সারাজীবন মানুষের জন্যে ডাক্তারি করে আসা করোনা আক্রান্ত চিকিৎসককে মৃত্যুশয্যায় যখন ১৭ লক্ষ টাকা বিল ধার্য করে বাইপাস লাগোয়া কর্পোরেট হাসপাতাল!
প্রথমে একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক। দুর্ভিক্ষের সময়ে মহামারীর সময়ে মড়কের সময়ে যেমন মানুষের দুর্দশা শতগুণে বাড়ে, মানুষের মৃত্যুমিছিল আরো লম্বা হয়, তেমন কিন্তু অসহায় মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসাও বাড়ে, প্রচুর লাভে কিছু মানুষের পকেট ভারীও হয়। ইংরেজ শাসনের শেষবেলায় ১৯৪৩ সালে বাংলায় একটি দুভিক্ষ হয়। তেতাল্লিশের সেই মন্বন্তরে প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ লাখ মানুষ অনাহারে অসুখে মারা যায় এই বাংলায়। কেন হয় এই দুর্ভিক্ষে? অনেক গবেষক দেখাচ্ছেন যে এই মহামারী আসলে কৃত্রিম। অর্থাৎ ম্যান মেড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমযে সমস্ত খাদ্যশস্য ব্রিটিশ সরকার মজুত করে রাখে তাদের সেনা বাহিনীর প্রয়োজনের জন্যে। আর সেই সুযোগ নেয় দেশীয় কালোবাজারি আর মহাজনেরা। যা অবশিষ্ট খাদ্যশস্য তারা একসাথে কিনে নিজেদের গুদামে ঢুকিয়ে নেয়, তারপর দুর্ভিক্ষের সময়ে না খেতে পাওয়া লোকজনদের সেগুলো বেশিদামে বিক্রি করে।
আজকে গল্প করবো এই করোনা মহামারীর সময়ে কয়েকটা নব্য কালোবাজারি আর একজন মানুষের ডাক্তারকে নিয়ে।
ডাক্তার প্রদীপকুমার ভট্টাচার্য। শ্যামনগরের মানুষের কাছে ছিলেন ‘প্রদীপ শিখা’। তিন পুরুষের বাস শ্যামনগরে। দাদু ছিলেন শ্যামনগরের প্রথম এমবিবিএস ডাঃ বিভূতিভূষন ভট্টাচার্য। তিনি নিজে ১৯৮৮ সালে ডাক্তারি পাশ করে বেরিয়েছেন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ থেকে। আজ প্রায় ৩০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে তাঁর ডাক্তারি পেশায়। গোটা বিশ্বজুড়ে যখন এই করোনা ভাইরাস আক্রমণ শানিয়ে চলেছে, ঠিক সেই সময়ই শ্যামনগরের এই চিকিৎসক সব নিয়ম মেনেই সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিদিন দু’বেলা নিজের চেম্বার খুলে বসছেন এবং আগের মতোই চিকিৎসা করে গেছেন। এলাকার কিছু চিকিৎসক যখন করোনার কারণে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন, তখন রোগীর একেবারে কাছ থেকেই চিকিৎসা করেছেন তিনি। করোনায় কাজ হারানো বা গরিব মানুষের থেকে টাকাপয়সা নেননি। বিনামূল্যে ওষুধও দিয়েছেন।
চিকিৎসক হিসেবে শুধু শ্যামনগর নয়, আশপাশের ভাটপাড়া, জগদ্দল, গারুলিয়ার মানুষ প্রদীপ ভট্টাচার্যকে একডাকে চেনেন। এলাকার গরিব মানুষের কাছে তিনি মসিহা। তাঁদের থেকে কোনও টাকা নেওয়া তো দূরের কথা, বিনামূল্যে ওষুধও দেন। শ্যামনগর ফিডার রোডের বটতলায় নিজের বাড়ির নীচেই তাঁর চেম্বার। রাতবিরেতে কেউ অসুস্থ হলেও তিনি অক্লান্ত। আবার করোনার জন্য মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে ৫১ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্যও পাঠিয়েছেন।
