ম্যাক্লাউডও দেশে গেলেন আর এদিকে কুকুরদের প্যানক্রিয়াস নালি বাঁধার কাজও শেষ করে ফেলেছেন বান্টিঙ। খানিক বিরতি পাওয়া গেল এখন। কুকুরদের বেঁধে দেওয়া প্যানক্রিয়াস নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এখন তাঁদের। হুমমম, তা মাস খানেক তো বটেই। তারও বেশি দিনও লাগতে পারে হয়তো। তারপর কুকুরের সেই নিষ্ক্রিয় প্যানক্রিয়াসটা কেটে বার করে নেবেন তাঁরা। আর সেই প্যানক্রিয়াস থেকে সংগ্রহ করবেন নির্যাস। পরিকল্পনা যথেষ্টই নিখুঁত ছিল, তবু কিছু সমস্যা তৈরি হলো গবেষণায়। সমস্যা হলো কুকুরদের নিয়ে। অপারেশন পরবর্তী ইনফেকশান ও গরমের কারণে কুকুরগুলোকে বাঁচিয়ে রাখাই যাচ্ছে না। একের পর এক মারা যাচ্ছে কুকুরগুলো। দু’সপ্তাহের মধ্যে ৫টা কুকুর মারা গেল। অপারেশনের শুরুর দিকে মারা গিয়েছিল ২টো কুকুর। মোট ১০টা কুকুর বরাদ্দ করেছিলেন ম্যাক্লাউড। এখন বেঁচে আছে আর ৩টে কুকুর। পরের সপ্তাহেই মারা গেল আরও একটা কুকুর। বেঁচে রইল কেবল ৩৯০ আর ৩৯৪ নম্বর কুকুর। মহাচিন্তায় পড়লেন বান্টিঙ। এ তো পরীক্ষার প্রথমে ধাপেই ধাক্কা। কুকুরগুলোকে বাঁচিয়ে রাখাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবিত কুকুরের নিষ্ক্রিয় প্যানক্রিয়াসই তো দরকার তাঁর। এদিকে আর কুকুরও নেই আর হাতে! আর ম্যাক্লাউডও অনুপস্থিত ঠিক এই সময়েই। কোথা থেকে কুকুর পাবেন তিনি এখন? বান্টিঙ ঠিক করলেন, নিজের পয়সা দিয়ে বাইরে থেকে কুকুর কিনবেন তিনি। যদিও বেশ খরচ সাপেক্ষ সে পথ। এক একটা কুকুরের দাম বলে কিনা ৩ কানাডিয়ন ডলার, যেখানে বান্টিঙের এক সপ্তাহের বাড়ি ভাড়া হলো ২ কানাডিয়ন ডলার। তাছাড়া একটা কুকুর কিনে কী হবে? বেশ কয়েকটা কুকুর প্রয়োজন এখন তাঁর। মরিয়া বান্টিঙ নিজের গাড়িটা বিক্রি করে দিলেন। যা পেলেন তাই দিয়ে আরো ৯টা কুকুর কিনলেন তিনি। তাঁদের নম্বর হলো ৪০০, ৪০৮, ৪১০ … ।
জুন মাসের শেষের দিকে, নায়াগ্রা প্রপাতের কাছে এক সেনা শিবিরে যোগ দিতে নায়াগ্রা অন দ্য লেক শহরে যেতে হবে বেস্টকে। তাঁর সেই যাত্রাসূচির কথা তিনি আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন ম্যাক্লাউডকে। বান্টিঙও জানতেন সেই কথা। অগত্যাই গবেষণা থেকে ছুটি দিতে হলো বেস্টকে। প্রায় দু’সপ্তাহের ছুটি নিয়ে সেনা শিবিরে যোগ দিতে গেলেন বেস্ট।
বেস্ট চলে গেলেন, ম্যাক্লাউডও অনুপস্থিত। এখন একাই সব দায়িত্ব সামলাচ্ছেন বান্টিঙ। কাজের চাপ যে খুব বেশি এখন তা নয়। কাজ বলতে এখন কুকুরদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। কুকুরের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে বান্টিঙ দেখলেন, বেস্টের লিখে রাখা নোটগুলো যথেষ্ট এলোমেলো। পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত বিকার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতিগুলো যথেষ্ট নোংরা, ল্যাবরেটরির একটা দিক অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন, মেঝেটাও