কোভিড-১৯ অন্যান্য সঙ্কটের সাথে সাথে জন স্বাস্থ্যকেও এক বড় সঙ্কটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই সঙ্কট শুধু আমাদের দেশেই না, এর ব্যাপ্তি পৃথিবী জুড়ে। সব দেশের মত আমাদের দেশেও স্তব্ধ হয়ে গেছে রুটিন ইমুউনাইজেশান প্রোগ্রাম।
বন্ধ করতে হয়েছে নিতান্ত নিরুপায় হয়েই। সাধারণ ভাবে একজন শিশু যখন ভ্যাকসিন নিতে যায়, সঙ্গে থাকে বাড়ির একাধিক মানুষ। ভ্যাকসিন দেবার সময় সাহায্যের দরকার হয় একাধিক স্বাস্থ্যকর্মীর। এই পুরো কর্মকাণ্ড কখনোই “সোশাল ডিস্টান্সিং” মেনে করা সম্ভব না। আর “সোশাল ডিস্টান্সিং”ই তো করোনা প্রতিরোধের মূল মন্ত্র। তাই বাধ্য হয়েই বন্ধ রাখতে হলো সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে হওয়া সমস্ত রকম ভ্যাকসিনেশন।
গত 26 শে মার্চ ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) এক বুলেটিন প্রকাশ করে জানালেন তাদের উদ্বেগের কথা। তাদের আশঙ্কা পৃথিবীব্যাপী ভ্যাকসিন প্রিভেন্টেবল রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব আগামী দিনে মানবসভ্যতাকে গ্রাস না করে বসে। একটা সময় হয়তো করোনার আগ্রাসন থেকে পৃথিবী মুক্তি পাবে কিন্তু তখন হাম, হুপিং কাফ, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, মেনিনজাইটিস, ফ্লুর মত মারণ রোগগুলোর কাছে মানব সভ্যতা কে আবার না মাথা নত করতে হয়।
একজন শিশু প্রথম তার হামের ভ্যাকসিনটি নেয় নয় মাস বয়সে। এই সময় এই ভ্যাকসিনটা দেওয়ার কারণ, মায়ের শরীর থেকে পাওয়া হামের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া আন্টিবডিগুলো এইসময় একদম কমে যায়। তাই এই সময় বাইরে থেকে ভ্যাকসিন না দিলে বাচ্চাটির হামে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই থেকে যায়। এখন এই সোশাল ডিস্টান্সিং-এর ফলে যদি ভ্যাকসিনগুলো ঠিক টাইমে না দেওয়া যায়, তাহলে বেশ কিছু দিনের মধ্যেই কিন্তু আমরা অনেক হামের রোগী দেখতে পাব আমাদের চার পাশে। আর এই হাম রোগটি শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে একদম তলানিতে এনে হাজির করে। প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে তার করোনাায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কিন্তু অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে। ছোটদের সাথে সাথে বৃদ্ধ মানুষদের এবং গর্ভবতী মহিলাদের যে ভ্যাকসিন এই মরশুমে দেওয়া ভীষণ জরুরী সেটা হল ফ্লু ভ্যাকসিন। কারণ এদের সবারই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে জটিলতা তৈরির সম্ভাবনা বেশ বেশি। করোনার রোগ লক্ষণ অনেকটাই ফ্লুর মতো। এবং ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা পৃথিবীব্যাপী খুব একটা কম না। সম্প্রতি আমেরিকার এক সংস্থা CDC র দেওয়া তথ্য অনুসারে ঐ দেশে গত বছর অক্টোবর মাসের ১লা থেকে এই বছর ২০ মার্চ প্রায় গত ছ মাসের মধ্যে ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৩৪-৫৪ লক্ষ মানুষ ,আর এই রোগে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২৪-৬২ হাজারের। এমন রোগের যদি ভ্যাকসিন না দেওয়া যায় তবে তা এই মৃত্যু মিছিলকে আরও দীর্ঘায়িত করবে।
বেশিরভাগ ভ্যাকসিন তৈরি হয় বিদেশি কোম্পানিগুলোতে। লকডাউনের ফলে অন্য দেশের সঙ্গে এবং নিজের দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গেও এখন যোগাযোগ করা খুব মুশকিল। কমে গেছে ভ্যাকসিনের উৎপাদনও। ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার বেশ কিছুদিন পর পর্যন্ত ভ্যাকসিন যোগানের অপ্রতুলতার জন্য আরো কিছু দিন হয়ত থমকে যেতে পারে ওই প্রকল্প।
আমাদের দেশের প্রত্যেক শিশুকে ভ্যাকসিনেশন দেওয়া হয় নির্দিষ্ট নির্ঘণ্ট মেনে। সরকারি ব্যবস্থায় দেওয়া হয় ইউনিভার্সাল ইমুনাইজেশন প্রোগ্রাম (UIP)-এর নির্ঘণ্ট মেনে। বেসরকারিভাবে শিশু চিকিৎসকরা সাধারণত দেন ইন্ডিয়ান অ্যাক্যাডেমি অফ পেডিয়াট্রি্ক্স (IAP) এর নির্ধারিত নির্ঘণ্ট অনুযায়ী। কিন্তু এক -দু মাসের একটা গ্যাপ তৈরি হয়ে গেলে এই নির্ঘণ্ট যাবে তালগোল পাকিযে। পরের ভ্যাকসিনগুলো দেওয়াতেও মুশকিলে পড়তে হবে স্বাস্থ্যকর্মীদের। আর বাকি পড়ে যাওয়া ভ্যাকসিনগুলো কিভাবে দেওয়া হবে সেই নিয়েও আছে যথেষ্ট সংশয়। WHO অবশ্য বলছে এই ভ্যাকসিন গুলো “ক্যাচ আপ”ভ্যাকসিন সিডিউল নামের বিশেষ এক নির্ঘণ্ট অনুযায়ী দিতে।
এমন এক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাদের সাথে সাথে WHOও দিশাহারা হয়ে সমাধান ভাবতে বলেছেন জাতীয় স্তরের এজেন্সিগুলোকে। এমন এক ব্যবস্থা করা হোক যাতে সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙ্গে। এও বলা হয়েছে যদি কেউ ভ্যাকসিন প্রিভেন্টাবল রোগে আক্রান্ত হন, যত দ্রুত সম্ভব তাকে যেন চিন্হিত করা ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এমন এক শাঁখের করাতের মত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, শুধুই করোনার বিদায় প্রহর গোনা ছাড়া মনে হয় আমাদের আর কোন গত্যন্তর নেই।