(বিধিসম্মত সতর্কীকরণঃ সব চরিত্র কাল্পনিক)
হরেনবাবু পাড়ার চায়ের দোকানে বেশ পরিচিত মুখ। আর হবে নাই বা কেন? উনি এককথায় জীবন্ত এনসাক্লোপিডিয়া। ইথিওপিয়ায় চালের দাম, কলম্বোর বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ, মস্কোর লোকে আমুল বাটার দিয়ে পাউরুটি খায় কিনা এসব যাবতীয় তথ্য ওনার নখদর্পনে। চেহারাতেও বেশ একখানা ইয়ে আছে। মানে, দেখলেই কেমন যেন সমীহ জাগে। ওনার আরও অনেক গুণ! চিত্রকলা, সঙ্গীত, ক্রিকেট, রাজনীতি এসবের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর অনায়াস বিচরণ। ডাক্তারির কথাটা অবশ্য না বললেও চলে। কারণ শিক্ষিত বাঙালি মাত্রই আর কিছু না জানুন ডাক্তারিটা প্রায় সবাই জানেন। যাক, গল্প বলতে এসে ভূমিকা প্রলম্বিত করে লাভ নেই। আমরা সরাসরি গল্পে চলে যাবো…
১.
গত বছর। তখন সদ্য সদ্য কোভিড থাবা বসাতে শুরু করেছে। অথচ, রোগ সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানা নেই। চিকিৎসকরাও ভয় পাচ্ছেন। হাসপাতালে পিপিই তো দূর, মাস্ক অব্দি নেই। পিপিই চাইতে গেলে মিলছে ছেঁড়া বর্ষাতি। তাই পরেই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসক বা অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। (সুধী পাঠক, বর্ষাতি পরে আপনার বাড়িতেই ঘন্টাদুয়েক বসে থাকার কথা কল্পনা করে নিন। অবশ্যই এসি ছাড়া)। এমন এক বিকেলে হরেনবাবু বসে বসে চা খাচ্ছেন। সঙ্গে করোনাভাইরাসের আকার, আকৃতি, খাদ্যাভ্যাস, বয়ঃসন্ধি, প্রেমে পড়া তারপর ওসব ইচিং-মিচিং ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখছেন। হঠাৎ সামনে দিয়ে ডা. সেনের গাড়িটা ঢুকতে দেখেই হরেনবাবু বলে উঠলেন, “এই যে দেখেছেন হারামজাদাকে! শালা হাসপাতাল থেকে করোনা বয়ে এনে সারা পাড়ায় ছড়াবে। আজই আমি পাড়ায় মিটিং ডাকছি। শালাকে পাড়াছাড়া করা দরকার।”
তারপরের ঘটনা অনেকেই জানেন। দীর্ঘ অশান্তি, হুমকি, বাড়িতে ইঁট পড়ার পর বিধ্বস্ত ডা. সেন ডিউটির পরেও হাসপাতালের একফালি জায়গায় রাত কাটাতে বাধ্য হলেন। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ডা. সেন আবার পাড়ায় ঢুকতে পেলেন বটে, ততদিনে তাঁর মনে ভেঙে গেছে; এই এদের জন্যই রাত জাগা, পিপিই পরে সেদ্ধ হওয়া!
২.
দিন যায়। বাজারে মাস্কের আকাল। ছোট চেম্বারগুলোতে দু’ফুট দূরত্বে রোগী বসানো অসম্ভব। খুপরিজীবী ডাক্তাররা চেম্বার বন্ধ করতে বাধ্য হলেন। অবশ্যই সখ করে নয়। কেননা ওখান থেকেই তাঁদের রোজগার। এতে অবশ্য হরেনবাবুর খুশি হওয়ারই কথা ছিল। সোজা হিসেব, ডাক্তার রোগী না দেখলে করোনা ছড়াবে না। এমনিতেই ওসব অ্যাজিথ্রাল, অগমেন্টিন আর ক্যালপল হরেনবাবু নিজেই কিনে খান। ডাক্তারি আর কী এমন কঠিন কাজ? রোগী ভালো হয় ভগবানের দয়ায় আর মারা যায় চিকিৎসকের গাফিলতিতে। কিন্তু কী আশ্চর্য! হরেনবাবু এতেও খুশি হলেন না। চায়ের দোকান আবার তাঁর গলার আওয়াজে গমগম করতে লাগল- “হারামিগুলো সারা বছর পয়সা লুটবে। এখন সব ভয়ে লুকিয়েছে দেখুন! শুধু ক্যাল চাই বুঝলেন, টিপ করে কানের গোড়ায়…”
৩.