ফাটা ফাটা। এইসব দেখে মহাখাপ্পা বান্টিঙ। একেই অপারেশন পরবর্তী ইনফেকশনের ফলে বাঁচানো যাচ্ছে না কুকুরগুলোকে, তার মধ্যে কাজে এত অযত্ন? এত অপরিচ্ছন্ন ঘর? নতুন এই কুকুরগুলো মারা গেলে কোথা থেকে কুকুর পাবেন তিনি? নিজের শেষ সম্বল গাড়িটা পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। কপর্দকশূন্য তিনি এখন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাঁর। তার মধ্যে এই অপরিচ্ছন্ন কাজ! বেস্টের কাজের মধ্যেই যেন নিজের স্বপ্নের মৃত্যুশয্যা দেখতে পেলেন বান্টিঙ।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি, নায়াগ্রা থেকে ফিরলেন বেস্ট। ততদিনে আরো ৪-৫টা কুকুর মারা গেছে। মহাচিন্তায় পড়েছেন বান্টিঙ। ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তাঁকে। নায়াগ্রা থেকে ফিরে, গবেষণার কাজে যেদিন যোগ দিলেন বেস্ট, সেইদিন বেস্টকে একপ্রস্ত বকাবকি করলেন বান্টিঙ। অপরিচ্ছন্ন কাজের জন্য বেস্টের উপর রেগে অগ্নিশর্মা তখন তিনি। বান্টিঙের এ হেন বকাঝকায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুতে পড়ে থতমত খেয়ে বেস্ট বললেন, “আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না আমার সাথে”। শুনে বান্টিঙের মেজাজ গেল সপ্তমে চড়ে। জীবন বাজি রেখে গবেষণা করছি আমি, আর বেস্ট কিনা তাঁকে সহবৎ শেখাচ্ছেন এখন! তুমুল ঝগড়া শুরু হলো বান্টিঙ আর বেস্টের মধ্যে। চিৎকার করছেন দুজনই। জীবনের পরবর্তী সময়ে এই প্রসঙ্গে বেস্ট লিখেছেন, ‘বান্টিঙ তাঁর উপর এতটাই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে সেদিন তাঁদের মধ্যে হাতাহাতি হবার উপক্রম হয়েছিল’ (ফিল্মে ধাক্কাধাক্কি দেখানো হয়েছে)। ঝগড়া ঝাঁটির পর অবশ্য বিশেষ কথা বাড়ান নি বেস্ট। নিজের ভুল বুঝতে পেরে দ্রুত হাতে জিনিসপত্রগুলো পরিচ্ছন্ন করতে শুরু করেন। পরবর্তী কালে বান্টিঙ লিখেছেন, “সেদিন প্রায় সারাদিন ধরে পরিশ্রম করে একার হাতে সব সাফাই করেছিলেন বেস্ট”। পরে বেস্ট আবার লিখেছেন, “বান্টিঙের সেদিনের রুদ্রমূর্তির কথা জীবনেও ভুলবো না [আমি]”।
রাতে ঝড় বাদলের পর, সকালের আকাশ যেমন আলোর ছটায় ঝলমল করে উঠে, এই একপ্রস্ত ঝগড়ার পর বান্টিঙ-বেস্ট সম্পর্ক তেমনই ঝলমল করে উঠেছিল পরবর্তী কালে। এই ঝমেলার পরই বান্টিঙ-বেস্টের মধ্যে একটা সুন্দর বোঝাপড়া গড়ে উঠেছিল। গড়ে উঠছিল সুস্থ সম্পর্ক। এই ঝামেলার পর বান্টিঙের সাথে বেস্টের সম্পর্ক এতটাই মজবুত হয়ে উঠেছিল যে পরবর্তী কালে তাঁর নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক অর্থ বেস্টের সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন বান্টিঙ [২২]। বান্টিঙ ও বেস্টের মধ্যে নোবেল পুরস্কারের অর্থ ভাগাভাগির ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরলতম ঘটনা। আর এই ঘটনাই প্রমাণ করে বান্টিঙ ও বেস্টের মধ্যে কেমন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেই সময়ে।
