শিরোনামটা অন্যও রাখতে পারতাম। লিখতে পারতাম, বাংলা ছায়াছবির নায়িকার ভূমিকায় লেডি ডক্টর —
কিন্তু অতিনাটুকে হয়ে যাবে মনে হলো। তা ছাড়া থিসিস তো আর লিখতে বসিনি, আপনমনে ভাবতে ভাবতে খাপছাড়া ভাবে কিছু কথা মনে এলো, লিখে না রাখলে আবার হারিয়ে যাবে — কুনকে উপচোনো চালের মতো ছড়িয়ে যাবে মেঝেময়, তাকে গুছিয়ে তুলে আনা কঠিন হবে।
ভারতে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে পশ্চিমবঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন, বাংলা শিল্পে-সাহিত্যে তার প্রতিফলন ইত্যাদি বিষয়ে নানা গুরুগম্ভীর আলোচনা পড়ি, শুনি আজকাল। মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সঙ্গে আত্মিক উন্নতি এবং সামাজিক শৃঙ্খল ভাঙা স্বাধীনতার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে কি না, সে সম্পর্কেও বিদগ্ধজনের নানা মতামত কানে আসে, চোখে পড়ে।
সাহিত্য একটি বিশাল অঙ্গন, আমার সীমিত পদক্ষেপে তার একটি কোণেও ভালভাবে ঘুরে বেড়াতে পেরেছি বলে মনে করি না। তবে বলতে নেই, বাংলা সিনেমার আমি পোকা ছিলাম এককালে।
সিরিয়াস ডাক্তারি কেরিয়ার, পড়াশোনার বিপুল চাপ, মায়ের রক্তচক্ষুর শাসন, কিছুই আমাকে বাংলা সিনেমা — বিশেষত পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমা দেখা থেকে বিরত করতে পারেনি। শনি রোববার সন্ধেবেলার পড়া রাত দুটো অবধি জেগে করে ফেলব, তবু টিভির সান্ধ্য বাংলা সিনেমা কিছুতেই মিস করা যাবে না, এই ছিল আমার ‘মটো’। বাবা ছিল মদতদাতা, তাই তার কপালেও সমপরিমাণ গঞ্জনা জুটতো মায়ের তরফ থেকে।
“ক্লাস পালিয়ে সিনেমা দেখে দেখে নিজের ভবিষ্যৎটি ঝরঝরে করেছ, এখন মেয়েরও তাই হবে! সবই আমার কপাল”!
বাবা তখন নির্বিকার চিত্তে আমাকে পুরোনো দিনের চরিত্রাভিনেতাদের চেনাতে ব্যস্ত —
নবদ্বীপ হালদার, গঙ্গাপদ বসু, নরেশ মিত্তির, লীলাবতী করালী — আরো কতশত নাম।
দেখলেন, বুড়োদের মতো কি কথা থেকে কোন কথায় এসে পড়লাম! হচ্ছিল মেয়েদের ক্ষমতায়নের কথা, আর আমি সেই গরুর রচনার মতো একঘেয়ে ছেলেবেলার গল্পে গুঁতিয়ে ঢুকে পড়লাম অভ্যাসমতো।
যাক, প্রসঙ্গে ফিরি।
মেয়েদের ক্ষমতায়নের কথা ভাবতে ভাবতে আমার মনে হলো আমার পেশাটিও আদতে যথেষ্ট জাঁদরেল পেশা (৯ই আগস্ট ২০২৪ এবং তৎপরবর্তী সময়ের ঘটনাগুলি অন্য সাক্ষ্য দেবে যদিও) — তা এই পেশায় কর্মরতাদের নিয়ে বাংলা ছবি খুব বেশি হয়েছে কি?
ভেবে টেবে খুবই হতাশ হলাম, জানেন? নায়িকা ডাক্তার, এইরকম কতিপয় ছবি মনে পড়ল, যেমন হারানো সুর(ক’দিন আগে যশোধরাদি এর উল্লেখ করেছিলেন একটি পোস্টে), সপ্তপদী, সাগরিকা, হসপিটাল। কাকতালীয়ভাবে সবক’টি ছবির লেডি ডাক্তার নায়িকাই সুচিত্রা সেন। ছবিগুলিতে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং জীবনের ওঠাপড়া বোরোলীনের বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ালেও পড়াতে পারে, তবে এই পেশায় যোগদানের মাধ্যমে মেয়েদের (পড়ুন নায়িকার) বৌদ্ধিক উত্তরণের গল্প তেমনভাবে প্রকাশ করতে পেরেছে বলে মনে হয় নি। নায়িকা শিক্ষিকা বা গায়িকা কিংবা এয়ার হোস্টেস হলেও গল্প কোথাও আটকাতো না। নায়ককেও ডাক্তার না করে নায়িকার সমপেশার করে দিলেও চলত — মিলনক্ষেত্রের অকুস্থল তৈরি হয়ে যেত অনায়াসেই।
ব্যতিক্রম হারানো সুর। সেখানে দুর্ঘটনাগ্রস্ত, স্মৃতিভ্রষ্ট নায়ককে নায়িকার বৃত্তে আনতে গেলে তাকে ডাক্তার করতে হতো — নচেৎ গল্প এগোবে না। তাও যে সে ডাক্তার নয়, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। এমন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, আংশিক স্মৃতিভ্রংশ হয়ে যাওয়া রোগীকে নিজ তত্ত্বাবধানে রেখে আরোগ্য করতে গেলে যাঁকে সেই রোগীকে বিয়ে করতে হয়!
