তমাল গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বের করল। এটা মাহীন্দ্রা এক্স ইউ ভি। বেশ বড়। এটা নিয়েই বেরোবে। বাড়িতে আর একটা গাড়ি আছে, চন্দ্রার আই টেন। কিন্তু ওটা ছোট, ওতে হবে না। তমাল আর চন্দ্রার এখনো ছেলেমেয়ে হয় নি। ঝাড়া হাত-পা। তমাল কাজ করে এয়ারটেলে। চন্দ্রা ‘হোপ ফাউন্ডেশন’ নামে একটা এনজিও-তে যুক্ত আছে। ওরা পথশিশুদের শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির বন্দোবস্ত করে। প্রতিবন্ধী শিশুদের সাহায্য করে। তমালরা হৌজ খাসে থাকে। তমালের অফিস নেহেরু প্লেসে।
চন্দ্রা প্যাকেটগুলো গাড়িতে তুলতে লাগলো। মোট ২০০ টা। তেজিন্দার আর রবীনবাবু ওদের গাড়িতেও ২০০ টা করে প্যাকেট নেবে। তেজিন্দার আর ওর গিন্নি মিনাল একটা রেস্তরাঁ চালায়। এই কমপ্লেক্সেই থাকে। খাবারের প্যাকেটগুলো ওরাই তৈরি করেছে। রবীনবাবু ব্যাচেলর। পাতিয়ালা কোর্টে প্র্যাকটিস করেন।
‘সত্ শ্রী অকাল’, ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনি দিয়ে ওরা গাড়ি ছাড়লো। লক-ডাউন চলছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ। সাধারণ গাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। ওদের স্পেশাল পারমিশন আছে। যোগাড় করেছেন রবীনবাবু। সেটা দেখাতেই মাস্ক পরা পুলিশ ‘নমস্তে’ বলে ছেড়ে দিল। বিশেষ মিশনে যাচ্ছে ওরা। তিনটে গাড়ির সামনেই ‘হোপ ফাউন্ডেশন’ লেখা।
‘ওয়ার্ষ্ট হিউম্যানিটারিয়ান ক্রাইসিস’ চন্দ্রা বলল।
‘চরম বিপর্যয়।’
আসলে গতকাল টিভি দেখেই সবার আক্কেল গুড়ুম। হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরবে বলে আনন্দ বিহার ষ্টেশনে ভীড় করেছে। গাড়ী না পেয়ে আরো হাজারে হাজারে রাস্তায় হেঁটে চলেছে। বাড়ি কারো বরেলী, কারো জৌনপুর, কারো বেতিয়া, কারো গয়া। এরা দিনমজুর, কন্ট্রাক্টরের ফাঁদে পড়ে কাজ করে নয়দা, গুরগাঁও, ফরিদাবাদের নির্মীয়মান হাইরাইজে, নয়তো কোনো কারখানায় ক্যাজুয়াল লেবার হিসেবে। এদের ঘরবাড়ি নেই। থাকে নির্মাণ লাগোয়া টিনের শেডে, নয়তো তাঁবুতে। লক-ডাউনের জেরে এদের দিশেহারা দশা। বাড়ি ফিরলে গ্রামে হয়তো খাওয়া জুটতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেক্ষেত্রে গ্রামে-গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে ভাইরাস। গ্রামে কে গিয়ে দেখবে চোদ্দ দিনের কোয়ারান্টাইন এরা মানছে কিনা!
‘বেশিরভাগই মানবে। আমার মছলন্দপুরের গ্রামে বাড়ি। আমি জানি। না মানলে গ্রামের লোকেরা মানতে বাধ্য করবে।’ রবীনবাবু বললেন।
‘আপনে ঠিক কহা। টিভি মে দিখা রহা হ্যায়, গাঁও মে এক বান্দা চেন্নাই সে আ’কে পেড় মে চড়কে আপনে আপকো কোয়ারান্টাইন কিয়া।’ মিনাল বলল।
চন্দ্রা বলল,’ঠিক। পুরুলিয়ার ঘটনা। এরা তথাকথিত লেখাপড়া জানা মূর্খদের থেকে অনেক বেশী সচেতন।’
‘কিন্তু গত পরশুই তো স্কুল গুলোতে সরকার থেকে ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। তারপর কি যে এমন হল! শ’য়ে শ’য়ে কিলোমিটার পায়ে হেঁটে এরা কি করে পৌঁছবে কে জানে। যা গরম!’