তখন বাজার কাঁপাচ্ছে আয়ুর্বেদিক ক্কাথ আর আর্সেনিকাম অ্যালবাম। সকালে বাবা লোকনাথের চরণামৃত, বিকেলে ক্কাথ আর রাতে আর্সেনিকাম অ্যালবাম। রাজনৈতিক নেতানেত্রীরাও জোর সওয়াল করছেন। হরেনবাবুও বাড়িশুদ্ধ সবাইকে দু’ফোঁটা খাইয়েই মাস্ক খুলে ঘুরে বেড়ানো শুরু করলেন। চায়ে দু চুমুক দিয়েই বলতে শুরু করলেন, “ব্রহ্মাস্ত্র খেয়ে নিয়েছি। আর করোনা আমার কী করে? বলেছিলাম না, ওসব অ্যালোপ্যাথি মানেই শুধু টাকা খেঁচার কল। হোমিওপ্যাথির মতো যুগান্তকারী আবিষ্কারকেও এরা কোনঠাসা করে রেখেছে। সব বহুজাতিক সংস্থার চক্রান্ত। যাক গে, আর্সেনিকাম অ্যালবাম এসে গেছে! এবার দ্যাখ কেমন লাগে!”
কে যেন মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলেন, “কিন্তু দাদা, বিজ্ঞান বলে- অ্যাভোগাড্রো নাম্বার অনুযায়ী আর্সেনিকাম অ্যালবাম ৩০ সি-তে মূল রাসায়নিকের একটি অণুও নেই। তাহলে কাজ কে করবে? তাছাড়া হোমিওপ্যাথির কার্যপ্রণালী বা কার্যকারিতা সম্পর্কে আজ অব্দি কোনও বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নেই। উন্নত দেশগুলোর অনেক জায়গাতেই নিষিদ্ধ। শুধু মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই সম্বল। তার ভিত্তিতে…”
তেড়ে উঠলেন হরেনবাবু, “তুইও আজকাল ওষুধ কোম্পানির দালালি শুরু করলি নাকি? দুদিনের ছোঁড়া…”
চুপ করে গেলেন ভদ্রলোক।
৪.
দিন গেল। মাস গেল। আর্সেনিকাম অ্যালবাম, জড়িবুটি ক্কাথ কোথায় লুকিয়ে গেল কে জানে! এদিকে হাসপাতালে হাসপাতালে করোনা রোগীতে ছয়লাপ। আর্সেনিকাম অ্যালবামের সম্মানহানিতে হরেনবাবু কিছুদিন মিইয়ে ছিলেন। তারপর আবার জেগে উঠলেন, “শালা এতগুলো ডাক্তার করছেটা কী? নামের পাশে এত বড় বড় ল্যাজ। একটা সামান্য ভ্যাক্সিন বানাতে পারছে না?” চায়ের আসরেও সবাই সায় দিলেন- “তাই তো… সামান্য একটা ভ্যাক্সিন আসতেই এত দেরি?”
সময় থেমে থাকে না। লকডাউন, পরিযায়ী শ্রমিক, ট্রেন বন্ধ ইত্যাদি সব ব্যাপারেই হরেনবাবু বক্তব্য রাখেন। অগ্নিগর্ভ সেসব বক্তব্যের চোটে গোপালদা’র চায়ের দোকানের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। শেষমেশ গোপালদা বুদ্ধি করে সসপ্যানে চা, চিনি, দুধ সব দিয়ে হরেনবাবুকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করেন । হরেনবাবু বলতে শুরু করেন, “ওসব মাস্ক-ফাস্ক সব চক্রান্ত। এরা সব পাবলিককে ভয় দেখিয়ে কোনও গোপন ফন্দি আঁটছে। বুঝি না নাকি? সব ভ্যাক্সিনের দালাল। আরে ভাই, মাস্ক পরলেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড জমে মাথায় উঠে যাচ্ছে। মাস্কে ভাইরাস আটকাবে! ছোঃ! বা**** ডাক্তারের কথায় আমি ইয়ে, মানে ইয়ে। আমি শালা আর কোনোদিন মাস্ক পরবো না। পাবলিককে গান্ডু পেয়েছে নাকি?” বক্তব্যের তেজে আর উত্তাপে চা এমনিই ফুটে যায়। আগুন লাগে না। গোপালদা’র গ্যাসের খরচ কমে।
৫.
