একটি রাজ্যের পুলিশ – এমন রাজ্য যেখানে অভিযোগ-অপরাধ প্রচুর এবং এমন পুলিশ যারা চটপট অপরাধী ধরে ফেলে – তাঁদের ডাকা হয়েছে প্রতিবেশী আরেক রাজ্যের পুলিশের এফিশিয়েন্সি বাড়ানোর মহৎ লক্ষ্যে। আশা এই, একটি স্বল্পকালীন ওয়ার্কশপের মাধ্যমে প্রতিবেশী রাজ্যের পুলিশের কর্মদক্ষতা বাড়ানো সম্ভবপর হবে।
ওয়ার্কশপের প্রথম দিন। উন্নত রাজ্যের পুলিশের বড়কর্তা প্রতিবেশী রাজ্যের বড়কর্তাকে নিয়ে বসলেন।
– প্রথমে বলুন, আপনাদের রাজ্যে পুলিশের মাইনে কত?
– আজ্ঞে স্যার, সর্বত্র যেমন হয় আরকি। সরকারি চাকরির মাইনে আর যেরকম ডিএ সবাই পায়।
– অ্যাঁ, ‘যেরকম ডিএ সবাই পায়’! বলেন কী?
– কেন স্যার?
– আহ্, ঠিকঠাক মাইনে পেলে লোকে কাজ করবে কেন? কম মাইনে পেলে তবেই না পুলিশ দৌড়াবে, কারণে-অকারণে মামলা রুজু করবে, সেসব থেকে… যাক গে, শুনুন, আমাদের নিয়ম হলো, কমপক্ষে দুটো পে-কমিশন পিছিয়ে রাখা আর নো ডিএ – এবং সেটাই আমাদের সাফল্যের চাবিকাঠি।
– কিন্তু স্যার, আচমকা মাইনে কমিয়ে দিলে সবাই রেগে যাবে না?
– যাবে। বিশেষ করে আপনারা যখন লাই দিয়ে মাথায় তুলেছেন, তখন তো যাবেই। আমাদের এখানে পুলিশকে চাবকে সিধে রাখা হয় – থানায় মাঝেমধ্যে এমন ইয়ে করা হয়, যাতে পুলিশ ফাইল মাথায় দিয়ে টেবিলের তলায় লুকোয় – তারপর থেকে কোনও শালা ট্যাঁফোঁ করে না। কিন্তু আপনারা তো দেরি করে ফেলেছেন। তবে বেটার লেট দ্যান নেভার। এরপর থেকে মাইনেবৃদ্ধি ডিএ সব বন্ধ করে দিন – ‘ভালো কাজ’ করলে বখশিশ দেবার ব্যবস্থা করবেন – দেখবেন তরতর করে এফিশিয়েন্সি এগোবে।
দ্বিতীয় দিন উন্নত রাজ্যের পুলিশের বড়কর্তা প্রতিবেশী রাজ্যের পুলিশের মাঝারি মাপের অফিসারদের নিয়ে বসলেন।
– আপনারা খুনখারাপির তদন্ত কীভাবে করেন?
– আজ্ঞে স্যার, যেভাবে করার কথা সেভাবেই। মানে, প্রমাণ জোগাড় করা আর সেখান থেকে প্রমাণের সঙ্গে মিলিয়ে অপরাধী ধরা।
– প্রমাণ জোগাড় করা, তারপর সেই প্রমাণ ধরে ধরে…ওফ্! তাতে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে আর পরিশ্রমও অনেক বেশি। পুরো উল্টো রাস্তায় তদন্ত করেন! আপনারা কি পাগল নাকি?
– মানে?
– আরে ভাই, প্রথমে একজনকে চিহ্নিত কর যার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করা সহজ আর তারপর প্রমাণ সাজাও আর সেখান থেকেই…
– ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, স্যার।
– বুঝবে কী করে হে? ডিএ পেতে পেতে বুদ্ধিতে চর্বি জমে গেলে এই হয়। আচ্ছা, একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। কোনও খুনের তদন্ত চলছে এই মুহূর্তে? মানে, গত দুদিনে কোনও খুন হয়েছে?
– না স্যার।
– হয়নি? কী মুশকিল! অপ্রত্যাশিত মৃত্যুও কিছু ঘটেনি?
– না, সেরকম মৃত্যু… একটা ঘটনা ঘটেছে অবশ্য। একটি হাসপাতালে দু’জন রোগী মারা গিয়েছে, অপারেশনের পরেই। সরকার ডাক্তারদের একটা টিম পাঠিয়েছে তদন্ত করতে। ফাইনাল রিপোর্ট আজ আসবে। সম্ভবত নিম্নমানের ওষুধ। সেক্ষেত্রে কোম্পানির মালিককে আমরা ডাকব। তারপর…
– বলো কী? হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে আর ডাক্তাররা তদন্ত করছে! আরে, ডাক্তারই যদি তদন্ত করে, তাহলে পুলিশ বসে কি আঙুল চুষবে?!