২৭শে জুলাই ১৯২১, গবেষণার দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছলেন বান্টিঙ। যে ক’টা কুকুরের প্যানক্রিয়াস নালি বাঁধা হয়েছিল, তাঁদের কয়েকটা জীবিত আছে এখনও। কুকুর নম্বর ৪১০ তাদের অন্যতম। ৪১০ নম্বর কুকুরের প্যানক্রিয়াস নালি বাঁধা হয়েছে অনেক দিন আগেই। এতো দিনে ৪১০এর প্যানক্রিয়াস নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার কথা। সময় হয়েছে এখন ৪১০এর পুরো প্যানক্রিয়াসটা কেটে নেওয়ার। সেই মতো কুকুর ৪১০কে ফের তোলা হলো অপারেশন টেবিলে। তাকে অজ্ঞান করে তার নিষ্ক্রিয় প্যানক্রিয়াসের পুরোটাই কেটে বার করে আনলেন বান্টিঙ। এই নিষ্ক্রিয় প্যানক্রিয়াসটাকে ছুরি দিয়ে কুচিকুচি করে কেটে ফেললেন তাঁরা। আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা রিঙ্গার দ্রবণে [২৩] চুবিয়ে রেখে দিলেন প্যানক্রিয়াসের এই কুচিগুলোকে। এবার বরফ দেওয়া একটা বড় পাত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন প্যানক্রিয়াস কুচির পাত্রটা। এই পাত্রের মধ্যেই থিতু হতে লাগলো অবিকৃত আইলেটস থেকে নির্গত নির্যাস। এবার পালা প্রহর গণনার। আইলেটস্ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পাত্রের মধ্যে জমা হচ্ছে বান্টিঙের স্বপ্নের ইনসুলিন। পাত্রের মধ্যে ঠিক মতো জমছে তো নির্যাস? উৎকন্ঠিত বান্টিঙের তর যেন আর সয় না। পরদিন, বরফের পাত্র থেকে বার করা হলো প্যানক্রিয়স কুচির পাত্রটা। হ্যাঁ, জমেছে, পাত্রে নীচে জমা হয়েছে নির্যাস। মুখে আর হাসি ধরে না তাঁর। এটাই তো তাঁর স্বপ্নের নির্যাস- ইনসুলিন। এবার নির্যাস থেকে প্যানক্রিয়াস কুচিগুলোকে পৃথক করা দরকার। একটা ফিল্টার পেপার দিয়ে নির্যাসকে পরিশ্রুত করে নিলেন তাঁরা। ব্যস, প্রস্তুত হয়ে গেল পৃথিবীর প্রথম প্যানক্রিয়াস নির্যাস, তথা ইনসুলিন। এবার শুধু ইঞ্জেকশন দেওয়ার পালা। দেখতে হবে এই ইঞ্জেকশন প্রয়োগে ব্লাড সুগারের মাত্রা কমল কিনা।
প্যানক্রিয়াস না থাকায় কুকুর নম্বর ৪১০এর ডায়াবিটিস ধরা পড়ল অচিরেই। তার মূত্রের নমুনায়ও সুগারের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এদিকে তৈরি হয়ে গেছে বান্টিঙের প্যানক্রিয়াস নির্যাসও। ৩০শে জুলাই ১৯২১, এক ঐতিহাসিক দিন। সকাল ১০.১৫ মিনিট [বেস্টের নোট দ্রষ্টব্য], কুকুর ৪১০এর ব্লাড সুগার এখন ০.২০ একক [কুকুরদের স্বাভাবিক ব্লাড সুগার মাত্রা ০.০৮ থেকে ০.১৩ একক]। ইতিপূর্বে তৈরি করে রাখা প্যানক্রিয়াস নির্যাসের ৪ সিসি ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো ডায়াবিটিসগ্রস্ত কুকুর ৪১০এর শিরায়। কুকুর ৪১০ই হলো পৃথিবীর প্রথম প্রাণী যাকে প্যানক্রিয়াস নির্যাস তথা ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। কুকুর ৪১০এর শিরায় শিরায় দৌড়তে শুরু করল প্যানক্রিয়াস নির্যাস। কুকুরের শরীরের ভিতর কাজ শুরু করে দিয়েছে সে। এক বুক উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছেন বান্টিঙ আর বেস্ট। কিছুক্ষণ পরে কুকুর ৪১০-এর ব্লাড সুগার মাপবেন তাঁরা। আর তখনই বোঝা যাবে তাঁদের পরীক্ষার ফল কি হলো।
