জাম্পকাট ১:
দিল্লির লেডি হার্ডিঙ্গ মেডিকেল কলেজ। শ্বাসকষ্ট নিয়ে ১০ মাসের একরত্তি শিশুটি ভর্তি হল পেড্রিয়াটিক আই সি ইউ-তে। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে জান লড়িয়ে দিলেন ৬ নার্স। পরে জানা গেল, শিশুটি কোভিড-১৯ পজিটিভ। সাথে ঐ ৬ নার্সেরও পরীক্ষা হল। সকলেই পজিটিভ। তবুও, তাঁদের মুখের হাসি অমলিন। লড়াই সার্থক! বাচ্চাটির অবস্থা যে অনেকটাই স্থিতিশীল।
জাম্পকাট ২:
মেডিকেল কলেজ হস্টেলে এই নিয়ে একটানা ৩৫ দিন হতে চললো টুম্পার। ২ বছরের শিশুপুত্রকে স্বামী আর শাশুড়ির ভরসায় রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে একাকিনী তিনি।
টুম্পা সাহা আর জি কর হাসপাতালের নার্স। ৮ বছরের চাকরি জীবনে এমন দুর্যোগ আগে দেখেন নি। করোনা-ওয়ার্ডে হাসিমুখে রোটেশানাল শিফটে ডিউটি করে যাচ্ছেন অক্লান্ত ভাবে। লকডাউনের আগে সেই যে বাড়ি ছেড়েছেন, জানেন না আবার কবে দেখতে পাবেন নিজের সন্তানের মুখটি।
সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা এই লক্ষ কোটি টুম্পাদের অনুপ্রেরণার উৎসে যিনি, সেই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের ২০০ তম জন্মবার্ষিকী গেল গত ১২ই মে।
১৮২০ সালের ১২ মে ইতালির ফ্লোরেন্সের এক অভিজাত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্রিটিশ পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। ফ্লোরেন্স শহরে জন্মগ্রহণ করায় তাঁর নাম রাখা হয় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। ফ্লোরেন্সের জন্মের এক বছর পরই তাঁর বাবা উইলিয়াম এডওয়ার্ড নাইটিঙ্গেল সপরিবারে ফিরে আসেন ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ারে।
অল্প বয়েসে বাবার সান্নিধ্যের কারণেই নানা বিদ্যা অর্জন করতে পেরেছিলেন ফ্লোরেন্স। মনে রাখা দরকার, সেই সময়ে গোটা ইউরোপেই নারীশিক্ষার চল ছিল না তেমন। কিন্তু, তাঁর বাবা উইলিয়াম বিশ্বাস করতেন, মেয়েদেরও শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত। তিনি ফ্লোরেন্স ও তাঁর বোনকে বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস ও দর্শন সহ নানা বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন।
১৭ বছর বয়সে তিনি ডার্বিশায়ার থেকে লন্ডনে আসেন। সেই সময়ে লন্ডনের হাসপাতালগুলোর অবস্থা ছিল খুবই করুণ।সে সময়ে সেবিকার পেশাকে সামাজিক ভাবে মর্য়াদা দেওয়া হত না। অথচ সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন মানুষের সেবায়। বাবা-মায়ের অমতে গিয়ে ১৮৫১ সালে নার্সের প্রশিক্ষণ নিতে জার্মানিতে পাড়ি দেন।
এরপর, ১৮৫৩ -এর অক্টোবরে শুরু হয় ক্রিমিয়ার যুদ্ধ। সে যুদ্ধে প্রতিদিন আহত হতো হাজারে হাজারে সৈনিক। ১৮৫৪ সালে ফ্লোরেন্স দলবল নিয়ে পৌঁছে যান ক্রিমিয়ার সেনা হাসপাতালে। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখতে পেলেন, কলেরা ও টাইফয়েডের মত রোগ হাসপাতালগুলিতে চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছেছে। চতুর্দিকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। না আছে রোগীর হিসেব, না আছে মৃত্যুর কোনও পরিসংখ্যান।
নাইটিঙ্গেল তাঁর নিজস্ব পরিসংখ্যান সংগ্রহ করেন, মৃত্যুর হার হিসেব করেন এবং দেখান যে চিকিৎসার পরিবেশের উন্নতি ঘটালে মৃত্যুর হার কমবে। উনিশ শতকের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থায় যখন ‘স্যানিটাইজেশন’, ‘ডিসইনফেক্ট’ শব্দগুলোর সাথে ন্যূনতম পরিচয়ও ছিল না কারো, সেখানে অল্প সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র হাতধোয়া আর চিকিৎসাকর্মী ও রোগীর পরিচ্ছন্নতা সুনিশ্চিত করেই তিনি মৃত্যুহার ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে নিয়ে আসেন ২.২ শতাংশে। যে স্বাস্থ্যবিধি আজকের পৃথিবীতেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ ভাবেই তিনি প্রাণঘাতী সংক্রমণ থেকে উদ্ধার করেন হাজার হাজার আহত সৈনিককে। আর্তের সেবায় নিবেদিতপ্রাণা ফ্লোরেন্স রাতের অন্ধকারে লন্ঠন হাতে অসুস্থ সৈনিকদের পর্যবেক্ষণে বেরোতেন। যে কারণে, সারা বিশ্ব তাঁকে চিনলো ‘লেডি উইথ দি ল্যাম্প’ নামে। সেবার মাধ্যমে নার্সিংকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন।
তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে গ্রাফিক্স তৈরি করেন, যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হল পোলার এরিয়া ডায়াগ্রাম, যা থেকে মৃত্যুহারের বিভিন্নতা বোঝা যায়। সেখানে দেখা গেলো, যুদ্ধের পরবর্তীতে হাসপাতালে ইনফেকশনের কারণে মৃত্যুহার যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুহারের তুলনায় অনেক বেশি। ‘Florence Nightingale: Avenging Angel ‘ গ্রন্থের রচয়িতা হাগ স্মল তাঁর পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণের দুটি ধাপ বর্ণনা করেছেন–“প্রথমত, এতে দেখা গিয়েছিল বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যুহারে ব্যাপক ফারাক রয়েছে, ফলে মৃত্যুর কারণ হাসপাতালের স্থানীয় নির্দিষ্টতা। দ্বিতীয়ত, এতে দেখানো হয়েছিল একটি হাসপাতালের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটালে সেখানে মৃত্যুহার কমছে, ফলে, ওই স্থানীয় নির্দিষ্টতা হল হাসপাতালের স্বাস্থ্যব্যবস্থা।”
বর্তমান পৃথিবীতেও যার প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম। স্মল বলছেন “কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে প্রথম ধাপটা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশে মৃত্যুহারে ব্যাপক ফারাক রয়েছে এবং পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ দেখাতে পারবে যে কোন দেশ ভাল করেছে এবং কোন দেশ কী ভুল করেছে।”
যুদ্ধের পর ফ্লোরেন্স বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৮৫৫ সালে নার্স প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮৫৯ সালে তিনি ‘নাইটিঙ্গেল ফান্ড’- এর জন্য সংগ্রহ করেন প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড। লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং’। ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সঙ্গে যৌথভাবে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’। ১৮৮৩ সালে রানী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদকে ভূষিত করেন। প্রথম নারী হিসেবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব লাভ করেন ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে লাভ করেন লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি।
১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে লন্ডনে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফ্লোরেন্স।
এখনও যাঁরা এ পেশায় নতুন আসেন, তাঁরা ‘নাইটিঙ্গেল প্লেজ’ নামে একটি শপথ গ্রহণ করে তাঁর প্রতি সম্মান জানান। ১৯৭৪ সাল থেকে তাঁর জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’ হিসেবে।
লন্ডনের সেন্ট থমাস হসপিটালে রয়েছে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মিউজিয়াম। ব্রিটিশ লাইব্রেরি সাউন্ড আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে তাঁর কণ্ঠস্বর, যেখানে তিনি বলেছেন-“যখন আমি থাকব না, সেই সময় আমার এই কণ্ঠস্বর আমার মহান কীর্তিগুলোকে মানুষের কাছে মনে করিয়ে দেবে এবং এসব কাজের জন্য উৎসাহ জোগাবে।” তাঁর জীবন নিয়ে অনেকগুলি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল তাঁর কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এক অমর সত্য– নার্সিং একটি পেশা নয় বরং সেবা। অভিজাত পরিবারের সন্তান হয়েও বিলাস ও আরাম ছেড়ে তিনি আর্তের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন সারাটি জীবন। ১৮৫৯ সালে নার্সিংয়ের ওপর লেখা তাঁর বই ‘নোটস অন নার্সিং’ বিজ্ঞান সম্মত স্বাস্থ্য-সেবার দিশারি।
ঘটনাচক্রে আজ যখন গোটা পৃথিবীটাই জর্জরিত এক অভূতপূর্ব মহামারীতে, তখন তাঁর দ্বিশততম জন্মদিন। এই অতিমারীর জেরে তাঁর জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান বাতিল হতে বসেছে। ‘হু’ (W.H.O) এই ২০২০ সালকে ‘আন্তর্জাতিক নার্স ও ধাত্রীবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। লন্ডনের ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মিউজিয়মের ডিরেক্টর ডেভিড গ্রিন জানিয়েছেন যে, ২০২০ সাল জুড়ে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মিউজিয়ম বন্ধ হয়ে গিয়েছে ১৭ মার্চ। ফ্লোরেন্সকে শ্রদ্ধা জানাবার সুযোগটুকুও কেড়ে নিচ্ছে মহামারী।
কিন্তু না! তাঁর মত মানুষের জন্মদিন রোজ। সারা পৃথিবীর সেবাধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরা রোজ জন্মান। আজও সেই সেবাদাত্রীদের পথ দেখান ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
ছবি: ইন্টারনেট