প্রথম অ্যাঙ্গলো-শিখ যুদ্ধে পরাজয়ের পর লাহোর দরবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয় দেড় কোটি টাকা। ৫০ লক্ষ টাকা দিতে পারলেও বাকিটা আর দিতে পারবে না, জানিয়ে দেয় মহারাজা রঞ্জিত সিংএর উত্তরাধিকারীরা। পরিবর্তে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি দখল করে সিন্ধু থেকে বিয়াস ও শতদ্রু পর্যন্ত শিখসাম্রাজ্যের বিরাট অঞ্চল, তার একটা বড় অংশ মূলতঃ কাশ্মীর উপত্যকা তাদের কাছ থেকে ‘কিনে নেয়’ ডোগরা বংশীয় রাজপুত গুলাব সিং ৭৫ লক্ষ নানকশাহী টাকায় ১৮৪৬ সালে। ইতিহাসে নগদে রাজত্ব ক্রয়ের যে কয়টি নজির আছে, এই ঘটনা তার একটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ নিশ্চিতভাবে।এই গুলাব সিংকেই ১৮২২ সালে মহারাজা রঞ্জিত সিং স্বহস্তে তিলক পড়িয়ে তাকে রাজা উপাধি দান করেন জম্মুর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ; গুলাব ছিলেন রঞ্জিত সিংএর প্রচণ্ড প্রিয়পাত্র। এক সাধারণ সৈনিক থেকে গুলাব সিং অধিপতি হয় বিরাট এলাকার। বৃটিশ তাকে ‘স্বাধীন রাজা’র স্বীকৃতি দেয়। চুক্তি অনুযায়ী বছরে একটি ঘোড়া, ছ জোড়া উত্তম প্রজাতির পশম ছাগল ও তিন জোড়া উৎকৃষ্ট পশমের শাল বৃটিশকে দিতে হবে। ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত রাজ্যে কোনো বৃটিশ রেসিডেন্ট অফিসারও ছিল না।
কাশ্মীর প্রাপ্তির আগেই তার রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয় বালতিস্তান, গিলগিট, লাদাখ অঞ্চল,সৌজন্যে ডোগরা সেনাপতি জোরোওয়ার সিং কাহলুরিয়া। ১৮৩৪ থেকে ১৮৪১ সালে তার বাহিনী নজিরবিহীন অভিযানে এই জায়গাগুলো জয় করে, মানস সরোবর পেরিয়ে মধ্য তিব্বতে পৌঁছে যান। তার মৃত্যুর পরে দেওয়ান হরি চাঁদ ও ওয়াজির রতনু গিয়ে তিব্বতে সংঘর্ষের অবসান ঘটান। ১৮৪২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর চোদ্দ হাজার ফিট উচ্চতায় চুসুল গ্রামে তিব্বতী শাসকদের(তৎকালীন Qing বংশীয় চীনসম্রাটের প্রতিনিধি) ও ডোগরা-শিখ রাজত্বের প্রতিনিধির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।লাদাখ শিখ-ডোগরা শাসকদের হস্তগত হয়।বাস্তবিক ক্ষেত্রে ডোগরা শাসকের হাত ধরেই লাদাখের ভারতে প্রবেশ।
ব্যবসা বাণিজ্য, বৌদ্ধ্ধর্ম ও সংস্কৃতির কারণে কাশ্মীর ও উত্তর ভারতের সঙ্গে সংযোগ থাকলেও এর আগে লাদাখে কোনো ভারতীয় শাসকের হস্তক্ষেপ সম্ভবতঃ ঘটেনি। বরং, এক লাদাখি বৌদ্ধ্ রাজকুমার( Rinchan Bhoti) দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে কাশ্মীরে আসেন ও পরে ক্ষমতা দখল করেন চতুর্দশ শতকের প্রথমে। তার আবার ইচ্ছে হয় স্থানীয় ধর্মাবলম্বনের, কাশ্মীর তথা ভারতে তখন বৌদ্ধ ধর্ম প্রায় অবলুপ্তির পথে।কিন্তু কাশ্মীরের হিন্দু সম্প্রদায়( মূলতঃ শৈব) পরিষ্কার জানিয়ে দেয় হিন্দু ধর্মে বাইরে থেকে প্রবেশ অসম্ভব। সুফি সাধক বুলবুল শাহ রাজাকে মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত করেন, কাশ্মীরে মুসলিম ধর্ম প্রাসঙ্গিকতা লাভ করে।
ভৌগলিক, ধর্মীয় ও জাতিগত কারণে ভারতীয় ভূখণ্ডের থেকে তিব্বতের সঙ্গেই লাদাখের সংযোগ অনেক বেশি বহুদিন থেকেই। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে রাজত্ব করে আসা ‘নামগিয়াল’ শাসকদের বংশগত যোগাযোগও তিব্বতের সঙ্গেই। সেই হিসাবে লাদাখের ভারতভুক্তি কিছুটা আকস্মিক বইকি ! কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে, লাদাখের সমস্ত মানুষ অতি আগ্রহের সঙ্গেই ১৯৪৭ এর পরে ভারতভুক্তিকে শুধু মেনেই নেয়না, বরং স্বাগত জানায়। তার একটা বড় কারণ অবশ্যই তিব্বতে চীনের অধিকার প্রতিষ্ঠা। ‘৬২ এর যুদ্ধে লাদাখের সাধারণ মানুষ ও স্থানীয়দের নিয়ে তৈরি মিলিশিয়া বাহিনী সর্বতোভাবে সাহায্য করে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। পরবর্তী সংঘাতের ঘটনায় বিশেষতঃ সাম্প্রতিক গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষে লাদাখের মানুষ ভীষণ আন্তরিক ভাবেই পাশে থেকেছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর। লাদাখ ও কারগিল অঞ্চলের পশুপালক nomadic tribe দের কাছেই ভারতীয় সেনাবাহিনী চিরকাল এমন অনেক তথ্য পেয়ে এসেছে, যা প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচিত হয়েছে। কাশ্মীরের ভয়ঙ্কর উত্তাল সময়েও লাদাখ চিরকাল থেকেছে শান্ত নিস্তরঙ্গ ; দেশবিরোধী ছেড়ে দিন, সাধারণ প্রতিবাদ-বিক্ষোভও ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপস্থিত।
আঞ্চলিক সমস্যাকে জটিল ও আরও সমস্যাসঙ্কুল করার কেরামতিতে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসকদের অসাধারণ ক্ষমতা আজ নয়, চিরকালেরই। কাশ্মীর, পাঞ্জাব, আসাম, উত্তর পূর্ব ভারতে তার নজির ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র, এ ব্যাপারে একের পর এক শাসক তাদের চমকপ্রদ দুর্ধর্ষ সব উদাহরণ রেখে গেছেন। আঞ্চলিক মানুষের আশা আকাঙ্খা থেকে দিল্লি চিরকালই দূর অস্ত।
কিন্তু তা বলে যেখানে কোনো সমস্যা কোনোদিনই ছিলনা, সেটাকে রীতিমতো অশান্তই করা নয়, যাতে আরও ভালো করে অশান্ত করা যায় তার সমস্ত পদ্ধতি অবলম্বনটা একটু বেশিই বেশি হয়ে গেল’ না!! দেশভক্তরা কী বলেন?! লাদাখ কিন্তু প্রতিরক্ষার দিক থেকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।
সমস্যা হয়েছে, সব জমানাতেই ঋণাত্মক কাজ করার লোক প্রচুর থাকলেও আলাপ-আলোচনা করার মানুষ অল্প হলেও কিছু ছিল’। কিন্তু এই জমানায় সেই দক্ষতার বা soft skill সম্পন্ন মানুষের বড়ই অভাব। কিছুটা হলেও যে দু একজনের আছে, তারা আবার বৃত্তের কেন্দ্রস্থল থেকে দূরের কক্ষে ক্রমঅবসারিত।
বোঝা যাচ্ছে সব কিছুই এক বিশেষ লক্ষ্যের দিকে ধাবিত, আর সেটা হলো লাদাখের ভূখণ্ডের সর্বাধিক ব্যবহার, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে!! অবশ্যই জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজে নয়। ষষ্ঠ সিডিউল হলেই কী তা পুরোপুরি আটকে যেতো? নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু পদ্ধতি এতো সহজ হতো না, অনেক কাষ্ঠখণ্ড বা বিচালি জোগাড় করিয়া তাহাতে অগ্নিসংযোগের মতো কঠিন কাজ সম্পন্ন করতে হতে পারতো !
একটা প্রশংসা করতেই হয়, আমাদের শাসকরা তাদের মূল স্পনসরদের উপকার সদাসর্বদা মনে রাখেন। বস্ততঃ শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই এখন শাসকরা তাদের স্পনসরদের স্বার্থ বজায় রাখতে অতিমাত্রায় তৎপর।Capitalism in general বা monopoly capitalism নয়, এ যুগটা সম্ভবতঃ crony capitalism এর বিশাল উত্থানের যুগ। কী আর করা যাবে?! কিছু করার নেই। শুধু দেশপ্রেমিক জনগণের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, দয়া করে প্রশ্ন করুন, লাদাখের মতো ভীষণ সংবেদনশীল জায়গায় যে ধরণের অসংবেদনশীল কার্যকলাপ চলছে, তা কি জাতীয় স্বার্থের অনুকুল না মারাত্মক ভাবে প্রতিকুল ?! ঝুঁকিটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে না ?? কাউকে ‘ভিলেন’ বানানো এমন কিছু ব্যাপার নয়, বিশেষতঃ আজকের জমানায়। তাতে করে নিজেদের দোষক্ষালন হয়তো হতে পারে, কিন্তু সমাধান?? তা কি আরও অধরা, অপসৃয়মান হয়ে যাচ্ছে না??
একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, চীন কেন সব শক্তিধর রাষ্ট্রেরই কোনো বন্ধুরাষ্ট্র হয়না। বন্ধু নয় তারা তাঁবেদারকেই পছন্দ করে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি যাই ঘটুক, লাদাখ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সেখানকার মানুষকে বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ করা কি সবিশেষ সমীচীন কাজ হচ্ছে? সর্বত্র একই কৌশল চালালে কি করে হবে?!!
জানি,প্রশ্ন করে কোনো লাভ নেই। কিন্তু তা ছাড়া করণীয়ই বা কী, সেটাই জানি না……….!!!!