ততদিনে কেস খানিক কমেছে। এখন আর হরেনবাবু একা নন। তাঁর অনেক অনুগামী হয়েছে। তাঁরা কেউই আর মাস্ক পরছেন না। রাজনৈতিক সভা, খেলা, মেলা, ধর্মীয় জমায়েত কোথাও মাস্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে ভ্যাক্সিনও এসে গেছে। হরেনবাবু আবার চাঁছাছোলা ভাষায় বক্তব্য রাখলেন, “এত তাড়াতাড়ি ভ্যাক্সিন বানানো যায় নাকি? সব মুরগী বানাচ্ছে আমাদের। ওসব শালা আমি কিছুতেই নেবো না। ডাক্তার গান্ডুগুলো ভয় বেচে খায়। গিনিপিগ হ’লে ওরাই হোক।”
৬.
দ্বিতীয় তরঙ্গ শুরু হ’ল। আবার কেস বাড়তে শুরু করলো। এবং হঠাৎ করেই তুঙ্গে উঠে এলো। ডাক্তাররা তো বটেই রাজনৈতিক নেতানেত্রী কিংবা বুদ্ধিজীবীরাও ভ্যাক্সিনের পক্ষে সওয়াল করলেন। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষও ভ্যাক্সিনের লাইনে ভিড় জমাতে শুরু করলেন। ভ্যাক্সিনের আকাল দেখা দিল। হরেনবাবু যথারীতি থেমে নেই- “দেখলি! ডাক্তার পিশাচগুলোর কান্ড দেখলি? সব আগে আগে ফাঁকতালে ভ্যাক্সিন নিয়ে নিয়েছে। এবার আমরা কোথায় পাবো? পাবলিকের জীবনের মূল্য নেই? মালগুলোকে একবার হাতের কাছে পেলে…”
এদিকে অর্থপিশাচ ডাক্তাররা ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপে, মেসেঞ্জারে বহু রোগীকে টেলিকন্সালটেশন দিতে শুরু করলেন। যদিও তাঁরা জানেন, এভাবে দূর থেকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সবসময় সম্ভব নয় কিন্তু এই দুঃসময়ে সাধারণ মানুষের কাছে এইটুকু পাশে থাকাও অনেক। হরেনবাবু চোখ পাকিয়ে বলতে শুরু করেছিলেন, “নিশ্চয়ই মোটা টাকার বিনিময়ে…” কিন্তু যখন শুনলেন এর সবটাই সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রম তখন তিনি হিসেব না মেলাতে পেরে কিছুটা থমকে গেলেন। কে আবার বললো, “প্যানডেমিকের দিনে অনেক পরিষেবার দাম বেড়েছে কিন্তু কোনও ডাক্তারের ভিজিট বাড়ে নি।” ততক্ষণে হরেনবাবু ঠিক সামলে নিয়েছেন, “বাড়ায় নি মানেটা কী? এসব ছক বুঝলি? পেশেন্ট ধরার ছক। ফ্রি অ্যাপ দেখিস নি? প্রথম ক’দিন ফ্রি দেয়। তারপর ঠিক সুযোগ বুঝে…”
যদিও হরেনবাবু বুঝতে পারেন, আজকাল তাঁর কথায় তার তত হাততালি পড়ছে না। সমস্বরে ‘ঠিক বলেছেন দাদা’ কিংবা ‘কী দিলেন গুরু’ এসব আওয়াজগুলোও বেশ কমছে।
৭.
শেষ ঘটনা দু’সপ্তাহ আগের। তিনদিন টানা জ্বরের পর তীব্র শ্বাসকষ্ট। টেস্ট করতেই জানা গেল হরেনবাবু কোভিড পজিটিভ! যখন হাসপাতালে আনা হয় হরেনবাবুর জ্ঞান নেই। মরণ-বাঁচন সমস্যা। টানা তিনদিন আইসিইউতে চিকিৎসার পর হরেনবাবু খানিক স্থিতিশীল হলেন। চোখ খুলেই দেখলেন, তিনি অচেনা কোনও জায়গায়। চারদিকে পিঁক পিঁক করে কীসব বাজছে। একগাদা স্যালাইন, নল, ছুঁচ আরও কত হিজিবিজি! কয়েকজন সারা গায়ে সাদা পোশাক পরা ভূতের মতো লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে! হরেনবাবু বুঝলেন, তিনি হাসপাতালে। তৎক্ষনাৎ মনস্থির করে নিলেন। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এ সবই নিশ্চয়ই চক্রান্ত! তিনি হারামি ডাক্তারদের আসল রূপ ধরে ফেলেছিলেন বলে তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করা হচ্ছে। কোনোমতে এখান থেকে বেরোতে পারলেই এসব চক্রান্তের খবর সবাইকে জানাতে হবে…