(একেই দূরদর্শনের হিন্দি সংবাদে বর্ণনা করা হতো ‘ভ্যায়েঙ্কার পরিস্থিতি’ বলে!)
ক্ষমতায়ন কদ্দূর হয়েছিল বুঝিনি, তবে শেষ ইস্তক সুশিক্ষিতা এবং দক্ষ ডাক্তারনীকে মাথায় সিঁদুর নিয়ে রোগীর (যিনি তখন পূর্বস্মৃতি ফিরে পেয়েছেন, কিন্তু চিত্রনাট্যের আজব চু-কিতকিত খেলায় ‘পাগল’ চিহ্নিত হওয়ার সময়ের স্মৃতি ফের ভুলে মেরে দিয়েছেন) মায়ের কাছে অশ্রুভারাক্রান্ত স্বরে দরবার করতে হয়েছিল —
‘মা, আমি দুশ্চরিত্র নই, আমি আপনারই মতো পবিত্র!’
তেত্রিশ বছর ধরে ডাক্তারি করে রুগ্ন, হতাশ, ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন, রোগভয়ে আধমরা গণ্ডা গণ্ডা রোগী দেখলাম — একপিস উত্তমকুমার পাইনি কখনো। আমার চেনাশোনা কেউ কখনো পেয়েছে বলেও শুনিনি। আর পেলেও পেশেন্টকে বিয়েফিয়ে করে বসা সাংঘাতিক আনএথিক্যাল প্র্যাকটিস — বেআইনি না হলেও, ঠিক নৈতিক নয় বলেই মনে হয়।
মন হাতড়াতে হাতড়াতে আরো দুটি ছবির নাম মনে এলো। সুপ্রিয়া দেবী অভিনীত ‘কাল তুমি আলেয়া’র ডাক্তার লাবণ্য সরকার আর ‘মেঘ কালো’ ছবির ডাক্তার নির্মাল্য রায় — অভিনয়ে ফের মিসেস সেন।
‘কাল তুমি আলেয়া’য় প্রাথমিক ভাবে মহিলা ডাক্তারটিকে ক্ষমতাশালী, আত্মবিশ্বাসী এবং স্বাধীনচেতা হিসেবে দেখানো হলেও, গল্পের শেষে তাকে নায়কের সততা ও ভালমানুষির কাছে নত হতে দেখা যায়। তবু, এই ছবিতে চিরন্তন সামাজিক নিগড় ভেঙে পরিবর্তনশীল সমাজচিত্র খানিকটা হলেও লক্ষ্য করা যায়।
‘মেঘ কালো’ ছবিটি ত্রিকোণ সম্পর্কের এবং ব্যর্থ প্রেমের ছবি। ছবির শেষে ডাক্তার নায়িকার সামনে দ্বিধার সিচুয়েশন তৈরি করা হয় চিত্রনাট্যে, যেখানে ডাক্তার প্রেমিকের স্ত্রী-র(যে আবার নায়িকার তুতো বোনও বটে) সিজারিয়ান অপারেশন করতে হচ্ছে গাইনেকলজিস্ট নায়িকাকে, আর সে ভাবছে, কি করবে? তার সকল দুর্ভাগ্যের জড়কে উপড়ে ফেলে দেবার সুযোগ হিসেবে দেখবে নাকি জিতিয়ে দেবে তার ডাক্তারি সত্তাকে? এই ডিলেমা বা দ্বিধা একজন হিপোক্রেটিক শপথ নেওয়া চিকিৎসকের যে আসতেই পারে না, আজও নয়, পঞ্চাশ বছর আগে হলেও নয় — সে কথা কি এই কাহিনীর লেখক ডঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত বুঝতে পারেননি? নিজে চিকিৎসক হয়েও? অবশ্যই পেরেছিলেন। কিন্তু চিকিৎসক সত্তার আগে চিরকালীন নারীসত্তাকে রাখতে চেয়েছিলেন। ডাক্তার পরে, আগে তো স্বামী-সন্তান-সংসারের জন্য হাঁকপাঁক করতে থাকা একটা মেয়ে রে বাপু!