কিন্তু শেষমেশ করোনায় ছুঁয়েছিল তাঁকেও। হাসপাতালে লড়ছিলেন প্রদীপ। গত ১৫ জুলাই তাঁর কোভিড রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তার পরেই তাঁকে কলকাতার মুকুন্দপুরে বাইপাস লাগোয়া একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বছর আটান্নর এই চিকিৎসকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়। পরে তিনি কিছুটা সুস্থ হলে ভেন্টিলেশন থেকে বের করা হয়। কিন্তু ফের অবস্থার অবনতি হলে ভেন্টিলেশনে দিতে হয়। সবমিলিয়ে বিল হয়েছিল ১৭ লক্ষ টাকার বেশি। তবে শ্যামনগরের মানুষ তাঁদের প্রদীপের শিখাকে নিভতে দিতে ছিলেন নারাজ। টাকা জোগাড় নিয়ে পরিবারের যখন রাতের ঘুম ওড়ার অবস্থা, তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তার এলাকার সব মানুষ। সেখানে সাধারণ চাকরিজীবী থেকে শুরু করে গরিব রিকশাওয়ালা- সকলে অর্থসাহায্য করছিলেন।
এখন জনস্বাস্থ্য বা সকলের জন্যে স্বাস্থ্য বা প্রাথমিক স্বাস্থ্য – এইসব কথা আজকাল কেউ বিশেষ বলেনা। একমাত্র এমবিবিএসে ডাক্তারি ছাত্ররা কমিউনিটি মেডিসিন নামে একটা পেপারে তেতো বড়ি গেলার মতো সকলে ওই এক বছর একটু গিলে নেয়। সরকারি হাসপাতাল বা পাড়ার ডাক্তারবাবুদের নিজস্ব ছোট ক্লিনিক বা এলাকার ছোট হাসপাতাল আজকাল খুবই সেকেলে। অন্যদিকে বাইপাসের ধারে হোটেলের মতো ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট হাসপাতল একের পর এক গজিয়ে ওঠে। সেখানে যত টাকা ফেলবে তত ভালো চিকিৎসা। হাসপাতালে ঢুকলে প্রথমেই লাখখানেক টাকা জমা, তারপর টোপ ফেলা হবে বিভিন্ন প্যাকেজের – কর্পোরেট এক্সেকিউটিভদের জন্যে আলাদা প্যাকেজ আর বিলাসবহুল পাঁচতারা suite আর সাধারণ মধ্যবিত্তদের জন্যে আলাদা প্যাকেজ। আর গরিবদের তো একেবারে দরজা থেকেই বের করে দেওয়া হয়। অথচ এই সবকটা হাসপাতাল কিন্তু নামমাত্র মূল্যে সরকারি জমি পেয়েছিলো হাসপাতাল গোড়ার জন্যে, অনেক সরকারি পরিষেবায় ভর্তুকি পায়, সরকারি সুবিধে লাভের জন্যে এদের একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক বেড রিসার্ভ করে রাখার কথা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষদের চিকিৎসার জন্যে, প্রতিটি ল্যাব পরীক্ষা বা ওষুধে বা যেকোনো পরিষেবার সর্বোচ্চ কত মূল্য ধার্য করতে পারে আর সর্বোচ্চ কতটা প্রফিট রাখতে পারে সেসব কিন্তু সরকারের ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট একট দ্বারা নিয়ন্ত্রণ রাখার কথা।
কিন্তু ওই যে বললাম আগেকার উঁচু সাদা গদিতে বসে পাশে ক্যাশ-বাক্স রাখা পান চিবুনো কালোবাজারিরা আজ আর নেই। আজকের এসব করার জন্যে অনেক কাঠখড় পড়াতে হয়। পড়তে হয় মার্কেটিং, সেলস ইত্যাদি আরো কত কি। ডিগ্রি নিতে হয় এমবিএ। আর একেই তো বলে উন্নয়ন বা development!
করোনাযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ডা প্রদীপ ভট্টাচার্য ১০ই আগস্ট, ২০২০।
ডাক্তার বাবু,আমাদের কিচ্ছুটিকরার নেই,আপনারা লিখবেন আমরা পড়ব দুঃখপা, আর ব্যবস্হা ও সরকার কে গালি দেব,কি করনীয় এব্যাপারেও কেউ দিশা দেখাতে পারছেন না।
এর থেকে মনে হয় মুক্তি নেই। আমাদের দেশের design টাই এইরকম।যত দিন যাবে এটা আরো শক্তপোক্ত হবে।