সেদিন ছিল ২৪ শে ডিসেম্বর, না কোনও ম্যাজাই আসেননি। বা, কোনও অবতার বা ভগবানেরও জন্ম হয়নি। আমরা ডাক্তার দিদির সঠিক বিচারের জন্য ডোরিনা ক্রসিং এ বিক্ষোভ সমাবেশে জমায়েত হয়েছিলাম। যা লাগাতার চলছিল। সেখানে পৌঁছানোর পরে সন্ধে ছটার দিকে একজন বর্ষিয়ান দিদির মুখে জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনতে শুনতে ভাবছিলাম ডাক্তার দিদিও তো এরকমই প্রতিবাদী ছিলেন। তাই তার এমন দশা হল। যাহোক তারপর তরুণ কর নামের একজন ডাক্তারবাবুর গলায় ভূপেন হাজারিকার দুটো গান শুনলাম। তিনি এতটাই ভাল গাইলেন যে অনুরোধে আরেকটাও গাইলেন। তারপর বক্তৃতা দিতে উঠলেন ডঃ সুদক্ষিণা দাস ম্যাডাম, তিনি নিজেও একজন ডাক্তার, তাঁর মুখে আমরা ডাক্তার দিদির কথা শুনলাম। সেই সঙ্গে আরেকটি কথা তিনি বললেন, যে এই নৃশংস ঘটনায় অনেকগুলো ‘মুখ’ খুলেছে। যেমন LGBTQ রাও এখন নিজেদের সমস্যা তুলে ধরছেন। এরপর আবার ডঃ তরুণ কর তিনটে গান গাইলেন। একসময় তাঁর মুখে স্বগতোক্তি শোনা গেল “অভয়া মঞ্চ আমাকে গায়ক বানিয়ে দিল”। ডোরিনা ক্রসিং এর মত জায়গাতেও সবাই নিশ্চুপে তাঁর গান শুনছিল। এরপর আরেকজনও বেশ প্রতিবাদী গান গাইলেন। এভাবেই সময় মত মানে পূর্ব নির্ধারিত সময়মত আটটা বাজলে আমরা ঘোষিত নির্দেশ পালন করে, হাতে মোমবাতি নিয়ে মানব বন্ধন তৈরি করলাম। যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত না করেই। তাই সিগন্যালে চলাচল থামলে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই আমরা রাস্তা পার হয়ে রেলিঙের পাদদেশে সিমেন্ট বাঁধানো জায়গায় মোমবাতি গেঁথে চলে এলাম। ডাক্তার দিদিকে তো আনবার্ন (UNBURN ) করা যাবে না। কিন্তু এর একটা সঠিক বিচার তো দরকার। এভাবে তো একটা রাজ্য চলতে পারে না। মিস তুঘলকের রাজত্ব।
এরপর ডক্টর তমোনাশ চৌধুরী মৃন্ময়ী প্রতিমার চোখ থেকে রক্ত পড়া, ডাক্তার দিদির একটা প্রতিমূর্তি নিয়ে এসে মঞ্চে প্রতিস্থাপন করলেন। আর সেই মৃন্ময়ীর গলায় স্টেথোস্কোপ ছিল। উনি যে ডাক্তার দিদি, স্টেথো না থাকলে হয়!!? তারপর সিনিয়ার ডাক্তাররা, তমোনাশ চৌধুরীর নেতৃত্বে ডাক্তার দিদিকে সম্মান জানিয়ে সামনে একটা ঝুলন্ত অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে রাখলেন। প্রেসের লেন্স পার্সনদের ভিড়ে অন্যদের দাঁড়ানো জায়গা ছিল না। এখানে জানিয়ে রাখি দর্শক বা পথচারীরা ক্রমাগত সমর্থন জানিয়ে গলা মিলিয়ে যাচ্ছিলেন। এই দৃশ্য দেখে একটা জিনিস আমরা বুঝতে পারছিলাম এ রাজ্যের সবাই সঠিক বিচার চায়।
এরপর আবার মঞ্চে এসে বক্তৃতা, দ্রোহের গান ও স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল। এই সময় জুনিয়ার ডাক্তারদের মধ্য থেকে অনেকে এলেও আমার মনে শুধু অনিকেত মাহাতোর কথাগুলোই স্পষ্ট ভাবে মনে রয়েছে। এছাড়া দেবাশীষ হালদারও বক্তৃতা রেখেছিলেন। প্রত্যেকের একই কথা ছিল। সঠিক বিচার কী তাহলে হবে না?? এর মধ্যে অনিকেত একটা কথা বলেছেন যা মনকে নাড়া দিয়ে যায়। তিনি বলেছেন “যখন এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন আমাদের মধ্যে প্রশ্ন ছিল কেন ওর এমন অবস্থা হল? কে করল? আমরা কিন্তু এখনো সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। এখনও একই প্রশ্ন আমাদের কে করল? কেন হল? কোনও উত্তর নেই। আর থ্রেট কালচার তো এখনও রয়েছে।” এর মধ্যে চায়ের নেশায় দেবদ্যুতি আর আমি চা খেতে গিয়ে দেখলাম। অনিকেত দাঁড়িয়ে কথা বলছেন আরেক