বিগত কয়েক বছর ধরেই সংবাদমাধ্যমের পাতায় ডাক্তারদের বিষয়ে নানান (মুখরোচক) খবর প্ৰকাশিত হচ্ছে। এগুলোর অধিকাংশেরই বিষয় হয়েছে কোনোদিন কোথাও ডাক্তার মার খেয়েছেন, কোনোদিন বা হাসপাতালের অন্য কর্মীরা। এখন তো প্রায় রোজই এই জাতীয় খবর প্ৰকাশিত হচ্ছে (যেগুলো অধিকাংশ শেষ পর্যন্ত মিথ্যা অভিযোগ বলে প্রমাণিত হচ্ছে)। এতে কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ মানুষ,ডাক্তার এবং পুরো সমাজের।
Complication আর negligence-এর মধ্যে একটা আকাশ -পাতাল পার্থক্য। রোগ-অসুখের চিকিৎসায় সবসময় দুইয়ে দুইয়ে চার হয় না। দুঃখের বিষয় হল এটা অনেকেই বোঝেন না। ডাক্তাররা সবসময়ই চান রোগী ভালো হয়ে উঠুক (অনেক তথাকথিত শুভানুধ্যায়ীদের থেকে হয়তো বেশি করেই চান)। কারণ একমাত্র রোগী ভালো হওয়ার মধ্যেই আছে ডাক্তারের আত্মতুষ্টি। একটা উপসর্গের পিছনে কয়েকশো কারণ (রোগ) থাকতে পারে। সুতরাং এক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুকে তার নিজের জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে এগোতে হয়। এই জ্ঞান একদিন বা একমাসে আসে না বা গুগলে সার্চ করেও আসেনা। এর জন্য বহু বছর পড়াশুনো করতে হয়,পরীক্ষা দিতে হয়। M.B.B.S. পড়তে লাগে সাড়ে পাঁচ বছর। তারপর ভাগ্য খুব ভালো থাকলে যারা খুব ভালো পড়াশুনো করেন তাঁরা আরো এক বছর পরে এম ডি বা এম এস বা ডি এন বি তে চান্স পান (সবাই কিন্তু নিজের পছন্দের বিষয়টি পড়ার সুযোগ পান না)। এম ডি বা এম এস করতে সময় লাগে তিন বছর। এখন আবার এর সাথে তিন বছরের বন্ড পোস্টিং যুক্ত হয়েছে।এর পরে অনেকে ডি এম করেন যার জন্য আবার পরীক্ষা দিতে হয়। এই পড়াশুনোটাও তিন বছরের এবং এতেও তিন বছরের বন্ড আছে। তাহলে সবকিছু ঠিকঠাক চললে এখন এম ডি করে বেরোতে প্রায় 13 বছর এবং ডি এম করে বেরোতে প্রায় 19 বছর সময় লাগবে। এই বনাবাস শেষ হলে ডাক্তারবাবুরা হয় চাকরি করেন বা প্র্যাক্টিস শুরু করেন।
এমতাবস্থায় কিছু না বুঝে বা ভুল বুঝে ডাক্তারদের গায়ে হাত দিলে সেটার পরিণাম হয় ভয়াবহ এবং দুর্ভাগ্যজনক। প্রথমত এর পর থেকে ওই ডাক্তারবাবু রোগিকে বাঁচানোর আগে নিজে বাঁচার চেষ্টা করবেন। তিনি খাতায় কলমে ঠিক থাকার জন্য প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা লিখতে বাধ্য হবেন যার টাকা রোগীর পকেট থেকেই যাবে। তিনি খুব খারাপ রোগী দেখলেই এড়িয়ে যেতে চাইবেন-কোনো ঝুঁকি নেবেন না, ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন এড়িয়ে যেতে চাইবেন এবং সর্বোপরি রোগীদের প্রতি তাঁর মানবিকতা হারিয়ে যাবে। শুধু তাই নয় এর ফলে অন্যান্য রোগীর আত্মীয়রা এবং অন্য ডাক্তারের যাঁরা এই মারধর এর ঘটনা দেখলেন তাঁদের মধ্যেও এক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে।রোগী এবং রোগীর আত্মীয়রা যেমন ডাক্তারদের বিশ্বাস করতে পারবেন না, তেমনি ডাক্তাররাও রোগীদের বা রোগীর আত্মীয়দের বিশ্বাস করতে পারবেন না। রোগী যদি ডাক্তারকে বিশ্বাস না করতে পারেন তবে রোগ সারা মুশকিল, খুব মুশকিল। রোগী তখন এফেক্ট এর থেকে সাইড-এফেক্টের কথা বেশি ভাবতে থাকবেন। সুতরাং এই রকম চলতে থাকলে এই vicious cycle পুরো সমাজকেই নষ্ট করে দেবে।
অনেকে ভাবছেন এতে ডাক্তারদেরও অনেক দোষ আছে। কিন্তু এটাও ভাবা প্রয়োজন যে সব প্রফেশনেই কিছু খারাপ লোক থাকে। আর ডাক্তাররাতো মঙ্গল গ্রাহ থেকে আসা কোনো জীব নন-তাঁরা আমার আপনার মতোই মানুষ। তাই সমাজ যে পরিমাণ অবক্ষয়ের শিকার ডাক্তাররাও ততটা অবক্ষয়ের শিকার।
আশা করা যাক জনসাধারণের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে, সংবাদমাধ্যম খবরের সত্যতা বিচার করে খবর পরিবেশন করবেন এবং রোগী ও ডাক্তারের সম্পর্কের মধ্যে সেই বিশ্বাসের বাতাবরণ ফিরে আসবে।
সমস্যা হলো আমাদের চিন্তায়। সস্তা চিন্তার।