ঐতিহাসিক ৩০শে জুলাই ১৯২১, কুকুর ৪১০এর দিনলিপি। এই ভাবে লেখা নোট দেখেই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন ম্যাক্লাউড। |
ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন বান্টিঙ আর বেস্ট। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ আর হয় না। সকাল ১১.১৫, সংগ্রহ করা হলো কুকুর ৪১০এর রক্তের নমুনা। দ্রুত সেই নমুনার ব্লাড সুগার মাপতে বসলেন বেস্ট। বেস্টের দিকে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছেন বান্টিঙ। কমেছে! ৪১০এর ব্লাড সুগার কমেছে! ৪১০এর ব্লাড সুগার এখন ০.১২। ০.০৮ একক কমেছে ৪১০এর ব্লাড সুগার। স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যে চলে এসেছে কুকুরে ব্লাড সুগার মাত্রা। খুশিতে আত্মহারা বান্টিঙ আর বেস্ট। পেরেছেন, পেরেছেন তাঁরা ডায়াবিটিসের ওষুধ আবিষ্কার করতে। তখন আরো ৫ সিসি ‘নির্যাস’ ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো কুকুর নম্বর ৪১০কে। এবার দেখা যাক, কত দাঁড়ায় কুকুরের ব্লাড সুগার। ঘন্টা খানেক পর, দুপুর ১২.১৫ মিনিটে ফের মাপা হলো ৪১০এর সুগার। এবার কিন্তু আশানুরূপ ফল পাওয়া গেল না। ৪১০এর ব্লাড সুগার এখন ০.১১। দ্বিতীয় দফায় ৫ সিসি ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর, সুগার কমেছে মাত্র ০.০১ একক! কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল বান্টিঙ আর বেস্টের। তাড়াতাড়ি আরো ৫ সিসি ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো কুকুরটাকে। দুপুর ২.১৫ মিনিটে কুকুর ৪১০এর ব্লাড সুগার দাঁড়াল ০.১৮। সর্বনাশ! ইঞ্জেকশন দেওয়া সত্ত্বেও, এ যে উল্টে বেড়ে গেছে ৪১০এর সুগার। প্রমাদ গুনলেন বান্টিঙ। বান্টিঙের ভয়ই সত্যি হলো। বান্টিঙ ও বেস্টকে স্তম্ভিত করে, পরের দিন সকালে মারাই গেল কুকুর নম্বর ৪১০।
(চলবে)
[২২] ইনসুলিন আবিষ্কারের জন্য যুগ্মভাবে নোবেল পুরস্কার পান বান্টিঙ এবং ম্যাক্লাউড। বান্টিঙ তাঁর প্রাপ্য অর্থের অর্ধেকটা বেস্টের সাথে ভাগ করে নেন। ম্যাক্লাউডও তাঁর প্রাপ্য অর্থের অর্ধেকটা ভাগ করে নিয়েছিলেন, তাঁদের গবেষণার আরেক সতীর্থ কলিপের সাথে। প্রসঙ্গত, বেস্ট এবং কলিপ, কেউই কিন্তু নোবেল পুরস্কার পান নি।
[২৩] সোডিয়াম ক্লোরাইড [খাদ্য লবণ], পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড এবং সোডিয়াম বাইকার্বনেটের [খাবার সোডা] জলীয় দ্রবণকে ‘রিঙ্গার সলিউশন’ বলা হয়। ১৮৮২ সাল নাগাদ বৃটিশ চিকিৎসক সিডনি রিঙ্গার (১৮৩৫-১৯১০) প্রথম এই দ্রবণ ব্যবহার করেন। দেহের বাইরে, যে কোনো রকমের কোষ বা অঙ্গকে সংরক্ষণ করতে, ধাত্র মাধ্যম হিসেবে এই দ্রবণ ব্যবহার করা হতো। দ্রবণে ব্যবহৃত লবণগুলোর পরিমাণের হেরফের ঘটিয়ে নানা ধরনের রিঙ্গার সলিউশন প্রস্তুত করা হয়।