আমার নাম দেবাশিস পাল (বয়স- ৫৯) উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ব্যারাকপুর মহকুমার অর্ন্তগত ভাটপাড়া পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের একজন বাসিন্দা। পরিবার বলতে আমার স্ত্রী, আমার একমাত্র কন্যা (বয়স- ২৩) রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের M.S.W.-এর Final Semester এর ছাত্রী ও আমার বৃদ্ধা বিধবা মা (বয়স প্রায় ৮০)। গত ১১ ই জুন ‘২০ (বৃহস্পতিবার) রাত থেকে জ্বর আসে, কখনও ১০০, ১০১ বা ১০২। বৃহস্পতিবার জ্বরটা না কমায় আমার নিজস্ব চিকিৎসক ডাঃ পুণ্যব্রত গুণকে ফোন করি, তিনি শুনে COVID -19 পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন, এবং তিনি তাঁর pad-এ লিখে WhatsApp করে আমাকে পাঠিয়ে দেন গত ১২ই জুন ‘২০।
আমার মেয়ে Suraksha Diagnostic-এর ভাটপাড়া শাখায় যোগাযোগ করলে তারা জানায় আগামীকাল অর্থাৎ ১৩ই জুন (শনিবার) সকাল ৬ টার মধ্যে আমাদের প্রতিনিধি আপনার বাড়ি পৌছে যাবে এবং লালারস সংগ্রহ করে আনার জন্য ৩৩০০ টাকা লাগবে। সেইমতো সুরক্ষার প্রতিনিধি ১৩ তারিখ সকাল ৬টার মধ্যে আমার বাড়ি পৌছে যায় এবং মুখের ও নাকের লালারস সংগ্রহ করে নিয়ে যায় ১৪ তারিখ (রবিবার) দুপুর ২.৩০ মিনিট নাগাদ আমার ই মেলে জানায়, আমার Covid Possitive।
আমার রিপোর্ট পজিটিভ পাবার পরই ভাটপাড়া পৌরসভার মুখ্য প্রশাসক অরুণ ব্যানার্জীকে তাঁর মোবাইলে জানাই এবং ভাটপাড়া থানার ও.সি রাজশ্রী দত্তকে তাঁর মোবাইলে জানাই এবং উভয়কেই অনুরোধ করি যত দ্রুত সম্ভব আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে। ভাটপাড়া পৌরসভার প্রশাসক কোনো ব্যবস্থাই করলেন না উপরন্তু সমগ্র ভাটপাড়ায় WhatsApp মারফত আমার report টা দ্রুত ছড়িয়ে দিলেন। তিনি জানালেন আজ রবিবার তাই কোনো কেউ আপনার বাড়ি যাবেন না, আগামীকাল দুপুর ১২.৩০ মিনিট এ পৌরসভার পক্ষ থেকে কেউ যাবে। কিন্তু যথারীতি কেউ এলেন না। এরপর বিভিন্ন বন্ধু মারফত নাম্বার পাবার পর ভাটপাড়া পৌরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের নোডাল অফিসার শ্রী আশিস চক্রবর্তীর সাথে যোগাযোগ করি এবং তিনিও অ্যাম্বুলেন্স না পাবার কথা জানান। এরপর যোগাযোগ করি জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকারিক (CMOH) ডাঃ তপন সাহার সঙ্গে, তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেন। ইতিমধ্যে কলকাতা নাগরিক মঞ্চের নব দত্ত একটি WhatsApp Post করেন ভাটপাড়া অঞ্চলে একজন কোভিড – ১৯ পজিটিভ রোগী প্রশাসনের সমস্ত স্তরে জানানো সত্বেও, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার কোনো অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয় নাই। এই পোস্টটি করেন সোমবার (15.06.2020) 24 ঘন্টা অতিক্রম হওয়ার পর।
এই পোস্টটি দেখে PID (People in Distress) সংগঠনের সুকুমার মিত্র আমার ফোন নাম্বার পেয়ে আমাকে ফোন করেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমি হাসপাতালে যেতে ইচ্ছুক কিনা। আমি জানাই হাসপাতালে যেতে রাজি। তারা তৎক্ষণাৎ পঃবঃ সরকারের স্বাস্থ্য সচিব, জেলাশাসক, জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক, ব্যারাকপুর মহকুমার মহকুমাশাসক, পঃবঃ সরকারের মুখ্যসচিব, করোনার নোডাল অফিসার পঃবঃ সরকার, প্রভৃতি বিভিন্ন আধিকারিকদের e- mail করে জানানোর পর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকারিকের নির্দেশে বারাসত থেকে একটি সরকারী Ambulance সোমবার (১৫.০৬.২০২০) রাত ১০.৪০ মিনিট ১২.২০ মিনিটে আমাকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়, সেখানেও স্বাস্থ্য ভবন থেকে ফোন যায় ফলে আমাকে ভর্তি করে নেয়।
আমাকে ভর্তি করেন আমার সংগঠন অর্থাৎ APDR-এর উত্তর কলকাতার পাভেল চক্রবর্তী। তিনি ঐ সময় আমার জন্য হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন, তিনিই সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেন।