– কিন্তু স্যার, মৃত্যুর কারণ তো…
– সে যা-ই হোক, তদন্ত তো করবে পুলিশ। আচ্ছা, এই কেসটাকেই স্যাম্পল কেস হিসেবে তোমাদের শেখানো যাক।
– ইয়েস স্যার!
– মৃত্যুটা তো অপ্রত্যাশিত। তাহলে তদন্ত করা দরকার। মানো তো?
– ইয়েস স্যার!
– তদন্ত করার জন্য মাইনে পায় কারা?
– আমরা, স্যার।
– তাহলে তদন্ত করতে হবে আমাদেরই। বুঝেছ?
– ইয়েস স্যার!
– এবারে তদন্তের ডিটেইলস-এ আসি। শুরুতেই যেটা বললাম, মৃত্যু যখন অপ্রত্যাশিত, তখন ধরেই নিতে হবে কারও না কারও দোষ। কিন্তু কী কারণে মৃত্যু, সেসব খতিয়ে দেখতে গেলে সময় নষ্ট হয়ে যাবে। অতএব, আমাদের দেখতে হবে, কার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করা সহজ… আহা, অমন মুখ করে তাকিয়ে রইলে কেন? বুঝতে পারছ না? আচ্ছা, ঘটনাটা সংক্ষেপে বলো।
– স্যার, পেশেন্টের অপারেশন হচ্ছিল। খুব জটিল কিছু ওটি নয় আর অপারেশন চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু আচমকা পেশেন্ট খারাপ হতে শুরু করে একটা স্যালাইন শুরু হতেই। আইসিইউতে পাঠানো হয়। সেখানে যথাসাধ্য চেষ্টা হলেও… ওষুধ-স্যালাইনে গোলমাল থাকার সম্ভাবনা, এমনটাই ডাক্তাররা বলছেন।
– ব্যাস, তাহলে তো কেস সলভড। ডাক্তারদেরই দোষ।
– মানে?
– আরে ভাই, তুমি কি এখন ওষুধ-স্যালাইন সব টেস্ট করে দেখবে? তারপর সেই কোম্পানির বাকি স্যালাইন টেস্ট করবে? তারপর সেই কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে গিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং ইত্যাদি প্রভৃতি সব চেক করবে? তারপর কোম্পানির মালিককে ডাকবে? সে তার ম্যানেজারকে ডাকবে? ম্যানেজার ম্যানুফ্যাকচারিং তদারকি করার দায়িত্ব যার তাকে ডাকবে? তারপর সেখানে সব ঠিক থাকলে আসা-যাওয়ার পথে কোনও গোলমাল হয়ে থাকলে সেসব দেখতে হবে। স্যালাইন-ওষুধ স্টোর করতে গিয়ে গোলমাল হলে সেসব চেক করতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ খারাপ মাল কিনলে সেসব দেখতে হবে। তারপর… ওহ্, এত জটিল চিন্তা করতে করতে মাথাটাই ঝিমঝিম করছে! ওরে একটা, দিনের বেলা যখন, চা এনে দে! তো শোনো, তদন্তের মূল কথাটা হলো – কিপ থিংস সিম্পল!
– তাহলে স্যার?
– ইয়েস। অপারেশন কে করছিল? আইসিইউ-এ কে পাঠালো? গাফিলতি তাদের। ইন ফ্যাক্ট, আইসিইউ-তে গিয়েও পেশেন্ট বাঁচেনি। তাদেরও গাফিলতি।
– আর কার কার নামে কেস দেওয়া যাবে, স্যার?
– কেন? ওই ডিপার্টমেন্টের বাকি ডাক্তারদের নামে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, দ্য মোর দ্য মেরিয়ার। যত বেশি, ততই ভালো। যাকে বলে অধিকন্তু ন দোষায়।
– কিন্তু বাকিরা তো ছিল না, স্যার।
– আরে, ছিল না সেটাও তো গাফিলতি। থাকলে এবং ওটি করলে একরকম গাফিলতি। না থাকলে ছিল না বলে আরেকরকম গাফিলতি। বুঝলে তো?
– কিন্তু স্যার, এরকম করলে ডাক্তাররা কি আর…
– ওরে ভাই, ওসব ভাবার দায়িত্ব পুলিশের নয়। দুনিয়ার ভার কি সরকার পুলিশের উপর ছেড়ে গেছে? আর তাছাড়া আমার রাজ্যে এমনিতেই পাঁচজন ডাক্তার মিলে দশজনের কাজ সামলায়, তাতেও ওই পাঁচজনের মধ্যে চারজন সাত চড়ে রা কাড়ে না, এসব কেসে ফাঁসিয়ে বাকি সেই একজনের মুখ বন্ধ করা গেলে…
ওয়ার্কশপের এই অংশটুকু অব্দিই জানতে পেরেছি।
আর এই ওয়ার্কশপের সারবস্তু যে অসাধারণ গল্পটি থেকে ‘অনুপ্রাণিত’ – এবং সেই অনুপ্রেরণার প্রকাশ মূলের তুলনায় অতিমাত্রায় কাঁচা – পারলে হরিশঙ্কর পরসাই-এর সেই গল্প ‘ইনস্পেকটর মাতাদিন চাঁদ পর’ পড়ে দেখুন।