম, যাঁরা কোল্যাটেরাল ড্যামেজে নারী-নাবালিকার মৃত্যুতে “ঠিক হয়েছে” জাতীয় কথা বলেছে। বাকি যে অগুনতি মানুষ সেনা অভিযানকে ন্যায্য বলছেন, বিচার বা প্রতিশোধ কিছু একটা পেয়ে খুশি, জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস হল ভেবে নিশ্চিন্ত, এমনকি যুদ্ধজয়ে উল্লসিত, তাঁরা অন্তত শিশুমৃত্যু বা নারীনিধন নিয়ে উল্লাস করছেন না। বেশিরভাগ চুপ থাকছেন এই বিষয়ে। যাঁরা এই পরিস্থিতিতে শান্তির কথা, যুদ্ধের অসারতার কথা শোনাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রইল। ওই কথাগুলো মানুষকে মনে করানো প্রয়োজন।
ভারতের সামরিক প্রত্যাঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও বিবেকের কথা শুনিয়েছেন অনেকে। তাঁরাও সংখ্যায় নেহাৎ কম নন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের বিবেক জেনুইন, আবার কয়েকজনের বিবেক একান্তই রাজনৈতিক (বৃহৎ অর্থে নয়, সংকীর্ণ অর্থে) মনে হল। এঁদের একটা অংশকে বাইশে এপ্রিলের ঘটনার নিন্দা করতে বা শোকজ্ঞাপন করতে দেখিনি, যেন সেই হ ত্যায় মানুষের মৃত্যু হয়নি। অনেকে বালাকোটের পর “বডি কই?” বলে তুমুল চিৎকার জুড়েছিলেন। কেন? সত্যিই মানুষ না মেরে শুধু ঘাঁটি ভেঙে ভয় দেখিয়ে এসেছে, এটা সত্যি হলে আমি তো ভাই খুশিই হতাম। গত কয়েকদিনেও “কিছুই তো করছে না, আগেরবার কাক মেরেছিল” বলে রীতিমত যুদ্ধের উসকানি দিচ্ছিলেন। তারপর হঠাৎ এমন ধরনের বিবেকের বাণী, যার মূল প্রতিপাদ্য হল “ভারত আগ্রাসী, পাকিস্তান নিরীহ।” এই বাণীর ভিত্তি এটা ধরে নেওয়া যে ভারত সব মিথ্যা বলছে এবং পাকিস্তান সব সত্যি বলছে। এই অসামান্য সারল্যে আমি বিস্মিত।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কাশ্মীরের অসামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর নিরন্তর মর্টার শেলিং করে চলেছে, অন্তত পনেরোজন নিরীহ কাশ্মীরী এবং শিখ মানুষকে হত্যা করেছে, সম্ভবত ষাট জনকে আহত করেছে। এগুলোও হত্যা, ভায়োলেন্স। এগুলোও যুদ্ধ বিরোধী বিবেক জাগানোর মতো। তাই না? হ্যাঁ, এই ভারতীয় মানুষদের বাঁচাতে না পারা ভারতীয় প্রতিরক্ষার একটা ব্যর্থতা কিন্তু নিরীহ মানুষদের টার্গেট করে হত্যা করাও ঘৃণ্য নয় কি? “এসব মানুষের মৃত্যুর দায় কার?” বলে ৭ মে রাতের অপারেশনকেই এর কারণ সাব্যস্ত করে এই হত্যাগুলোকে জাস্টিফাই করার চেষ্টাও দেখলাম আজ সকালে। দেখে অবাক হলাম কারণ এই ব্যক্তিবর্গ এই একই যুক্তি প্রয়োগ করে পহেলগাঁও হত্যাকে কারণ হিসেবে ধরে ভারতের মিসাইল প্রয়োগকে জাস্টিফাই করছিলেন না গতকাল, যেটা করছিলেন ঠিক তাঁদের বিপরীত শিবিরের মানুষেরা।
মনুষ্যত্বহীনতা, ঘৃণার আতিশয্য ইত্যাদি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আজকাল, কিন্তু বিবেকের বিচিত্র ক্যামোফ্লাজ দেখলে সব গুলিয়ে যায়। পৃথিবীর বড় খারাপ সময় এখন। এখন প্রয়োজন প্রকৃত বিবেক, হিংসার বিরুদ্ধে প্রকৃত প্রতিরোধ। সিলেক্টিভ বিবেক বা বিবেকের ছদ্মবেশ খুব কাজের জিনিস নয়।