জনের সঙ্গে। কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। তার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাইলে, তিনি জানালেন যদিও তাকে এখনও থ্রেট করছে না। কিন্তু তার কলেজে অরাজকতা এখনও বহমান। আর দোষীরা শাস্তি না পেলে মানে সঠিক বিচার না হলে এরা ফিরে এসে আবার ভয়ঙ্করভাবে রাজত্ব কায়েম করবে। এর মধ্যে ফিরে আসবার সময় দেখলাম শ্রীলেখা দি এসেছেন। তিনি মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিতে না চাইলেও প্রায় জোর করেই তাকে বলতে বলা হল। তার প্রতিটি কথাই ভীষণ যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছিল। তার মধ্যে একটা কথা আমার এখনও বারে বারে নাড়া দিয়ে যায়। যে দোষীরা কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, জামিনে ছাড়াও পেয়ে যাচ্ছে। অথচ কেন নিপীড়িতা মেয়েটা নিজের নাম হারিয়ে তিলোত্তমা, অভয়া এসব নামে সম্বোধিত হবে?? শ্রীলেখা যে মন থেকে কষ্ট পেয়েছেন মেয়েটির মৃত্যুতে তা যেন তাঁর প্রতিটি বাক্যে তাঁর অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছিল। কয়েকজন রিপোর্টার তার কাছে বাইট চাইলে তিনি বিরক্ত হয়ে বলছিলেন ভাল লাগছে না বাইট দিতে। কী হবে কিছু বলে, মেয়েটা যদি প্রকৃত বিচার না পায়!!??”
সময়ের ঘড়ি টিক টিক করে এগিয়ে যাচ্ছিল সময় সীমিত। এরপর মাইকিং করা যাবে না। তবুও এর মধ্যে একজন মাইকের সামনে গিয়ে জানালেন আমি বেশী সময় নেব না। জাস্ট পাঁচ মিনিট আপনারা গুগল ম্যাপে গিয়ে ডোরিনা ক্রসিং এর নাম বদলে অভয়া ক্রসিং করে দিন। তিনি কীভাবে কী করতে হবে বুঝিয়ে বলছিলেন। তখন সীমিত সময়ের জন্য তমোনাশ স্যর একটু রাগান্বিত হলেও, আমরা ডোরিনাকে, অভয়া বানিয়ে নিয়েছি। দশটা বাজার ১৫ মিনিট আগেই মাইক বন্ধ করা হলেও খালি গলার স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছিল ডোরিনা ক্রসিং, থুড়ি, অভয়া ক্রসিং। এর মধ্যে একজন দাদা রাতে খাওয়ার লোকজনের নাম লিখে রাখছিলেন। কথা ছিল পঞ্চাশ জন থাকবেন। লিস্টে দেখা গেল ৮০ জন। আমরা প্রভূত সাড়া পাচ্ছিলাম। আগেই বলেছি দর্শকরাও সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছিলেন। বাংলার নাগরিক থেকে আমরা তিনজন ছিলাম। আমি, শমিতাদি আর দেবদ্যুতি। রাতে ভাত রুটি যে যার মত খেয়ে আবার স্লোগান চললো সারারাত ধরে। পুলিশের থেকে কেউ উঁকি দিলেই ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বলছিল “ও পুলিশ তোমার ডি এ বাকি, বিক্ষোভে বসবে নাকি!!?? ” এভাবে নিত্যনতুন স্লোগানে মুখরিত সারারাত কাটিয়ে আমরা ভোরের আলো ফোটার সময় একটা দোকানে চা খেতে খেতে বেশ ধর্মতলা চত্তর টহল দিয়ে আবার মঞ্চে ফিরে এলাম। তবে সারারাত ধরে কালো কফি পেয়ে আমাদেরও অভিযোগের জায়গা ছিল না। আমি অবাক চোখে দেখলাম ছোট ছোট ছেলেরা কী সুন্দর গগন ভেদী আওয়াজে বলে উঠছিল “পিতৃতন্ত্র নিপাত যাক”।
এটাই বোধহয় আমাদের বড় প্রাপ্তি আগামীর কাছে।, সকালের মেট্রো চালু হলেই অন্যদের মতো আমিও বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম। তবে ছেলেগুলো যখন বাসে উঠছিল যতদূর শব্দ যায় তাদের আওয়াজে ধর্মতলা মুখরিত হচ্ছিল “অভয়া তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই” স্লোগান ছড়িয়ে ছড়িয়ে বাস করে এগিয়ে যাচ্ছিল। সকালের মেট্রো চালু হতেই বাড়ি ফিরলাম। কারণ সেদিন আমাদের পরিবারের একটা বড় ক্ষতি কয়েক বছর আগে ঘটেছিল। তাই…