আমি ডলি রায়। একটা যোগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ট্রেনার হিসেবে কাজ করি।
বিয়ের পর ২-১ মাস যেতে না যেতেই কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ি। আর্থিক অসুবিধা ছিল। মানসিকভাবে তৈরিও ছিলাম না। তা সত্ত্বেও আমরা আমাদের প্রথম সন্তানকে নষ্ট করতে চাইনি। আমার সন্তানের জন্মের কয়েকদিন আগে আমার সবচেয়ে কাছের ঠাকুমা আচমকাই মারা যান। আমার খুব মন খারাপ। সব সময় কেমন একটা ভয় ভয় করতো। এরমধ্যেই আমার মেয়ে হল। সেই কচি মুখখানা দেখার পর আমরা খুবই খুশি হই। ভাবলাম আমার ঠাকুমাই ফিরে এসেছে।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিল দিন দুই যেতে না যেতেই। সারা রাত বাচ্চা কান্নাকাটি করে। নিজে একটুও বিশ্রাম নিতে পারি না। বুকের দুধ ঠিকমতো আসতো না। অনেকটা সময় লেগে যেত ওকে খাওয়াতে। মাকে বললে বলতো, তুই ঠিকমতো ধরতে পারছিস না। তোর বেলায় তো আমার কোনও অসুবিধা হয় নি। নিজের মা-ই কেমন বদলে গেছে মনে হোত। কয়েকদিন পর থেকে নিজের ওপর বিরক্তিভাব আসতে থাকে। খেতেও ইচ্ছে করতো না। সারাক্ষণ কাঁদতাম আর নিজেকেই দোষারোপ করতাম। আমার মনের এই অবস্থার কথা আমার স্বামীকেও বলতে পারতাম না। ভয় হোত, সে আমাকে ভুল বুঝে না বসে। মনে হোত, আমার জীবনে আর শান্তি আসবে না। এক এক সময়ে নিজেকে ও নিজের সন্তানের ক্ষতির কথাও মাথায় আসতো। কখনও কখনও মনে হোত, আমি ভাল মা হয়ে উঠতে পারবো না। নিজের মধ্যে যেন ডাইনি বাস করছে। আমার থেকে অন্য কাউকে মা হিসেবে পেলে বাচ্চাটা একটা ভালো জীবন পেত। নিজে বুঝতে পারছিলাম আমার এই চিন্তাভাবনা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু কী করা উচিত সে বিষয়ে কোনও ধারণা ছিল না। সবার নজর সন্তানের দিকে। মনে হোত, পরিবারে আমার কোনও দরকার নেই।
এমন সময়ে আমার এক ছোটবেলার বন্ধু আসে, আমার বাচ্চাকে দেখার জন্য। তার কাছে আমি আমার মানসিক অবস্থার কথা খুলে বলি। তখন ও বলে, ওরও এমন হয়েছিল। আমার মন অনেক হালকা হল। ওর কথামতো স্বামীকে সব বললাম। ও আমার পাশে দাঁড়ালো। ইন্টারনেটে আমরা এ বিষয়ে অনেক কিছু পড়লাম। নিজেকে সুস্থ করার অনেক উপায় জানলাম।
এরপর যে ডাক্তারবাবুর কাছে ডেলিভারি হয়েছিল তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি কিছু উপায়ের কথা জানান, নিজেকে সুস্থ করে তোলার। সেদিনও বাড়ি এসে মেয়েকে জড়িয়ে খুব কাঁদি। তবে আগের কান্নার থেকে এর ধরন একেবারে আলাদা। সেই চোখের জলে আমার মনের যাবতীয় খারাপ ভাবনা দূর হয়ে যায়। এখন আমার সন্তানের বয়স ৩ মাস। ওকে ছাড়া এক মুহুর্ত কাটানোর কথা ভাবতেও পারিনা। তাই আমার মনে হয় সব মেয়েরই নিজের সমস্যার কথা মনে চেপে না রেখে সবার সঙ্গে না হলেও নিজের লোকেদের সঙ্গে শেয়ার করা উচিত।
(নাম পরিবর্তিত, কিন্তু কথা নয়।)