রবীনবাবু বললেন,’রহস্যজনক। কেউ সংগঠিত ভাবে প্যানিক ছড়িয়েছে বলে মনে হয়। ইন্টারন্যাশনাল নিউজে পর্যন্ত দেখাচ্ছে।’
যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে তাপ্পল-এর কাছাকাছি রাস্তার ধারে একটা শেড দেখে ওরা এখানেই ঘাঁটি গেড়েছে। কি গরম! শেডের নীচেই চাঁদি ফেটে যাচ্ছে। এই রোদে দলে দলে নারী-পুরুষ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হেঁটে চলেছে। ওরা পরিবারপিছু একটা করে খাবারের প্যাকেট দিতে চেষ্টা করল। সঙ্গে পঞ্চাশটা টাকা। সিন্ধুতে বিন্দু। তবে ওরা কয়েকজন আর কত করতে পারে! অবশ্য আরো কিছু স্বেচ্ছাসেবী খাবার দিচ্ছে।
‘সরকারের তরফ থেকে কিছু করা উচিত।’ চন্দ্রা বলল।
‘সরকার হাত তুলে দিয়েছে।’
‘খানা খায়া?’ তেজিন্দার একজনকে প্যাকেট দিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
‘দো দিন সে কুছ নেহি খায়া বাবুজি।’
‘পানি হ্যায় সাথ মে?’
‘নহী হ্যায় মা জি।’
এই রে! জল তো আনে নি সঙ্গে। গাড়িতে আর জায়গা ছিল না।
রবীনবাবু সমাধান করলেন। ‘আমার গাড়িতে আছে।’ শ’খানেক ছোট জলের বোতল উনি নিজ উদ্যোগে তুলে নিয়েছিলেন। রবীনবাবু বরাবরের মুশকিল আসান।
‘আল্লাহ্ রহমত।’ জলের বোতল নিয়ে লোকটা বলল।
‘কিতনা দূর তক যাওগে?’ আর একজকে জিজ্ঞাসা করল তেজিন্দার।
‘গয়া’
‘বহুত দূর হ্যায় তো। পয়দল যা পাওগে?’
‘দেখেঙ্গে। বিচমে কুছ মিল যায়ে তো।’
‘পয়সা হ্যায় জেব মে?’
‘নহী বাবুজী।’
‘তংখা নহী মিলা?’
‘সর্দার আকে বাতায়া, বিমারী ফ্যাল রহা হ্যায়, ফরন ঘর চলে যাও। তংখা বাদ মে মিলেগা। ভাগা দিয়া হামলোগোকো।’
রবীনবাবু সব শুনে নিজের পকেট থেকে আরো পঞ্চাশ টাকা দিলেন।
‘ভগবান আপকা ভালা করে। রামজী কি কসম।’
কেউ কেউ খাবারের প্যাকেট পেয়েও নিল না। ‘মুঝে নহী চাহিয়ে মা-জী। পেহলে এক বাবুজী সে এক প্যাকেট মিলা, উও খা চুকা।’ কারো কারো এতটাই দায়িত্ববোধ!
বাড়ি ফিরলে ভাইরাস ছড়াবে। কেউ কেউ মারা যাবে। এদের থেকে বাড়ির বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মরবে। প্রতিবেশীরাও। আর না ফিরতে পারলে, না খেতে পেয়ে মরবে। শুধু উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তরাই কি দেশের নাগরিক? এরা, যারা ভারতবর্ষকে নির্মাণ করছে, দেশের মানুষের মুখে ভাত তুলে দিচ্ছে, এরা দেশের নাগরিক নয়? রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্ব নেই এদের প্রতি? ঘেণ্ণা ধরে যায়!
গাড়ি চালাচ্ছে চন্দ্রা। ফিরতে ফিরতে তমাল মোবাইলে নিউজ দেখে, উত্তরপ্রদেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর জল ও ব্লিচিং পাউডার স্প্রে করা হয়েছে।