যে ছবিটিতে এই দ্বিধাজড়িত চিকিৎসক সত্তার সঠিক প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করি, সেটি অসিত সেন পরিচালিত ‘চলাচল’। ছবির প্রায় শেষ মুহূর্তে প্রৌঢ়া সফল চিকিৎসকের স্মৃতিতে ভেসে আসে সেই মুহূর্ত, যখন তার কিশোর দেবর মন্টু তাকে তার দাদার মৃত্যুর জন্য অভিযুক্ত না করলেও একদা প্রেমিক অবিনাশের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে যায়, তখন অরুন্ধতী দেবী অভিনীত সরমা চরিত্রটির এথিক্যাল ডিলেমা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবিনাশ দীর্ঘদিন অসুস্থ, তাকে একটু পরে দেখতে গেলেও চলবে, কিন্তু তাৎক্ষণিক অন্য যে রোগীর অবস্থা খারাপ, তাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন চিকিৎসক সরমা। অবিনাশ চলে যায় অনন্তযাত্রায়, মৃত্যুর আগে সরমার সঙ্গে তার আর দেখা হয় না। তার অবস্থা যে এত ক্রিটিক্যাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ডাক্তার হয়ে সরমার সেই মূল্যায়নে ভ্রান্তি থেকে যায়।
ব্যক্তিগতভাবে, এই ‘চলাচল’ ছবিটিকে অন্য ছবিগুলির চেয়ে আলাদা লাগে আমার।
এইখানে একটা কথা বলে রাখি। ‘চলাচল’ এবং ‘মেঘ কালো’, দুই-ই আমার মায়ের অত্যন্ত পছন্দের সিনেমা ছিল। আমি যখন ইনটার্ন কিংবা হাউসস্টাফ, তখন অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি ছবিই দূরদর্শনে দেখানো হয়েছিল। মাকে বাবার কাছে আক্ষেপ করতে শুনেছিলাম —
”ইশ, লেডি ডাক্তারদের জীবন গুলো বড্ড দুঃখের হয় — কেন যে মরতে খুকুকে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিলাম! ওরও যদি হয় অমন –”
হায়! কেন যে আমার দশ ক্লাসের পরীক্ষার আগে ছবিগুলো টিভিতে দেখানো হয়নি কে জানে! ভাবলে রাগের চোটে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে দন্তশূল বাড়িয়ে ফেলি আমি!
পরবর্তী বাংলা ছবিতে লেডি ডাক্তারদের অবস্থান আরো সঙিন হয়। এই মুহূর্তে আমার গোটা তিনেক ছবির কথা মনে পড়ছে। ‘দান প্রতিদান'(সম্ভবত সুখেন দাসের ছবি), ‘শতরূপা'(আবার সেই অনৈতিক ডাক্তার রোগীর প্রেম) আর ‘লেডি ডাক্তার’। শেষোক্ত ছবিতে গল্পের গরু গাছ ছাড়িয়ে গগনচারী হবার স্পর্ধা দেখাতে গিয়ে থাকলেও কেন্দ্রীয় চরিত্রে চিকিৎসকের ভূমিকায় লাবণি সরকার যথাসাধ্য বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছিলেন, সেটা মনে রয়ে গিয়েছে।
হালের বাংলা ছবি অবিশ্যি বেশ আধুনিক হয়েছে। ‘মুখার্জিদার বউ’ ছবিতে ঋতুপর্ণা অভিনীত সাইকোলজিস্টের চরিত্রটি খারাপ লাগেনি আমার। ‘কণ্ঠ’ ছবিতে জয়া আহসানের চরিত্রটি বলিষ্ঠ, তাঁর কাজও প্রশংসিত হয়েছিল। আরো কিছু ছবি হয়ত রয়েছে লেডি ডাক্তারদের কেন্দ্র করে, আমার দেখা নেই বলে লিখতে পারলাম না।
তবে সামগ্রিক ভাবে মহিলাদের ক্ষমতায়নের প্রতিচ্ছবি হিসেবে বাণিজ্যিক মূলধারার বাংলা ছবিতে লেডি ডাক্তারের ভূমিকা নিতান্ত ম্যাড়মেড়ে এবং সাদামাঠা — তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয় বলেই আমার মনে হয়েছে।
(সমস্তটাই স্মৃতি থেকে লেখা, কোথাও কোনো প্রমাদ থেকে যেতেই পারে। তার জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে রাখলাম।)
সঙ্গের ছবি ‘চলাচল’এ অরুন্ধতী দেবী অভিনীত সরমার।
আমার ভীষণ প্রিয় চরিত্র। জীবনের না হলেও, মনের খুব কাছের।