– তা, এই কাজটি কার?
– আর বলনি বাপু, অর শাউড়িকে কতবার বললি ইরকম কোরো নি। ডাক্তর দেখি লও..
– তারপর?
– সে কি আর কথা শুনার লোক? বলে বাচ্চার বুক টিপ্যা দুধ বের কর্যা দিতে হবে। নাইলে যত ডাইনি সব গরু, ছাগলের রূপ লিয়্যা ঘরে আসবে। তারপর বাচ্চার বুক থিক্যানু দুধ চেট্যা চেট্যা খাবে। মোরা কতবার বললি, আগেকর্যা দিনের উসব কথা বাদ দও। মোদের নন্দ ডাক্তর কী বলে দ্যাখঅ। সে বলে, ডাক্তর ইসবের কী বুজবে? বল্যা সরষার তেল লাগিয়্যা জোরসে টিপে দিছ্যা। তারপর থিক্যা বাচ্চার মাইদুটা একদম লাল হয়্যা ফুলেইছ্যা। কাল থিক্যানু জ্বরও আসেহ্র্যা।
ডা. ঘোষ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন। তারপর নিজের মনে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন..- মায়ের বুকে দুধ তৈরির জন্য যে রস থাকে সেই রসের জন্যই জন্মের পর কয়েক সপ্তাহ অব্দি বাচ্চার বুক থেকে অল্প দুধ বেরোতে পারে। অনেক সময় মেয়ে বাচ্চাদের অল্প পরিমাণে মাসিকের মতো রক্তও আসে। এর কোনোটাই খারাপ কিছু নয়। এমনিতেই কিছুদিন বাদে ঠিক হয়ে যায়।
– তাইলে বল বাপু.. অর শাউড়িকে কত বুঝাইলি..
– ওটাকে টিপে দেওয়ার ফলে এখন জায়গাটায় ইনফেকশন হয়ে গিয়ে লাল হয়ে গেছে। ওখান থেকেই জ্বর আসছে।
– ঠিক হোয়েইব্যা ত বাপু?
– ওষুধ দিচ্ছি। এগুলো খাওয়াও তারপর দেখছি। বেশি পেকে গেলে আবার সমস্যা হবে।
বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। উনিই আজকের শেষ পেশেন্ট ছিলেন। আমি চারদিক দেখে নিয়ে স্যারকে আস্তে করে বললাম..
– স্যার, একটা কথা বলবো?
– বাব্বা!! এত রামভক্ত হনুমান হয়ে গেলি কবে থেকে? না বলতে বললে যেন বলবি না? সারাক্ষণ তো বকবক করতেই আছিস..
– বলছি স্যার, আপনি এই যে পুরিয়া-অ্যালকোহল ফোঁটা ইত্যাদি বিভিন্ন অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন করেন এতে কিন্তু অনেকে আপনার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়..
– সে কী আর আমি জানি না রে.. তুই যতোই ভালো করার চেষ্টা কর, দশজনের সাথে মিশলে একজন গালাগালি করবেই। আমার কথা শুনে যদি একজন মানুষও সচেতন হন তার জন্য আমি ওসব গালাগালি শুনতে রাজি আছি।
– না, মানে.. আপনি এত ভালো কথা বলেন..
– না। এই জায়গাটায় আমার আপত্তি আছে। আমি নরম-নরম, গোল-গোল পাঁচটা ভালো কথা বলে সবার কাছে ভালো হতে চাই না। তার চেয়ে অপ্রিয় সত্যি বলতে চাই। ‘ভালো কথা’ নয়, আমি ‘প্রয়োজনের কথা’ বলতে চাই। এমন কথা যার একটা অভিমূখ আছে, উদ্দেশ্য আছে। আমি জীবনবিমুখ, জনপ্রিয় সাহিত্যের চেয়ে পাঁচটা কাজের কথা পড়তে কিংবা বলতে ভালোবাসি।
– ওরা তো বোঝে না..
– ওদের কথা আমি থোড়াই ভাবি। রোজ তো দেখিস, অপবিজ্ঞানের মিথ্যে প্রবোধে কত রোগ জটিল আকার নেয়। মানুষ সরল বিশ্বাসে, অজান্তে বিভিন্ন জড়িবুটি-পুরিয়ার মিশ্রিত স্টেরয়েড ও আরও নানা হাবিজাবি খেয়ে যায়। তার মধ্যে একজন, শুধু একজন যদি আমার কথায় দিশা পায়, তাতেই আমার বকবক করা সার্থক। সময়ের প্রবাহে আমি নিতান্ত নগণ্য, নিতান্ত তুচ্ছ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা। যতক্ষণ হাওয়ায় ভেসে আছি ততক্ষণ আশেপাশের ধূলিকণাদেরও ওড়ার মন্ত্র শিখিয়ে যেতে চাই। মুখ থুবড়ে পড়াই যখন ভবিতব্য তখন ক্ষুদ্র উড্ডীনকাল শিখেই বাঁচি, শিখিয়েই বাঁচি..