২০১২ সাল। ডেঙ্গু তখনও স্বমর্যাদা হারায়নি। মেডিসিন বিভাগে রাউন্ড চলছে ডাঃ সরকারের নেতৃত্বে।এক্সট্রা ওয়ার্ড খুলে ভিড় সামলানোর প্রভূত চেষ্টা চলছে এম আর বাংগুর হাসপাতালে। থিকথিক করছে জ্বরের রোগী।
হঠাৎ করেই পাশের পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ড থেকে ছুটে এলেন সিস্টার দিদিমনি– ডাক্তারবাবু, প্লিজ একটু পাশের বাচ্চাদের ওয়ার্ডে চলুন।একটা বাচ্চা হঠাৎই সাড়াশব্দ করছে না। রাউন্ড ছেড়ে দৌড় দিলাম।
প্রিম্যাচিওর বেবি। দিন দুয়েক আগে ধরিত্রীপুরে প্রবেশ করেছে মাত্র। স্বল্পবয়সী মা শুয়ে শুয়ে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। হঠাৎই বাচ্চা নীল হয়ে গেল।তারপরই সাড়াশব্দ নেই। পাশে থাকা সিস্টারের চোখে পড়া মাত্রই যাকে সামনে পেয়েছেন ডেকে এনেছেন। ঘটনার বিবরণ শুনে বুঝতে অসুবিধা হয়নি। বুকের দুধ টেনে খাওয়ার শক্তি প্রিম্যাচিওর বাচ্চার তুলনামূলক কমই থাকে। ফলতঃ বাচ্চার পৌষ্টিক পথের পরিবর্তে শ্বাসপথে ঢুকেছে দুধ।তাতেই শ্বাস আটকে বিপত্তি।বড়দের ক্ষেত্রে এমতাবস্থায় বিষম খাইয়ে ওপরওয়ালা ম্যানেজ করিয়ে দেন।কিন্ত এতো একে দুদিনের পথিক, তার উপর প্রিম্যাচিওর।
কথা না বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে সাথে সাথে আমার বাম হাতের তালুর ওপর উপুড় করে শুইয়ে দিলাম যাতে ওর পেট আমার বাম বাহুর ওপর থাকে।তারপর ডান হাত দিয়ে বাচ্চাটির পিঠের দিক থেকে মস্তকমুখী চাপ দিলাম। একবার। দুবার। তিনবারের বেলায় বাচ্চা কাশির সাথে গলগল করে বমি করলো।বেশ কিছুটা শ্লেষ্মাভরা সাদা তরল বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। মুহূর্তের মধ্যে বাচ্চা আবার চোখ মেলে তাকালো। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হলো।উড়ে যাওয়া প্রাণ পাখি আবার জুড়ে বসলো বুকের খাঁচায়। প্রাণের প্রকাশ হিসেবে কাঁদলো আবার।সিস্টার দিদিমনি ধন্যবাদ দিলেন।কিন্তু স্বল্পবয়েসী অনভিজ্ঞ মা তার বাচ্চাকে “অহেতুক” চাপ দিয়ে বমি করিয়ে দেবার আকস্মিকতায় আমার দিকে ভ্রূ কুঁচকেরক্তচক্ষু নিক্ষেপ করলেন।
আজকাল এই অনভিজ্ঞতার রক্তচক্ষু দেখলে অভিমান হয় না। এক অদ্ভুত মায়া হয়।মায়ার জগতে গুনগুন করি ,“তোমার কর্ম তুমি করমা, লোকে বলে করি আমি”। সকলি তাঁর ইচ্ছা।
আসলে আমি যা করেছিলাম, একে বলে “হেমলিক’স ম্যানুভার”। শ্বাসপথে হঠাৎ কিছু আটকে শ্বাসরুদ্ধ হলে মুহূর্তের জীবনদায়ী উপশম।অন্যথায় প্রাণপাখি খাঁচাছাড়া।
বড়দের ক্ষেত্রে কি করা যাবে? প্রাথমিকভাবে বিষম খাইয়ে ওপরওয়ালার ম্যানেজ বিফল হলে? বা বিষম খাওয়ার শক্তিটুকুও না কুলোলে? মনে রাখবেন, হাতে মাত্র ৫০ থেকে ১২০ সেকেন্ড।তার বেশি দেরি হলেই এ ভবের লীলা সাঙ্গ।অহেতুক পিঠে কিল দিয়ে সময় নষ্ট না করে রোগির পেছন থেকে দুহাত দিয়ে রোগীকে বেষ্টন করুন যাতে আপনার হাতের বেষ্টনী বুক ও পেটের সংযোগস্থলে থাকে।তারপর শক্তিসঞ্চয় করে পেটের ভেতরদিকে উর্ধ্বমুখী চাপ দিন। সাধারণ ভাবে দুতিনবারের চেষ্টাতেই শ্বাসনালী থেকে বেরিয়ে আসবে অবাঞ্ছিত বস্তুটি। বাঁচবে পরিজনের প্রাণ। যন্ত্রীর যন্ত্র হয়ে প্রাণ বাঁচানোর গরবে গরবী হবেন আপনি।
কিন্তু ধরুন, আপনি একা পথের যাত্রি। আশেপাশে কেউ নেই। খেতে বসে গলায় হঠাৎ কিছু আটকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চলেছেনআ পনি।বুঝতে পারছেন, কিন্তু কি করবেন কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। হাতে সময় স্বল্প। এমতাবস্থায় কি করবেন? পাশে থাকা চেয়ারের বা বিছানার কোনে নিজের পেট ও বুকের সংযোগস্থল অংশটি (এপিগ্যাস্ট্রিকরিজিওন) চেপে ধরুন।তারপর জোরে পেটের ভেতরের দিকে নিজে নিজে ঠেলা দিন।আকষ্মিক চাপের ফলে ফুসফুসের মধ্যে থাকা হাওয়ার দমকা ঠেলায় আটকে থাকা বস্তুটি বেরিয়ে আসবে নিশ্চিত। বাঁচবে চাচাকা আপন প্রাণ।
মুহূর্তের সিদ্ধান্ত। ছোট্ট সরল পদ্ধতি। তার বিনিময়ে ধর্মরাজকে বুড়ো আংগুল। জীবনের লাইনে আবার ফিরে আসা।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, “যমের দুয়ারে কাঁটা” দেওয়া এ পদ্ধতির প্রচার বা শিক্ষণ জনমানসে তেমন নেই।যার অযাচিত বলি হয় বহু প্রাণ। সঠিক প্রশিক্ষণ ও সর্বোপরি সকলের মিলিত প্রচার নিশ্চিত মৃত্যুকে যেমন রুখে দেবে তেমনই শ্রমভারাক্রান্ত ডাক্তারবাবুকে দেবে অন্য প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ ও পরিশেষে অনভিজ্ঞ রক্তচক্ষুর হাত থেকে নিষ্কৃতি।