রাত ১.০৫ মিনিটে মেডিকেল কলেজের Super Speciality Block-এর 4th floor-এর Bed No 414-এ গিয়ে বসি। ১৪ তারিখ দুপুর ২.৩০ মিনিট থেকে ১৫ তারিখ রাত ৮.৩০টা পর্যন্ত অর্থাৎ এই ৩০ ঘন্টা স্থানীয় প্রশাসন ন্যূনতম ব্যবস্থা নেয়নি আমাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার ব্যাপারে। একমাত্র PID (People in Distress) ১৫ তারিখ সন্ধ্যা ৬.০৮ মিনিটে যদি না পঃবঃ সরকারের স্বাস্থ্য সচিবকে চিঠি ই-মেল মারফত না পাঠাতো তাহলে ঐ দিন রাতে কোনমতেই ভর্তির ব্যবস্থা হতো না। স্থানীয় প্রশাসনের কঙ্কালসার চেহারা গত ১৫ই জুন আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
১৫ই জুন রাত ১.০৫( রেকর্ড অনুযায়ী ১৬ই জুন) থেকে মেডিকেল কলেজ। কলকাতা ভর্তি হবার পর কোনোরকম শারীরিক অসুবিধা দেখা দেয়নি। মেডিকেল কলেজের চিকিৎসা ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নতমানের। ভর্তির ৪০ মিনিটের মধ্যে ডাক্তার এসে আমাকে জিঞ্জাসাবাদ করেন এবং ওষুধ প্রেসস্ক্রাইব করে যান। ভর্তির দু’দিনের মধ্যে রক্তের যাবতীয় Test করে, ECG করে, বুকের X- Ray করে। পাঁচদিন HCQ ও দশদিন Antibiotic Amoxyclav- -625 চলেছে, এছাড়াও প্রতিদিন PCM- 650 আমার ওষুধের তালিকায় ছিল। সুগার ও প্রেসারের ওষুধ নিয়ম করে দু’বেলায় দিত। এছাড়াও শুষ্ক কাশির জন্য একটা কাশির সিরাপও দিয়েছিল। ১৬ তারিখ থেকে আমার কোনো জ্বর ছিল না।
১২ দিন দেখার পর ২৭ শে জুন,২০২০ বিকেল ৪টায় আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয় এবং মেডিকেল কলেজের অ্যাম্বুলেন্স করেই আমাকে বাড়িতে পৌছে দেয় এবং ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়। সেইমতো বাড়ীর একটা আলাদা ঘরে আমি ছিলাম।
করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর আমার যে অভিজ্ঞতা তাতে আমার মনে হয়েছে, সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বিরাট কমিউনিকেশন গ্যাপ রয়েছে। কোথায় টেস্ট করাবো, টেস্টে পজিটিভ এলে কী করা, বাড়িতে থাকবো না হাসপাতালে যাবো, সরকারী হাসপাতাল বা সরকার-অধিগৃহীত হাসপাতালে কীভাবে বেড পাবো, কীভাবে বাড়ি থেকে হাসপাতালে যেতে অ্যাম্বুলেন্স পাবো,–এই বিষয়গুলি নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পুরোপুরি ধোঁয়াশা রয়েছে।
এই বিরাট শূন্যতা পূরণ করার লক্ষ্যে ভাটপাড়ার বেশ কিছু উদ্যমী মানুষকে নিয়ে গড়ে উঠেছে “কোভিড সঙ্কট সহায়তা গোষ্ঠী”। এই গোষ্ঠীর একজন সাধারণ সদস্য হিসাবে জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে বেশ কিছু বিপন্ন কোভিড আক্রান্ত রোগীকে দ্রুততার সঙ্গে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে স্বাস্থ্য দপ্তরের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করে সরকারী এবং সরকার-অধিগৃহীত বেসরকারী হাসপাতালে বেডের ব্যবস্থা করে ভর্তি করা সম্ভব হয়েছে যা ঘরেতে বসে সম্পূর্ণ দূরভাষের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। যদিও ভাটপাড়াতেই প্রশাসনিক ব্যর্থতায় ৭৫ বৎসর বয়েসের এক বৃদ্ধের পরিবারের ১৮ ঘন্টার চেষ্টায় অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় বাড়িতেই মৃত্যু হওয়ার ঘটনা পরের দিন দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সংবাদ হওয়া সমগ্র শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে ভীষণভাবে আহত করেছে।
রাজ্য সরকার উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ব্যারাকপুর মহকুমার কোভিড বৃদ্ধির হার রুখতে গত ৩রা আগষ্ট থেকে নৈহাটি স্টেট জেনারেল হাসপাতাল, খড়দহের বলরাম গ্লোবাল হাসপাতালকে কোভিড হাসপাতাল হিসাবে ঘোষণা করেছে। এর ফলে অনেক বেশি সংখ্যক কোভিড রোগীকে ভর্তি করা সম্ভব হবে এবং যে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে তাকে অনেকাংশে সংযত করা সম্ভব হবে। রাজ্য সরকার নানাভাবে উদ্যোগ নিচ্ছে কোভিডকে মোকাবিলা করার জন্য। কিন্তু সমাজের বেশ কিছু মানুষের মধ্যে অন্ধ বদ্ধমূল ধারণা কোভিড আক্রান্ত রোগীকে অস্পৃশ্য করে রাখছে, একঘরে করে রাখছে। এর জন্য সমাজের অগ্রণী শিক্ষিত অংশকে ঘরের বাইরে বেরোতে হবে এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রমাণ দিতে হবে এবং বোঝাতে হবে রোগীকে নয় রোগের বিরুদ্ধে সমবেত ভাবে লড়তে হবে,তবেই আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।
১০/০৮/২০২০
Debashish Pal মহাশয়ের ফোন নং টা পাওয়া যাবে????